বনমায়ার গল্প

>

২০১২ সালে জাতিসংঘের বন ও পরিবেশবিষয়ক একাধিক সংগঠনের উদ্যোগে গঠিত ‘দ্য কোলাবরেটিভ পার্টনারশিপ অন ফরেস্ট’-এর ওয়াঙ্গারি মাথাই পুরস্কার পান টেকনাফের কেরুনতলী গ্রামের খুরশীদা বেগম। তাঁর জীবন, তাঁর কাজ নিয়ে প্রথম আলোর উদ্যোগে তৈরি হয়েছে প্রামান্য চিত্র বনমায়া। সেই বনমায়া তৈরির গল্পই বলছেন নির্মাতা

প্রতিবছর আন্তর্জাতিক নারী দিবস উপলক্ষে দিবসটির এক দিন আগে ছায়ানট মিলনায়তনে নারীদের মিলনমেলার আয়োজন করে প্রথম আলো। গত বছরের আয়োজনে দেখানো হয়েছিল আমার পরিচালিত স্বল্পদৈর্ঘ্য প্রামাণ্যচিত্র ঘোড়সওয়ার, যা অনেক নারীকেই প্রেরণা জুগিয়েছিল, এমনকি আমাকেও। ১০-১১ বছরের মেয়ে তাসমিনার দুর্দান্ত গতিতে ঘোড়া ছুটিয়ে বিজয় ছিনিয়ে নেওয়ার গল্প ছিল সেটা।

এবারের নারী দিবস উপলক্ষে প্রথম আলো নতুন প্রামাণ্যচিত্র নির্মাণের কথা বলায় আমার মধ্যে একটা প্রত্যাশার চাপ তৈরি হলো। বাসায় ফিরে আমি গল্প খুঁজতে থাকি। অনেক গল্প ঘাঁটতে ঘাঁটতে অবশেষে পেয়ে যাই খুরশীদা বেগমের উদ্দীপনাময় গল্প। প্রথম আলোয় প্রকাশিত একটি লেখা থেকেই গল্পটা পেলাম। সেই কাহিনি ধরেই বনমায়া প্রামাণ্যচিত্র নির্মাণের সিদ্ধান্ত নিই।

খুরশীদা বেগমের গল্প পড়ে বিস্মিত ও অনুপ্রাণিত হলাম। বৈশ্বিক উষ্ণতার কবলে পড়ে যখন ধুঁকছে পৃথিবী, সবাই যখন অর্থসম্পদের লোভে উজাড় করছে পৃথিবীর বনভূমি, যেখানে মানুষ নিজেকে প্রকৃতির অংশ ভাবে না বরং মনে করে প্রকৃতির শাসক, সেখানে খুরশীদার মতো এমন নারী আমাকে উজ্জীবিত করে তোলেন, বিস্মিত করেন। পৃথিবীতে এখনো এমন নারী আছে যে তাঁর সামাজিক প্রতিবন্ধকতাকে তোয়াক্কা না করে এভাবে বনকে বাঁচিয়ে তুলছেন! তাঁর স্পর্শে ন্যাড়া পাহাড়ে আবার জেগে উঠছে মুমূর্ষু সব গাছ।

দলবল নিয়ে বন পাহাড়া দেন খুরশিদা বেগম। তাঁকে নিয়েই তৈরি হয়েছে তথ্যচিত্র ‘বনমায়া’
দলবল নিয়ে বন পাহাড়া দেন খুরশিদা বেগম। তাঁকে নিয়েই তৈরি হয়েছে তথ্যচিত্র ‘বনমায়া’

আমি খুরশীদা বেগমের সঙ্গে যোগাযোগ করে শুটিংয়ের প্রস্তুতি নিতে শুরু করি। কক্সবাজারের টেকনাফ আগে থেকেই আমার খুব প্রিয় জায়গা। এর অপরূপ প্রাকৃতিক সৌন্দর্য আমাকে মন্ত্রমুগ্ধ করে রাখে। বিশেষ করে এর একপাশে সমুদ্র, একপাশে নাফ নদী আর মাঝখানে পাহাড়। সুন্দর জায়গাকে সুন্দরভাবে চিত্রায়ণেই আমার যত ভালোবাসা। তাই ভেতরে-ভেতরে রোমাঞ্চিত হয়ে উঠি আমি, কিছুটা চ্যালেঞ্জ বোধ করি প্রাকৃতিক বৈরিতার কারণেও।

