মা-বাবা কেন একা ছাড়েন না মেয়েকে?

পড়াশোনা, চাকরি সবকিছুতে মেয়েরা এগিয়ে যাচ্ছে। অথচ নিরাপত্তাহীনতার কারণে তাকে একা ছাড়তে এখনো ভয় পান অভিভাবকেরা l ছবি: সুমন ইউসুফ
পড়াশোনা, চাকরি সবকিছুতে মেয়েরা এগিয়ে যাচ্ছে। অথচ নিরাপত্তাহীনতার কারণে তাকে একা ছাড়তে এখনো ভয় পান অভিভাবকেরা l ছবি: সুমন ইউসুফ

সকাল থেকে তেতে আছে সুমির (ছদ্মনাম) মেজাজ। দুই দিন ধরে এত সব পরিকল্পনা ভেস্তে যেতে বসেছে মায়ের কারণে। বান্ধবীর জন্মদিনে রেস্তোরাঁয় খাওয়া হবে। সেখানে তাকে চমক দেবে অন্য বান্ধবীরা। টিফিনের টাকা জমিয়ে হয়েছে সব আয়োজন। বিকেলের দিকে অনুষ্ঠান শুরু হবে, শেষ হতে হতে সন্ধ্যা হয়ে যাবে। তাতেই মা বেঁকে বসেছেন। একা যেতে দেবেন না। অথচ অন্য কোনো বান্ধবীর মা বা অভিভাবক থাকবেন না সেখানে। নবম শ্রেণিতে পড়ে সবাই, এখন তো কিছুটা স্বাধীনতা দেওয়া উচিত।

সুমির মা আফরোজা বেগমের ভাবনা জানা যাক। তিনি বললেন, ‘বর্তমান সামাজিক প্রেক্ষাপটে বাবা-মা কীভাবে একজন মেয়েকে একা ছাড়বেন? ও তো এখন ছোট না, আবার বড়ও হয়নি। নিজের নিরাপত্তার বিষয়টি বোঝার মতো বয়স হয়নি ওর। রাস্তাঘাটের যে অবস্থা, কত ধরনের হয়রানির শিকার হতে হয় মেয়েদের। মেয়ের যদি কোনো বিপদ হয়!’

এই মায়ের আশঙ্কা কি অমূলক? গত কয়েক যুগে বহু ক্ষেত্রে এগিয়ে গেছে দেশ। অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি, যোগাযোগ, তথ্যপ্রযুক্তি—সব ক্ষেত্রে দেশের অগ্রগতি দৃশ্যমান। ঘরে-বাইরে বহু ক্ষেত্রে নারী নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করেছে। প্রাথমিক ও মাধ্যমিক স্তরে ছাত্রদের তুলনায় ভালো করছে ছাত্রীরা। উচ্চমাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষায় ছাত্রীর সংখ্যা দিনে দিনে বাড়ছে। সরকারি চাকরিতেও এখন নারীর সংখ্যা এক-চতুর্থাংশের মতো। শ্রমিক থেকে শুরু করে পেশাজীবী, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী থেকে প্রতিরক্ষা বাহিনী, রাজনীতি—সব ক্ষেত্রেই নারীর উপস্থিতি উল্লেখযোগ্য। এই সংখ্যা আরও বাড়তে পারত। কিন্তু সমাজের নানা ধরনের প্রতিকূল পরিস্থিতি বাধা হয়ে দাঁড়াচ্ছে একটি মেয়ের জন্য।

জীবনের শুরুতে একটি মেয়ের পরিপূর্ণ স্বাধীনতা দিতে এখনো বহু যুগ পেছনে পড়ে আছি আমরা, আমাদের সমাজ। একবিংশ শতাব্দীতে এসেও কিশোরী বা সদ্য তরুণী মেয়েকে একা চলাচল করতে দিতে ভয় পান অভিভাবকেরা। নিরাপত্তাহীনতার এই আতঙ্কে তাঁরা তা পারেন না। সমাজ সেই নিরাপদ পরিবেশ তৈরি করতে পারেনি। মেয়েটির বেড়ে ওঠার সবচেয়ে সুন্দর ও উচ্ছল সময়টিতে তাকে বেঁধে রাখা হচ্ছে নিরাপত্তার শৃঙ্খলে।

