প্রতিটি নতুন দিনেই আসে নতুন সুযোগ

সুমাইয়া কাজি
সুমাইয়া কাজি

‘প্রতিটি নতুন দিনে অসংখ্য সুযোগ আসে নিজের জন্য। সেগুলোর জন্য চেষ্টা করুন। একটা সুযোগ থেকে শিখবেন। মানুষের সঙ্গে যোগাযোগ হবে, নেটওয়ার্কিং বাড়বে। এভাবেই সাফল্য আসবে।’

নতুন বছরের প্রথম দিনে বাংলাদেশের তরুণদের উদ্দেশে সুমাইয়া কাজির এটাই বার্তা।

কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তাসম্পন্ন সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম সুমাজি ডটকমের প্রতিষ্ঠাতা সুমাইয়া কাজি সিলিকন ভ্যালির সেরা তরুণ উদ্যোক্তা (এন্ট্রাপ্রেনিউর) হিসেবে আলোচিত। সিলিকন ভ্যালি বদলে দেবেন যে তরুণেরা, সেই তালিকায় সুমাইয়ার নাম বেশ স্পষ্টভাবেই স্থান পেয়েছে।

সুমাইয়া কাজির দাদার বাড়ি ফেনীর মাথিয়ারায়। ডিসেম্বর মাসে বাংলাদেশে এসেছিলেন পারিবারিক কারণে। ফিরে যাওয়ার আগে তিনি সময় দেন প্রথম আলোকে। ২৭ ডিসেম্বর সকালে ঢাকার উত্তরায় রয়েল ক্যুজিন রেস্তোরাঁয় কথা হয় তাঁর সঙ্গে। এ সময় সুমাইয়ার সঙ্গে ছিলেন তাঁর বাবা ড. নিজাম উদ্দিন কাজি, বোন চাঁদনি কাজি ও চাচা কিবরিয়া কাজি।

কথোপকথনের শুরুতেই জানালেন, এখন তথ্যপ্রযুক্তিভিত্তিক নতুন স্টার্টআপ (নতুন ব্যবসায় উদ্যোগ) নিয়ে কাজ করছেন। কী সেটা? ‘এখন তো বলা যাবে না। সুমাজি ডটকম ছিল বিটুবি (ব্যবসা থেকে ব্যবসা), নতুন স্টার্ট-আপ হবে বিটুসি (ব্যবসা থেকে ক্রেতা)। আশা করছি ২০১৮ সালেই এটা চালু হবে,’ বললেন সুমাইয়া।

ইউনিভার্সিটি অব ক্যালিফোর্নিয়া, বার্কলি (ইউসি বার্কলি) থেকে বিপণনে পড়াশোনা শেষ করে সুমাইয়া কাজি যোগ দিয়েছিলেন ফরচুন ৫০০ কোম্পানির একটি বিশ্বখ্যাত সান মাইক্রোসিস্টেমে। ২০০৫ সালের কথা সেটা। তখন সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম বিষয়টি ঠিকমতো শুরুই হয়নি। সুমাইয়া বুঝতে পেরেছিলেন, দ্রুতই এ বিষয়টা বিশ্ব কাঁপাবে। সুমাইয়া বলেন, ‘ফেসবুকও তখন একেবারে শিশু। আমি আমার চেয়ে ২০ বছরের বড় কর্মকর্তাদের বোঝালাম, এটাই ভবিষ্যৎ। তাঁরা বুঝলেন এবং আমি হলাম সান মাইক্রোসিস্টেমের প্রথম সোশ্যাল মিডিয়া ম্যানেজার। ’ সিলিকন ভ্যালিতে তখন বড় কোনো প্রতিষ্ঠানে এমন পদ ছিল না।

এদিকে অন্য একটা কাজ নিজের তাগিদে করতে থাকেন সুমাইয়া। অপ্রচলিত পেশায় যাঁরা যেতে চান, তাঁরা জানেন না কোথাও তাঁদের সুযোগ আছে কি না। একটা ই-মেইল গ্রুপ খুলে সুমাইয়া জীবনবৃত্তান্ত চাইতে থাকেন। নাম দেন কালচার কানেক্ট। সুমাইয়া বললেন, ‘একদিন সকালে অফিসে এসে একটা মেইল পেলাম। এরপর এটা ভাইরাল হতে থাকে।’