শুটিং শুরুর দুই দিন আগে আমি টেকনাফে পৌঁছেই লোকেশন দেখতে বের হই। সব জায়গায় প্রকৃতির এত সৌন্দর্য ছড়িয়ে-ছিটিয়ে আছে, আমি কোথায় যে ক্যামেরা রাখব তা নিয়ে ‘মধুর’ সমস্যায় পড়ি। খুরশীদা বেগমকে সঙ্গে নিয়ে আমরা বনে চলে যাই, দেখতে পাই তাঁদের পাহারায় জেগে ওঠা দারুণ সব পাহাড়ি গাছ। তারপর দেখা করি তাঁর দলের অন্যান্য সদস্যের সঙ্গে। তাঁদের অনেকেই ক্যামেরার সামনে আসতে চাইছিলেন না। কথা বলে মনে হলো, এসব বিষয়ে তাঁদের পরিবারের পুরুষদের কিছু নিষেধাজ্ঞা আছে। তাঁদের অনেক বুঝিয়ে-শুনিয়ে আমরা শুটিংয়ে রাজি করাই। পরদিন সকালবেলা খুরশীদা আপার বাসায় পৌঁছে দেখি ভোরবেলা সবাই হাজির।

তাঁদের নিয়ে শুটিংয়ে বেরিয়ে পড়ি। কিন্তু একটা সমস্যা হয়, কিছুদিন আগে খুরশীদা বেগমের নতুন একটি সন্তান হয়েছে। এ কারণে তাঁকে প্রায়ই শুটিংয়ের ফাঁকে ফাঁকে বাড়ি যেতে হয়। আর তাঁকে যেহেতু একটু পর পর তাঁর সন্তানের কাছে ফিরতে হয়, তাই ইচ্ছা থাকা সত্ত্বেও আমরা আরও গভীর বনে যেতে পারিনি, পরিকল্পনামাফিক অনেক শটও নিতে পারিনি। কিন্তু খুরশীদা বেগমের কথা ভাবুন, যিনি এই অবস্থায় আমাদের সঙ্গে ছুটেছেন বনে-পাহাড়ে-নদীতে।

খুরশিদার ছোটবেলার চরিত্র রূপদানকারী বেবী
খুরশিদার ছোটবেলার চরিত্র রূপদানকারী বেবী

খুরশিদা বেগমের ছোটবেলার চরিত্র রূপদানকারী বেবী, যে আমাদের বেশির ভাগ কথাই বুঝত না, সে তো গল্পের প্রয়োজনে বন-পাহাড়-নদী-সমুদ্র-সব জায়গায় কেবল দৌড়াচ্ছে আর দৌড়াচ্ছে। তার জন্য রইল অগাধ ভালোবাসা। আমরা টানা চার দিন শুটিং করি। ওখানকার সবাই আমাদের দারুণ সাহায্য করেছে, বিশেষ করে বন বিভাগের বিট কর্মকর্তা সাজ্জাদ হোসেন আর জালাল আহমেদের কথা তো ভোলার নয়। খুরশীদা বেগমের বাড়ি যেখানে, অর্থাৎ কেরুনতলীর বাসিন্দা এবং আমার দলের প্রতি আমার কৃতজ্ঞতা।

শুটিংয়ে গিয়ে একটা দুর্ঘটনায়ও পড়েছিলাম আমি। সূর্য ডুবে যাচ্ছিল বলে অন্য কাউকে না নিয়ে শুধু খুরশীদা বেগমকে নিয়ে আমি নাফ নদীর তীরে একটা শট নিতে যাই। ভাটার সময় আমি কাদা টের না পেয়ে কাদার ভেতর নেমে যাই এবং কাদার ভেতর আমার কোমর পর্যন্ত ডুবে যায়। আমি আতঙ্কগ্রস্ত হয়ে পড়ি। পরে খুরশীদা বেগমের সাহায্যে অনেক কষ্টে সেখান থেকে উঠে আসি। বুঝলাম, যে প্রকৃতিকে ভালোবাসে, সে মানুষকেও ভালোবাসে।

খুরশিদা বেগমের মতো নিবেদিত প্রাণসত্তা জন্ম নিক পৃথিবীর প্রতিটি ঘরে। বৈশ্বিক উষ্ণতার কবলে পড়া পৃথিবীর জন্য রইল শুভকামনা।

লেখক: বনমায়া প্রামাণ্যচিত্রের নির্মাতা।