ডেনমার্কের রাষ্ট্রদূতের সঙ্গে এক দিন

বাঁ থেকে রাতানাওয়াদি উইনথার, সায়মা আফরিন ও মাইকেল হেমনিটি উইনথার। ছবি: সংগৃহীত
বাঁ থেকে রাতানাওয়াদি উইনথার, সায়মা আফরিন ও মাইকেল হেমনিটি উইনথার। ছবি: সংগৃহীত

১ ফেব্রুয়ারি সকালে সায়মা আফরিনের ঘুম ভাঙল মুঠোফোনের শব্দে। ফোনের অপর প্রান্ত থেকে যা বলা হলো, শুনে নিজেকে আর শান্ত রাখতে পারলেন না তিনি। ফোন রেখেই এমন এক চিৎকার দিলেন যে পাশের ঘর থেকে ছুটে এলেন মা। ‘কী হলো? কী হলো?’ বাংলাদেশে অবস্থিত ডেনমার্কের দূতাবাস থেকে ফোন এসেছে। মাকে জড়িয়ে ধরে সায়মা দিলেন খবরটা, ‘এক দিনের জন্য ডেনমার্কের ছায়া রাষ্ট্রদূত নির্বাচিত হয়েছি আমি!’

বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) কেমিকৌশল বিভাগের চতুর্থ বর্ষের ছাত্রী সায়মা কীভাবে এই সুযোগ পেলেন? জানতে হলে পিছিয়ে যেতে হবে আরও কয়েক দিন। ফেসবুকের হোম পেজে ছোট্ট একটা ভিডিও তাঁর চোখে পড়েছিল। ‘অ্যাম্বাসি অব ডেনমার্ক ইন বাংলাদেশ’ নামের পেজটি থেকে দেওয়া ভিডিওতে বলা হয়েছিল, এক দিনের জন্য ছায়া রাষ্ট্রদূত হতে হলে দুটি প্রশ্নের উত্তর দিতে হবে। প্রথমত, ছায়া রাষ্ট্রদূত হয়ে কী শিখতে চান? আর দ্বিতীয়ত, যদি নির্বাচিত হন তবে বাংলাদেশের তরুণসমাজকে কীভাবে দুর্নীতির বিরুদ্ধে কাজ করতে উৎসাহিত করবেন? উত্তর ভেবে ঝটপট সেটা পাঠিয়ে দিয়েছিলেন সায়মা। দ্বিতীয় ধাপে তাঁকে পাঠাতে হয়েছে নিজের জীবনবৃত্তান্ত। ব্যস, দুই দিন পরেই এল ফোন। জানানো হলো, চূড়ান্তভাবে নির্বাচিত হয়েছেন তিনি। খানিকটা অপ্রত্যাশিত ছিল বলেই আনন্দে বিরাট চিৎকার জুড়ে দিয়েছিলেন সায়মা।

কথা ছিল, ছায়া রাষ্ট্রদূত হিসেবে পুরো একটা দিন ডেনমার্ক দূতাবাসের কার্যক্রম পর্যবেক্ষণ করার সুযোগ পাবেন বুয়েটের এই শিক্ষার্থী। তাও আবার বাংলাদেশে নিযুক্ত ডেনমার্কের রাষ্ট্রদূত মাইকেল হেমনিটি উইনথারের তত্ত্বাবধানে! হয়েছেও তাই। ৬ ফেব্রুয়ারি, খুব কাছ থেকে সায়মা দেখেছেন, একটা দূতাবাসে কীভাবে কাজ হয়। হেমনিটি উইনথারের সঙ্গে ঘুরে দেখেছেন দূতাবাসের বিভিন্ন বিভাগ। সব পর্যবেক্ষণ করে কী বুঝলেন? সায়মার বক্তব্য, ‘ডেনমার্কের রাষ্ট্রদূত খুব হাসিখুশি একজন মানুষ। কাজের সময় সবার মতামতকে প্রাধান্য দেন। সবার কথা শুনে একটা চূড়ান্ত সিদ্ধান্তে আসেন।’

