স্বপ্ন যেখানে আকাশছোঁয়া

উড়োজাহাজ ঘিরেই তাঁদের পড়ালেখা, ক্যারিয়ার, স্বপ্ন। ছবি: খালেদ সরকার
উড়োজাহাজ ঘিরেই তাঁদের পড়ালেখা, ক্যারিয়ার, স্বপ্ন। ছবি: খালেদ সরকার

ছোটবেলায় বিমানের শব্দ শুনলে জানালার কাছে ছুটে যেতেন জান্নাতুল ফেরদৌস। আকাশের দিকে তাকিয়ে আঁতিপাঁতি করে খুঁজতেন, কোথায় ‘মহাপতঙ্গটা’! স্বপ্ন দেখতেন, একদিন তিনিও আকাশে উড়বেন। উচ্চমাধ্যমিক শেষে এই স্বপ্নই তাঁকে ক্যারিয়ারের পথ দেখিয়েছে। ইউনাইটেড কলেজ অব অ্যাভিয়েশন, সায়েন্স অ্যান্ড ম্যানেজমেন্টে উড়োজাহাজ প্রকৌশল (অ্যারোনটিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং) বিষয়ে পড়ছেন। ঢাকার উত্তরার ৩ নম্বর সেক্টরে অবস্থিত কলেজটির মূল ফটকের পাশেই পড়ে আছে উড়োজাহাজের একটি পরিত্যক্ত ইঞ্জিন। ইঞ্জিনের পাশে দাঁড়িয়ে কথা হচ্ছিল জান্নাতুলের সঙ্গে। ‘সবাই চিকিৎসক বা প্রকৌশলী হতে চায়। আমি চেয়েছিলাম আমার আকাশে ওড়ার স্বপ্নটা একটু অন্যভাবে পূরণ করব। পাইলট হলেও এই স্বপ্ন পূরণ হতো। কিন্তু প্রকৌশলে আমার আগ্রহ ছিল। দুই আগ্রহ মিলে গেল এক জায়গায়, বেছে নিলাম অ্যারোনটিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং।’

ইউনাইটেড কলেজ অব অ্যাভিয়েশন, সায়েন্স অ্যান্ড ম্যানেজমেন্টে পড়ছেন প্রায় ২০০ ছাত্রছাত্রী। সবার মুখই জান্নাতুলের মতো স্বপ্নিল মনে হলো। অ্যারোনটিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং ছাড়াও কম্পিউটার বিজ্ঞান ও প্রকৌশল কিংবা অ্যাভিয়েশন ম্যানেজমেন্টে পড়ার সুযোগ আছে এখানে। কেবিন ক্রু হওয়ার প্রশিক্ষণও নিচ্ছেন অনেকে।

দিনের অনেকটা সময় কাটে ল্যাবে
দিনের অনেকটা সময় কাটে ল্যাবে

বিমান–সংক্রান্ত পড়াশোনা করতে হলে এই উড়োযানের ইঞ্জিন আর কলকবজার খুঁটিনাটি সম্পর্কে তো জানতেই হবে। ইউনাইটেড কলেজ অব অ্যাভিয়েশন, সায়েন্স অ্যান্ড ম্যানেজমেন্টের ল্যাবগুলো ঘুরে সেটা টের পাওয়া গেল। বিমান কীভাবে আকাশে ওড়ে, ৩০ হাজার ফুট ওপরে তেল কীভাবে ইঞ্জিনে কাজ করে; বিমানের গতি নিয়ে নানান পরীক্ষা–নিরীক্ষায় ব্যস্ত ছিলেন শিক্ষার্থীরা। উড়োজাহাজের আপেক্ষিক গতি আর বাতাসের বেগ নিয়ে অঙ্ক কষছিলেন প্রথম বর্ষের আভাস নন্দী। তাঁর খাতায় উঁকি দিয়ে অঙ্ক আর জ্যামিতিক আঁকিবুঁকি চোখে পড়ল। আভাস বললেন, ‘ইঞ্জিনিয়ারিং ম্যাথমেটিকস ক্লাসের অঙ্ক করছিলাম। একটু কঠিন। তবে শেষ পর্যন্ত হিসাব মিলাতে পেরেছি।’ তাঁদের পাঠ্যক্রমে কী কী থাকে, জানতে চাই আভাসের কাছে। জানালেন, গণিত, পদার্থবিজ্ঞান থেকে শুরু করে গ্যাস ডায়নামিকস, অ্যারো-ডায়নামিকসের নানা বিষয় এখানে পড়ানো হয়।

কলেজ কর্তৃপক্ষ জানাল, বিমান চালনা ও প্রকৌশল–সংক্রান্ত বিভিন্ন আন্তর্জাতিক পরীক্ষায় নির্দিষ্ট সময় পরপর বৈমানিক ও প্রকৌশলীদের অংশ নিতে হয়। আন্তর্জাতিক এই পরীক্ষায় বাংলাদেশের কেন্দ্র ইউনাইটেড কলেজ অব অ্যাভিয়েশন, সায়েন্স অ্যান্ড ম্যানেজমেন্ট। তাই বৈমানিক ও প্রকৌশলীদের বিভিন্ন আন্তর্জাতিক পরীক্ষা নেওয়ার পাশাপাশি দক্ষতা সনদ যাচাই-বাছাই করা হয় এই কলেজে। প্রতিষ্ঠানটির নির্বাহী পরিচালক মোহাম্মদ আলীর বক্তব্য, ‘বিমানসংক্রান্ত শিল্পের বৈশ্বিক বাজারের আকার কয়েক শ বিলিয়ন ডলার। এই বিশাল বাজারে বাংলাদেশের তরুণদের পেশাগত দক্ষতা বিকাশের চেষ্টা করছি আমরা। শুধু দেশে নয়, আন্তর্জাতিক বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে যেন ছেলেমেয়েরা কাজ করতে পারে, সেভাবেই আমরা তাঁদের গড়ে তুলতে চাই। শুধু সনদ দিয়েই আমাদের দায়িত্ব শেষ নয়। আমরা চাই, ছেলেমেয়েরা যেন দক্ষ, অভিজ্ঞ ও উদ্যোক্তা হওয়ার ধাপগুলো শেখে।’

