বইবদল থেকে অভিজ্ঞতা বদল

>­­­­­শিক্ষার্থীরা যেন পাঠ্যবইগুলো নিজেদের মধ্যে ভাগাভাগি করে পড়তে পারেন, সে জন্য একটা উদ্যোগ নিয়েছিলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের লোকপ্রশাসন বিভাগের স্নাতকোত্তরের ছাত্র সাইফুল্লাহ মাহফুজ। তাঁর প্রকল্পটির নাম ‘বইবদল’। এই কাজের সুবাদে ব্রিটিশ কাউন্সিলের আয়োজনে তিনি ঘুরে এসেছেন যুক্তরাজ্য থেকে। কীভাবে বইবদলের যাত্রা শুরু হলো, কেমন করে নিজের অভিজ্ঞতা অন্য দেশের তরুণদের সঙ্গে ভাগাভাগির সুযোগ হলো, সে কথা তিনি লিখেছেন স্বপ্ন নিয়ের পাঠকদের জন্য
যুক্তরাজ্যে অনুষ্ঠিত ইন্টারন্যাশনাল স্টাডি ভিজিটে অন্য দেশের তরুণদের সঙ্গে লেখক (পেছনে, বা থেকে দ্বিতীয়)
যুক্তরাজ্যে অনুষ্ঠিত ইন্টারন্যাশনাল স্টাডি ভিজিটে অন্য দেশের তরুণদের সঙ্গে লেখক (পেছনে, বা থেকে দ্বিতীয়)

গত বছর এই সময়টাতেই অংশ নিয়েছিলাম ব্রিটিশ কাউন্সিল ও ডেমোক্রেসি ওয়াচ আয়োজিত ‘অ্যাকটিভ সিটিজেনস ইয়ুথ লিডারশিপ’ প্রশিক্ষণে। প্রশিক্ষণের শেষ দিনে সবাই মিলে একটা সামাজিক উদ্যোগ নিতে হয়। অংশগ্রহণকারী ৩২ জনের সবাই একটা করে ভাবনা উপস্থাপন করে এবং ভোটাভুটি শেষে সামনে চলে আসে আমার দেওয়া ‘আইডিয়া’—বইবদল। তখনো জানতাম না, এই একটা ‘আইডিয়া’ আমাকে অনেক দূর নিয়ে যাবে।

বইবদল মূলত ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রছাত্রীদের মধ্যে বই আদান-প্রদানের একটি জায়গা। সহজ প্রযুক্তি—গুগল ডেটাশিট এবং একটি ফেসবুক পেজ দিয়ে এর যাত্রা শুরু। জিমেইল অ্যাকাউন্ট থাকলে বিনা মূল্যেই বইবদল তথ্যভান্ডারে ঢুকে বই নিতে পারবে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের যেকোনো ছাত্রছাত্রী। চালু করার আগে যথেষ্ট জটিলতা ও ভোগান্তি পোহাতে হয়েছে আমাদের। কীভাবে প্রকল্পটি চালু করলে খুব সহজে সাধারণ ছাত্রছাত্রীদের মধ্যে পৌঁছাতে পারব, সেটা ভাবতেই কেটে গিয়েছিল প্রায় এক মাস। প্রথমে ভাবা হয়েছিল, একাডেমিক বই নিয়ে এই উদ্যোগ তেমন কোনো সাড়া ফেলবে না। কিন্তু ফেসবুক পেজে কোনো রকম বুস্টিং ছাড়াই খুব দ্রুত বাড়তে থাকে লাইকের সংখ্যা, সেই সঙ্গে ইনবক্সে পেতে থাকি বইদাতা ও গ্রহীতাদের সাড়া। প্রায় দুই হাজার ছয় শ মানুষ এখন ফেসবুকে বইবদলের সঙ্গে আছেন।

সাধারণ ছাত্রছাত্রীদের বই দিয়ে সাহায্য করাটাই আসল উদ্দেশ্য। সাধারণত প্রতি সেমিস্টারের পর একাডেমিক বইগুলো আর পড়া হয় না। বইবদলে সেগুলো জোগাড় করে তথ্যভান্ডারে তালিকাবদ্ধ করা হয়। আমাদের কোনো অফিস নেই, নির্ধারিত জায়গা নেই। অতএব, সংগৃহীত বইগুলো জায়গা পায় আমার ও আমার সঙ্গে কাজ করা স্বেচ্ছাসেবকদের খাটের নিচে।

দেশের অনেক ক্যাম্পাসেই এখন এ ধরনের কার্যক্রম চালু হয়েছে। উৎসাহিত হয়ে আরও নতুন উদ্যোগ সংযোজন করেছি আমরা। ছাত্রছাত্রীদের নিয়ে ছোট ছোট দলে বসে বিভিন্ন বিষয়ে অভিজ্ঞতা ভাগাভাগি করে নেওয়ার আয়োজন করা হয়। ঢাকার অদূরে, সাভারে বইবদলের একটি স্কুল শাখা গঠন করা হয়েছে। বইবদলের পক্ষ থেকে আমরা আরও নানা রকম সামাজিক কার্যক্রমের সঙ্গে যুক্ত হয়েছি।