দুই মাস পর এটা উদ্যোগে রূপ পেতে থাকে। দেশি কালচার কানেক্ট, এশিয়া কালচার কানেক্ট, আফ্রিকা কালচার কানেক্ট—এভাবে কয়েক রকম উদ্যোগ শুরু হয়ে যায়। কোনো কোনোটা সাময়িকী হিসেবেও প্রকাশিত হয়। এই উদ্যোগে ব্যবহারকারীরা জীবনবৃত্তান্ত আদান-প্রদান করতেন।

ভালোই চলছিল সান মাইক্রোসিস্টেমের চাকরি আর কালচার কানেক্টের কাজকর্ম। কিন্তু সুমাইয়া স্বপ্ন দেখলেন নিজের একটি স্টার্ট-আপের। ২০১১ সালের এপ্রিলে চালু হলো সুমাজি ডটকম। কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা প্রযুক্তি ব্যবহার করে এই সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম এটির ব্যবহারকারীর তথ্য-উপাত্ত (ডেটা) বিশ্লেষণ করে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানকে জানাত, তাদের পণ্য বা সেবার সম্ভাব্য ভোক্তা কারা হতে পারেন। কার কী বিষয়ে আগ্রহ তাও বিশ্লেষণ করে সুমাজি ডটকম।

সাড়াজাগানো সুমাজি ডটকমের সিদ্ধান্ত কিন্তু হয়েছিল ঢাকায়। ২০১০ সালে সুমাইয়া বাবার সঙ্গে বাংলাদেশে এসেছিলেন। একটি পাঁচ তারকা হোটেলে এক সকালে নাশতা খেতে খেতে বাবাকে সুমাইয়া বলেন, ‘আমার সামনে দুটো অপশন—সান মাইক্রোসিস্টমের চাকরি করে যাওয়া অথবা নিজের একটা প্রতিষ্ঠান শুরু করা। আমার আইডিয়া রয়েছে, সেটা দিয়ে উদ্যোগ শুরু করতে পারি। ’

প্রথম আলোর সঙ্গে আলাপচারিতার এ পর্যায়ে বাবা নিজাম উদ্দিন কাজি বললেন, ‘আমার জন্য এ ব্যাপারে সিদ্ধান্ত দেওয়া কঠিন ছিল। একদিকে নিরাপদ নিশ্চিন্ত ভালো চাকরি, আরেক দিকে শূন্য থেকে শুরু করা। আমি বললাম, “তোমার নিজের আইডিয়া নিয়ে এগিয়ে যাও, অভিজ্ঞতা হবে।”’

চালু হলো সুমাজি ডটকম। টেকক্র্যাঞ্চ স্টার্টআপ ব্যাটলফিল্ড নামে নতুন উদ্যোগগুলোর প্রতিযোগিতায় এটি চূড়ান্ত বাছাইয়ে থাকে। যেসব স্টার্টআপ দুনিয়া বদলে দেবে, সেগুলোর তালিকায় সুমাজির নাম উঠে যায়। সুমাজি এ পর্যন্ত ১০০ কোটি মানুষের তথ্য বিশ্লষণ করেছে।

দারুণ কিছু অর্জন রয়েছে সুমাইয়ার। ২০০৬ সালে বিজনেস উইক সাময়িকীর অনূর্ধ্ব-২৫ বছর বয়সী উদ্যোক্তার স্বীকৃতি পান। ২০১২ সালে ফোর্বস সাময়িকীর ‘ফিমেল ফাউন্ডারস টু ওয়াজ ফ্রম ইউসি বার্কলি’ তালিকায় ছিলেন সুমাইয়া। ২০১২ সালে রয়টার্স তাঁকে ওয়েবে প্রভাবশালী নির্বাহী হিসেবে স্বীকৃতি দেয়। ২০১৪ সালে ব্রিটিশ বাংলাদেশি পাওয়ার অ্যান্ড ইনস্পিরেশন ১০০ বিশ্বের ১০ জন প্রেরণাদায়ী বাংলাদেশির একজন হিসেবে সুমাইয়ার নাম উল্লেখ করে। এ ছাড়া উদ্যোক্তাদের জন্য মেন্টর, প্রেরণাদায়ী বক্তা হিসেবে অনেক সম্মাননা পেয়েছেন সুমাইয়া কাজি। বর্তমানেও বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সম্মেলন, তরুণদের সমাবেশে বক্তৃতা করেন তিনি।

