ব্যথার মধ্যেও এগিয়ে যেতে হয়েছে

>ব্রেট লির পরিচয় অনেক। তিনি অস্ট্রেলিয়ার সাবেক ফাস্ট বোলার, গতিতারকা। সংগীতশিল্পী, গীতিকার, অভিনয়শিল্পী, ধারাভাষ্যকার—তাঁর এই পরিচয়গুলোও ভক্তদের অজানা নয়। কদিন আগে নিদাহাস ট্রফি চলাকালে এই বহুমুখী প্রতিভার অধিকারী ক্রিকেটারের মুখোমুখি হয়েছিলেন প্রথম আলোর ক্রীড়া প্রতিবেদক রানা আব্বাস। দীর্ঘ সাক্ষাৎকারে ব্রেট লি বলেছেন ছেলেবেলার কথা, ক্রিকেট নিয়ে তাঁর ভাবনা, আরও নানা কিছু। স্বপ্ন নিয়ের পাঠকদের জন্য আজ থাকল ব্রেট লির কথামালা
এক সময়ের গতিতারকাকে এখন ধারভাষ্যকার রূপেই বেশি দেখা যায়। ছবি: শামসুল হক
এক সময়ের গতিতারকাকে এখন ধারভাষ্যকার রূপেই বেশি দেখা যায়। ছবি: শামসুল হক

আমার কাছে ছেলেবেলায় ক্রিকেট খেলাটা ভীষণ উপভোগ্য ছিল। তখন বড় ভাই শেন, বাবা আর অ্যালান ডোনাল্ড ছিলেন আমার অনুপ্রেরণা। দক্ষিণ আফ্রিকান ফাস্ট বোলারদের বোলিং দেখতে ভীষণ ভালো লাগত। নয় বছর বয়সে ঠিক করলাম, আমি একজন ফাস্ট বোলার হব। মা-বাবাকে বলেছিলাম, পৃথিবীর সবচেয়ে গতিময় বোলার হব আমি, অস্ট্রেলিয়ার ব্যাগি গ্রিন ক্যাপ পরব। নয় বছর বয়স থেকেই ঘণ্টায় ১৬০ কিলোমিটার গতিতে বল করতে চেয়েছি। ১৬০ কিলোমিটার গতিতে বোলিং করতে যত বাধা আসুক, সব পেরিয়ে যাওয়ার লক্ষ্যেই অনুশীলন করেছি।

সব সময়ই বলে এসেছি, জীবনে একটা সঠিক ভারসাম্য দরকার। আমার অনেক বন্ধু, অনেক খেলোয়াড়ই অস্ট্রেলিয়ার হয়ে খেলেছে। তাদের সবার একটাই প্যাশন ছিল—ক্রিকেট। আর আমি ক্রিকেট খেলেছি, এটা উপভোগ করি বলে। ক্রিকেট কখনোই আমার প্রথম ভালোবাসা ছিল না। হ্যাঁ, অবশ্যই ক্রিকেট খেলাটা অনেক ভালোবাসি। এতে দেশে দেশে ঘোরার সুযোগ হয়েছে, নতুন নতুন মানুষের সঙ্গে মেশার সুযোগ হয়েছে। বিশ্বের সেরা খেলোয়াড়দের বিপক্ষে খেলার সুযোগ হয়েছে। আমার কাছে এটা খুব মজার ছিল। আমার আরও অনেক দিকে আগ্রহ ছিল, যেটি আমাকে এখন সামনে এগিয়ে নিচ্ছে। শুধু ক্রিকেটেই সীমাবদ্ধ থাকতে চাইনি।

ধারাভাষ্য দিতে ভালোবাসি। গান গাইতে ভালো লাগে। যা কিছু আমাকে উচ্ছ্বসিত করে, গান তার মধ্যে একটি। গান গাওয়ার মধ্য দিয়ে আমার যেটুকু ঘাটতি ছিল, সেটা পূরণ হয়েছে। এটা আমাকে প্রশান্তি দিয়েছে। সব ধরনের গানই শুনতে ভালো লাগে। রক, ধ্রুপদি, বাণিজ্যিক রক, আর হ্যাঁ, আশাজির সঙ্গে কাজ করে অনেক তৃপ্তি পেয়েছিলাম। সি ইজ লাভিং! অসাধারণ ব্যক্তিত্ব। কিছু বাংলাদেশি গান শুনেছি। হয়তো সামনে সেখানে গেলে ভিন্ন কিছু সুর শিখব। অভিনয় করার চেষ্টা করেছি। ভেবেছি এটা মজার হবে। আনইনডিয়ান ছবিতে অভিনয় করার পর মানুষ এটা ভালোভাবে নিয়েছে, পছন্দ করেছে। উপভোগ করেছে। প্রশংসা করেছে। বলিউডের হিন্দি ছবিতে অভিনয় করার কয়েকটা প্রস্তাব পেয়েছি। কিন্তু ব্যস্ততা অনেক। একটু অপেক্ষা করতে হবে। দেখি কী হয়, আমি অবশ্যই বলিউডে অভিনয় করব। অভিনয় নতুন একটা চ্যালেঞ্জও বটে। ক্রিকেট আর অভিনয়ের মধ্যে পার্থক্য হলো, অভিনয়ে আরেকবার চেষ্টা করার (টেক) সুযোগ থাকে। ক্রিকেটে বলতে পারবেন না, ওহ কাট! আরেকবার করব।

আনইনডিয়ান ছবির দৃশ্যে তন্নিষ্ঠা চ্যাটার্জি ও  ব্রেট লি
আনইনডিয়ান ছবির দৃশ্যে তন্নিষ্ঠা চ্যাটার্জি ও ব্রেট লি