রীতিমতো হাড্ডাহাড্ডি প্রতিযোগিতা শেষে গত বছর দেশব্যাপী আয়োজিত ‘অ্যাকটিভ সিটিজেনস ট্রেনিং’ প্রোগ্রামের সাত হাজার জনের মধ্য থেকে মাত্র ছয়জনকে তিনটি পৃথক পৃথক আন্তর্জাতিক শিক্ষাসফরে পাঠায় ব্রিটিশ কাউন্সিল। তারই সর্বশেষ ধাপে বাংলাদেশকে প্রতিনিধিত্ব করতে যুক্তরাজ্যে যাই আমি ও ডিক্রুশ ত্রিপুরা ক্রস। এই আয়োজনের নাম ইন্টারন্যাশনাল স্টাডি ভিজিট বা আইএসভি।

যুক্তরাজ্যে ১৫ দেশের ২৯ জন তরুণের সঙ্গে এক সপ্তাহ থেকে নাগরিকত্ব, নাগরিকের দায়িত্ব ও কর্তব্য নিয়ে আলোচনা করেছি আমরা। যুক্তরাজ্যের বিভিন্ন সামাজিক-সাংস্কৃতিক সংগঠনের সঙ্গে মতবিনিময়, বাংলাদেশি বংশোদ্ভূত ব্রিটিশ ব্যারনেস মঞ্জুলা পলা উদ্দীনের সঙ্গে সাক্ষাৎ, হাউস অব লর্ডস ও হাউস অব কমন্স ভ্রমণ এবং রথারহ্যামের মেয়র ইভ রোজ কেনানের সঙ্গে দেখা করার সৌভাগ্য হয় আমাদের।

৩ থেকে ১০ ফেব্রুয়ারি আয়োজিত আইএসভি নিঃসন্দেহে আমার এই ছোট জীবনে একটি অসাধারণ অভিজ্ঞতা। ওখানকার সামাজিক কাজগুলো থেকে অনেক কিছু শেখার আছে বলে মনে করি। পড়ালেখার পাশাপাশি কারিগরি শিক্ষা, সামাজিক কাজ ও শিল্পচর্চায় ওখানকার তরুণেরা অনেক এগিয়ে আছে। শুধু যুক্তরাজ্য নয়, শিক্ষাসফরে আসা আরও ১৪টি দেশের প্রতিনিধিরাও তাঁদের সমাজ ও সামাজিক উদ্যোগ সম্পর্কে অনেক তথ্য জানিয়েছেন। ভাষা বা সংস্কৃতি এ যোগাযোগের ক্ষেত্রে বাধা হতে পারেনি। প্রতিদিনের কর্মক্লান্ত সেশনগুলো শেষে সবার সঙ্গে মিলে নিজ নিজ দেশের সংস্কৃতি তুলে ধরা, গান গাওয়া ছিল চমৎকার অভিজ্ঞতা। রথারহ্যামের কমিউনিটি রেডিও ‘রেডরোড এফএম’-এ নিজের প্রকল্প নিয়ে কথা বলার অভিজ্ঞতাটিকে আমি প্রথমে রাখব। অনুষ্ঠানের শেষে বাজানো হয়েছিল ‘ওরে নীল দরিয়া’ গানটি। বিদেশ বিভুঁইয়ে রেডিওতে আমার দেশের কথা বলার সুযোগ হলো, আমার দেশের গান বাজানো হলো...ভাবতেই ভালো লাগে।

ক্লাসে আমি পেছনের বেঞ্চে বসি। বন্ধুদের সঙ্গে হাসি, আড্ডা আর গানেই কেটে যায় বেশির ভাগ সময়। বিশ্ববিদ্যালয়ের নানা ক্লাবের সঙ্গে জড়িত আছি। দেখতে দেখতে বিশ্ববিদ্যালয়-জীবন প্রায় শেষের পথে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের লোকপ্রশাসন বিভাগের স্নাতকোত্তরের শিক্ষার্থী হিসেবে কলাভবনের বারান্দাতেই হয়তো আমার দেখা পাবেন। লেখাপড়ায় শুরুতে তেমন মনোযোগী না হলেও ইদানীং খুব মন দিয়ে পড়ার চেষ্টা করছি। ভালোবাসি বই পড়তে আর বেড়াতে। বিদেশ থেকে উচ্চশিক্ষা নিয়ে দেশে ফিরে মানুষের জন্য কাজ করতে চাই। সামাজিক কাজকে আমরা তেমন গুরুত্বসহকারে না নিলেও এখনই সময় সবাই মিলে কিছু একটা করার। সবাই মিলে চেষ্টা করলে তবেই না আমরা একটা সুন্দর বাংলাদেশ পাব।