দূতাবাস ঘুরে দেখা ছাড়াও মাইকেল হেমনিটি উইনথারের সঙ্গে ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশের কার্যালয়ে যাওয়ার সুযোগ হয়েছিল সায়মার। সেখানে আলাপ হয়েছে একদল তরুণ স্বেচ্ছাসেবীর সঙ্গে, যাঁরা সবাই দুর্নীতি দমনে কাজ করছেন। আর এসবের ফাঁকে তাঁর গল্প জমে উঠেছিল রাষ্ট্রদূতের সঙ্গে। সায়মা জেনেছেন, রোহিঙ্গা ইস্যুতে বাংলাদেশের দিকে সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিয়েছে ডেনমার্ক। কয়েক দিন আগে ডেনমার্কের বিশ্বখ্যাত ওষুধ প্রস্তুতকারী প্রতিষ্ঠান নভ নরডিস্কের সঙ্গে বাংলাদেশের প্রতিষ্ঠান এসকেএফের চুক্তি হয়েছে। সব মিলিয়ে দুই দেশের সম্পর্ক যে আরও দৃঢ় হচ্ছে, সে কথাই উঠে এসেছে তাঁদের আলোচনায়।

এবারের ছায়া রাষ্ট্রদূত নির্বাচনের ‘থিম’ ছিল দুর্নীতি দমন। দুর্নীতিগ্রস্ত দেশের তালিকায় সবচেয়ে নিচের দিকে রয়েছে ডেনমার্ক। অন্যদিকে, বাংলাদেশে দুর্নীতি বেশ প্রকট। সায়মা বলেন, ‘হেমনিটি উইনথার দুঃখ প্রকাশ করে বলছিলেন, অনিশ্চয়তার কারণে ড্যানিশ অনেক প্রতিষ্ঠান বাংলাদেশে বিনিয়োগ করছে না। দুর্নীতিই এই বিনিয়োগের ক্ষেত্রে বড় বাধা। তাই ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশের সঙ্গে এই বাধা অতিক্রম করতে তাঁরা কাজ করছেন।’ সায়মা এর আগে কখনো কূটনৈতিক কার্যক্রম দেখেননি। এ ব্যাপারে জ্ঞানও ছিল খুব সীমিত। তাই মনোযোগী শ্রোতার মতো তিনি সব কথা শুনেছেন। আবার সায়মার কথাও মনোযোগসহকারে শুনেছেন হেমনিটি উইনথার।

সায়মার বই পড়ার নেশা আছে জানতেই আলাপ জমেছিল সাহিত্য নিয়ে। ডেনমার্কের সাহিত্য, বিশেষ করে হ্যান্স ক্রিশ্চিয়ান অ্যান্ডারসনের লেখা, ডেনমার্কের ব্যালাড আর সেখানকার সংস্কৃতির সঙ্গে বাংলাদেশের সংস্কৃতির তফাত, আলোচনায় উঠে এসেছে এসব। এর মধ্যে এক ফাঁকে ফেসবুক লাইভে সাধারণ মানুষের প্রশ্নের উত্তর দিয়েছেন রাষ্ট্রদূত ও ছায়া রাষ্ট্রদূত, দুজন মিলে। হেমনিটি উইনথারের স্ত্রী রাতানাওয়াদি উইনথার এবং দূতাবাসের প্রেস অ্যান্ড কমিউনিকেশন প্রোগ্রাম অফিসার আন্দ্রেয়াস রাসমুসেনের সঙ্গেও সায়মার পরিচয় হয়েছে। সবার আন্তরিকতায় মুগ্ধতায় কেটেছে পুরোটা দিন।

কয়েক দিন আগে সায়মা ও তাঁর তিন বন্ধু ব্রিটিশ আমেরিকান টোব্যাকো আয়োজিত ব্যাটল অব মাইন্ডস প্রতিযোগিতায় ট্রাফিক জ্যাম সমস্যা সমাধানের পরিকল্পনা দিয়ে বিজয়ী হয়েছিলেন। আর এবার দুর্নীতি দমনে কীভাবে যুবসমাজকে যুক্ত করা যায়, সেই পরিকল্পনা জানিয়ে হলেন ছায়া অ্যাম্বাসেডর। এত সব পরিকল্পনা এখন থাকাই যাঁর মাথায়, নিজেকে নিয়ে তাঁর ভবিষ্যৎ পরিকল্পনাটা কী? সায়মা বললেন, ‘আপাতত প্রকৌশলীই হতে চাই। তবে ভবিষ্যতে রাষ্ট্রদূত হওয়ার সুযোগ পেলে সেটাও নিশ্চয়ই হাতছাড়া করব না।’