ক্যাম্পাসের এক পাশে রাখা বিমানের ইঞ্জিনটির সঙ্গে ছাত্রছাত্রীদের সেলফি
ক্যাম্পাসের এক পাশে রাখা বিমানের ইঞ্জিনটির সঙ্গে ছাত্রছাত্রীদের সেলফি

একটি ‘মডেল উড়োজাহাজ’ আকাশে ওড়ানোর চেষ্টা করছিলেন একদল শিক্ষার্থী। দলের একজন এম আই ওয়ালিদ বললেন, ‘ব্যবহারিক শিক্ষার অংশ হিসেবে নিয়মিত বিভিন্ন দেশীয় ও আন্তর্জাতিক প্রতিযোগিতা এবং হ্যাকাথনে অংশ নিই আমরা। সামনে বেশ কয়েকটি প্রতিযোগিতা আছে। তাই মডেল বিমানটিকে কীভাবে আরও উন্নত করা যায়, সেটা নিয়ে কাজ করছি।’ ওয়ালিদের সঙ্গে মোহাম্মদ নাহিয়ান ও আরিফুর রহমান যোগ করলেন, ‘ক্লাসে ও প্র্যাকটিক্যাল ল্যাবে যা শিখছি, তা আমরা মডেল বিমান বানানো থেকে শুরু করে বিভিন্ন প্রযুক্তিবিষয়ক প্রতিযোগিতায় নানান প্রকল্প তৈরির মাধ্যমে প্রয়োগের চেষ্টা করি। শিক্ষকেরা এসব কাজে সব সময় উৎসাহ দেন, সাহায্য করেন।’

বিমান প্রকৌশল বিষয়ে দেশে পড়াশোনা শেষ করে যুক্তরাজ্যে উচ্চশিক্ষা নিতে চান শেগুফতা আহমেদ। প্রথম বর্ষের ছাত্রী শেগুফতা বলেন, ‘আমাদের কলেজের পড়াশোনা শেষ করে অনেকে বিদেশে পিএইচডি করতে যায়। আবার উচ্চতর প্রশিক্ষণ নিয়ে অনেকে দেশ-বিদেশের বিমান সংস্থাগুলোতে যোগ দেয়। আমিও বোয়িংয়ের মতো বড় কোনো বিমান সংস্থায় কাজ করতে চাই।’ শেগুফতার বন্ধু জান্নাতুলের বক্তব্য, ‘আমাদের বড় ভাইয়া-আপুরা বিভিন্ন বিমান সংস্থায় কাজ করছেন। অনেকে দেশের বাইরে পিএইচডি করছেন। অ্যালামনাইদের নেটওয়ার্ক বেশ শক্তিশালী বলে আমাদের বেশ সুবিধা হয়।’

চলছে ক্লাস
চলছে ক্লাস

প্রকৌশলের পড়ালেখাটা সহজ নয়, সেটা সত্যি। কিন্তু ছাত্রছাত্রীদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেল, পড়াশোনার অংশ হিসেবে বিভিন্ন বিমান সংস্থার বিমানে চড়া, বিমানবন্দরের হ্যাঙ্গারে থাকা উড়োজাহাজ নিয়ে ঘণ্টার পর ঘণ্টা কাজ করা...এসবের অনুভূতি অন্য রকম। একটি বেসরকারি বিমানসংস্থায় শিক্ষানবিশ হিসেবে কাজ করছেন ইউনাইটেড কলেজ অব অ্যাভিয়েশন, সায়েন্স অ্যান্ড ম্যানেজমেন্টের ছাত্র নাঈম হাসান। তিনি বলেন, ‘আমাদের কলেজে বিদেশের অনেক পাইলট ও প্রশিক্ষকেরা নিয়মিত ক্লাস নেন। কলেজে ব্যবহারিক শিক্ষার ওপর বেশি গুরুত্ব দেয়া হয়। বিভিন্ন বিমানসংস্থার বিমানগুলো দেখে, হাতে–কলমে শিখেছি বলে প্রকৌশলের জটিল বিষয়গুলো আর জটিল মনে হয় না।’ আরেকটি বেসরকারি বিমানসংস্থায় এয়ারক্র্যাফট মেকানিক হিসেবে কাজ করছেন কলেজের সাবেক ছাত্র তাকভীর হোসেন। তাঁর বক্তব্য, ‘অ্যারোনটিক্যাল দুনিয়ার সর্বশেষ প্রযুক্তি সম্পর্কে শিক্ষকেরা আমাদের পড়ান। দেশেই আন্তর্জাতিক মানের প্রশিক্ষক আর শিক্ষকদের তত্ত্বাবধানে কাজ শেখার সুযোগ পেয়েছি বলে আমরা কর্মক্ষেত্রে এগিয়ে আছি।’