রাফিয়া আলমের (ছদ্মনাম) ১৫ বছরের একটি মেয়ে আছে। নিজের কৈশোরের সময়ের চেয়ে মেয়ের এই সময়টার মধ্যে বিস্তর ফারাক আছে বলে তাঁর মনে হয়। তিনি বলেন, ‘আমাদের কৈশোরে মেয়েদের নিরাপত্তা নিয়ে এখনকার মতো এত টেনশন ছিল না। মেয়েদের উত্ত্যক্ত করার কোনো অভিযোগ পেলে ছেলের অভিভাবকদের নিয়ে সামাজিকভাবে বিচার হতো। তখন বখাটে ছিল না এমনটা নয়, তবে এখন তো মুখ খোলাই দায়। সেদিন মেয়েকে নিয়ে বাসে উঠেছিলাম। বাস থেকে নামার পর মেয়ে হাউমাউ করে কাঁদতে শুরু করল, আমি বারবার জানতে চাইলাম কী হয়েছে। কোনো উত্তর নেই, কেবল কাঁদতেই থাকল ও। ভাবুন, আমি সঙ্গে থাকলেও হয়রানি বন্ধ হচ্ছে না, একা ছাড়ি কীভাবে?’
বেসরকারি একটি ব্যাংকে চাকরি করেন শাহানা আলম। তিনিও উদ্বিগ্ন তাঁর দশম শ্রেণিতে পড়া মেয়েটির নিরাপত্তা নিয়ে। বললেন, ‘আমি ও আমার স্বামী দুজনই চাকরি করি। আমি, আমার স্বামী বা আমার মা মেয়েকে স্কুল বা কোচিং ক্লাস থেকে আনা-নেওয়া করি। যাত্রাপথেই বলুন কিংবা গন্তব্যে, কোথায় নিরাপদ মেয়েটি? খুব ভয় হয়। মেয়ের নানি টিচারের বাসায় পড়ার সময় পাশে বসে থাকেন। ছায়ার মতো আগলে রাখেন মেয়েকে।’
নিরাপত্তা নিয়ে অভিভাবক ও কিশোরী মেয়ের মধ্যেও অনেক সময় মনস্তাত্ত্বিক টানাপোড়েন তৈরি হয়। অনেক ক্ষেত্রে বাবা-মায়ের উদ্বেগের বিষয়টি বুঝতে পারে না মেয়েটি। তেমনই একজন শিক্ষার্থী রাসনা। কলেজ পড়ুয়া রাসনার কাছে বিষয়টি নিয়ে জানতে চাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে তীব্র অভিমানে ফেটে পড়ে সে। বলল, ‘আমার ছোট ভাই ক্লাস টেনে পড়ে। ও ঠিকই একা স্কুলে যায়, টিচারের বাসায় যায়। অথচ আমাকে কখনো একা ছাড়ে না। কেন? আমি কী করেছি? আমি তো ঠিকমতো পড়াশোনা করি। মিথ্যাও বলি না। আমাকে কখনো পিকনিকেও যেতে দেওয়া হয় না। এমনকি শিক্ষাসফরে যাওয়ারও অনুমতি পাইনি কোনো দিন। মামার বিয়েতেও যেতে দেওয়া হয়নি আমাকে। ভাই কিন্তু সব জায়গায় যাচ্ছে। আমার কী অপরাধ? আমি বুঝি না কেন আমাকে আম্মু-আব্বু বিশ্বাস করেন না।’
সমাজ, পরিবার নিরাপত্তা দিতে পারছে না, কিন্তু এর শাস্তি পাচ্ছে মেয়ে। সমাজ এগোচ্ছে সব ক্ষেত্রে, কেবল থমকে আছে এখানে।

মেয়েটিকে তাঁরা রক্ষা করতে পারেন না
ফারাহ কবির
কান্ট্রি ডিরেক্টর, অ্যাকশনএইড

আমার বাবা-মা আমাকে কোনো দিন বিয়েবাড়িতে যেতে দেননি। রাতে বান্ধবীদের বাসায় থাকতে দেননি। আসলে যুগ যুগ ধরেই সামাজিক নিরাপত্তার অভাব অনুভব করেন অভিভাবকেরা। মেয়েটিকে তাঁরা রক্ষা করতে পারেন না। তাই রক্ষা করার নামে আলাদা করে রাখতে চান। সমাজ এটাকে পুঁজি করছে। একটি অংশকে পেছনে ফেলে রেখে ফায়দা লুটছে। পরিবারে ছেলেদের সেই মূল্যবোধ দিয়ে বড় করতে হবে, যেন তারা তাদের বোন, সহপাঠী ও সহকর্মীর জন্য নিরাপত্তার অনুভূতি তৈরি করতে পারে। আমরা এমন একটি শিক্ষা কার্যক্রম চালু করার কথা বলি, যেখানে ছেলেমেয়েদের মধ্যে পারস্পরিক শ্রদ্ধাবোধ জন্মাবে। অথচ আমাদের পাঠ্যপুস্তক পরিবর্তন করে ‘ও—তে ওড়না’ পরিয়ে দেওয়া হয়। এতে কী শিখবে সমাজ? এ ছাড়া বিচারহীনতা সামাজিক অবক্ষয়ের একটি অন্যতম কারণ। এখন ধর্ষণ-খুনের মতো অজস্র ঘটনা আমরা দেখতে পাই। আগেও ছিল, তবে এতটা নয়। বিচারের আওতায় আনা যাচ্ছে না অপরাধীদের। অ্যাসিড-সন্ত্রাসে জড়িত অপরাধীদের ধরা হলো, দেখা গেল আইনের ফাঁকফোকর গলে তারা ঠিকই বের হয়ে আসে। এতে নিরাপত্তাহীনতা তৈরি হচ্ছে। মানসিকভাবে আরও সংকুচিত হয়ে যাচ্ছে পরিবার।