সুমাইয়ার বাবা নিজাম উদ্দিন আহমেদ ছিলেন চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে গণিতের সহকারী অধ্যাপক। যুক্তরাষ্ট্রে পাড়ি জমান ১৯৭৮ সালে। এখন ক্যালিফোর্নিয়ার মাউন্ট স্যান জ্যানিসোটা কলেজের অধ্যাপক। ১৯৮১ সালে বিয়ে করেন মেরিনা তটিনি কাজিকে। ১৯৮২ সালের ১৭ জুলাই ক্যালিফোর্নিয়ায় জন্ম হয় সুমাইয়ার। দুই ভাই দুই বোনের মধ্যে তিনিই বড়। সুমাইয়া থাকেন সানফ্রান্সিসকোতে। তিনি বললেন, এখানেই হচ্ছে নতুন সিলিকন ভ্যালি।

বাংলাদেশের তরুণদের কাছ থেকে প্রতি সপ্তাহেই ই-মেইল পান সুমাইয়া কাজি। তিনি বলেন, ‘অনেকের ভাবনাই ভালো। বাংলাদেশের আইভি রাসেলের উদ্যোগ “মায়া আপা” তো ব্র্যাকের তহবিলও পেয়েছে। আমি সুমাজির জন্য আউটসোর্সিং করিয়েছিলাম ভারতে। এখন তো দেখি বাংলাদেশের তরুণ ফ্রিল্যান্সাররা আউটসোর্সিং ওয়েবসাইটগুলোর শীর্ষ তালিকায় অবস্থান করছে। প্রয়োজন হলে বাংলাদেশেই কাজ করাব।’

সুমাইয়া যোগ করেন, ‘বাংলাদেশে থেকেও ভালো কিছু করা সম্ভব। আইডিয়া হতে হবে ভালো, এরপর যোগাযোগ বাড়াতে হবে। স্টার্টআপে দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা হয় না। তিন, বড়জোর ছয় মাসের পরিকল্পনা মাথায় রাখতে হবে। কারণ, প্রযুক্তির সবকিছুই দ্রুত বদলে যায়।’

তরুণদের জন্য সুমাইয়া বললেন, ‘নিজেদের মধ্যে আলাপ করতে হবে। আশপাশে কী সমস্যা রয়েছে, সেসব থেকে সমস্যা বেছে নিয়ে সমাধান খুঁজতে হবে। ১০ জন যদি কোনো একটি সমস্যার কথা বলে, বুঝতে হবে সেটাতেই আছে আইডিয়া।’

নানা বিষয়ে আগ্রহ সুমাইয়া কাজির। তিনি সালসা ও বাচাতা নৃত্যশিল্পী। সার্ফিং, বক্সিং, বাস্কেটবল, ফেন্সিং নানা খেলায় পারদর্শী। নিজের জীবনযাপনে ‘ইন্টারমেটিং ফাস্টিং’ মেনে চলেন। অর্থাৎ নির্দিষ্ট সময়ের জন্য না খেয়ে থাকা, তারপর আবার খাওয়া। বললেন, যখন সুযোগ পাই, তখন আমি আট ঘণ্টা খাই, পরের ৩৬ ঘণ্টা খাই না। এই সময়টা ১৬ ঘণ্টা ঘুমাই। এটা কোনো ডায়েট না, জীবনযাপন। আমি এই জীবনযাপনের চর্চা করে সাড়ে সাত মাসে ৫৫ পাউন্ড ওজন কমিয়েছিলাম।’ এ বিষয়ে একটা ব্লগ লিখে নিজের ওয়েবসাইটে প্রকাশ করেছিলেন সুমাইয়া। সেটির পাঠক সংখ্যা দাঁড়ায় পাঁচ লাখে।

বাংলাদেশের তরুণদের সহযোগিতা করার ইচ্ছা আছে সুমাইয়ার। তিনি বললেন, ‘আমি বাল্যবিবাহ প্রতিরোধ, নারীদের শিক্ষা নিয়ে কাজ করতে চাই। আর হতে চাই তরুণ মেয়েদের রোলমডেল।’

সুমাইয়া কাজি তাঁর নিজের ওয়েবসাইটে (www.sumayakazi.com<http://www.sumayakazi.com/>) এখনই একটি পেজ খুলবেন। যেটায় বাংলাদেশের মেয়েরা বাল্যবিবাহ নিয়ে সমস্যার কথা জানাতে পারবেন। সেসব সমস্যা থেকে বাল্যবিবাহ প্রতিরোধের একটা উপায় বের করার কথা ভাববেন সুমাইয়া। তিনি বলেন, ‘আমি শুনতে চাই, সমাধান করতে চাই।’