তবে এত কাজের মধ্যেও আমার কাছে পরিবারই সব। পরিবারকেই সবার আগে রাখি। পরিবারই সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ। আমাদের পরিবারের বন্ধনটা খুব দৃঢ়। প্রতিদিন বাবা-মায়ের সঙ্গে কথা বলি আমরা। দুই ভাই আমার সবচেয়ে প্রিয় বন্ধু। হ্যাঁ, পরিবার আগে, বাকি সব পরে।

আমি মনে করি ভালো ফাস্ট বোলার হতে হলে আপনাকে ভালো অ্যাথলেট হতে হবে। ভালো স্প্রিন্টার হতে হবে। খুদে ক্রিকেটারদের আমি সব সময়ই একটা কথা বলি, চেষ্টা করো এবং জিমে ভারী যন্ত্রপাতি থেকে দূরে থাকো। ভারী জিনিসে আমি বিশ্বাসী নই। আপনি যদি এখন ব্যাটসম্যানদের দিকে থাকান, তারা আরও ভালো খেলছে, দিনে দিনে ভালো শট রপ্ত করছে। তারা ভালো কাঠের তৈরি ব্যাট নিয়ে খেলছে। বল জোরে মারছে। তারা তাদের টেকনিক কাজে লাগানোর চেষ্টা করছে। এখনকার দিনে বোলারদের সামনে অনেক বাধা, তাদের গতি কমে যাচ্ছে। আমি তো ধারাবাহিক ঘণ্টায় ১৪৫ কিলোমিটার গতিতে বোলিং করার বোলার খুব বেশি দেখি না। এটা হয়েছে তাদের অনুশীলনের কারণে। মনে হয় না তারা ঠিকভাবে অনুশীলন করে। আমি বলব ভারী জিনিস (ফিটনেস অনুশীলনে) কমিয়ে ফেলুন, হালকাই ভালো। রানিং, স্প্রিন্ট এসব বাড়িয়ে দিন।

ক্যারিয়ারে আমাকে বারবার চোটে পড়তে হয়েছে। কিন্তু চোটের কারণে বলের গতি কমিয়ে দেওয়ার ভাবনা কখনো মাথায় আসেনি। খেলা শেষ না করা পর্যন্ত এটা ধরে রাখাই আমার লক্ষ্য ছিল। ১৬ বছর বয়সে ঘণ্টায় ১৫০ কিলোমিটার গতিতে বোলিং করতাম। এটা ধরে রাখতে চেয়েছি আমার শেষ ম্যাচ পর্যন্ত। ২০ বছর ধরে ঘণ্টায় ১৫০ কিলোমিটার কিংবা তারও বেশি গতিতে বোলিং করতে চেয়েছি, সৌভাগ্য, সেটি পেরেছিও। এটা সম্ভব হয়েছে কঠোর পরিশ্রম ও আত্মনিবেদনের কারণে। আমি চাইলে সহজ উপায় বেছে নিতে পারতাম, ১৫ কদম দৌড়ে ঘণ্টায় ১৩৫ কিলোমিটার গতিতে বোলিং করতে পারতাম। তবে এটা আমাকে রোমাঞ্চিত করত না। আমি জোরে বোলিং করতেই ক্রিকেটে এসেছি। সেটি করতে অন্যদের চেয়ে বেশি পরিশ্রম করেছি। সম্ভবত অনেক বেশি অনুশীলনের কারণেই এটা সম্ভব হয়েছে।

গায়ক ব্রেট লি
গায়ক ব্রেট লি

সুপার ফিট থাকতে পেরে আমার গর্বই হয়। মানসিকভাবে ভীষণ শক্ত থাকাটাও খুবই গুরুত্বপূর্ণ। অনেকে খেলাটার ধরন বা প্রেক্ষাপট এড়িয়ে যায়। অবশ্যই আপনার টেকনিক থাকতে হবে। তবে আপনাকে যেতে হবে নানা প্রেক্ষাপটের মধ্য দিয়ে। কাজেই মানসিকভাবে আপনাকে শক্ত থাকতে হবে, খুবই গুরুত্বপূর্ণ এটা। এমনও দিন গেছে ব্যথায় কাতরেছি। নিশ্চয়ই জানেন, আমার পা ভেঙে গিয়েছিল, পায়ের আঙুল ভেঙে গিয়েছিল। ব্যথার মধ্যেও আমাকে এগিয়ে যেতে হয়েছে।

যতবার শচীনকে আউট করেছি, মনে হয়েছে এটাই ক্যারিয়ারের সেরা ডেলিভারি। কীভাবে আউট করলাম সেটি বড় নয়। তাকে আউট করাটা সব সময় দারুণ ব্যাপার ছিল। শোয়েব আখতারের সঙ্গে গতির লড়াইটাও খুব উপভোগ করতাম। ওর সঙ্গে একই ম্যাচে বোলিং করতে ভীষণ ভালো লাগত। সে যেভাবে তেড়েফুঁড়ে বোলিং করত, ভালো লাগত। খেলাটার জন্য সে অসাধারণ এক বোলার ছিল। আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে শোয়েব যখন আমার আগে ঘণ্টায় ১০০ মাইল বোলিংয়ের রেকর্ড গড়ল, চেয়েছিলাম আমিও ১০০ মাইল ছাড়িয়ে যাব।

আমি এখনো দেখতে চাই তরুণ বোলাররা জোরে বল করুক। বিশ্বে মুগ্ধ করার মতো কিছু ফাস্ট বোলার আছে। তবে আমি আরও তরুণ বোলারদের দেখতে চাই, যারা ধারাবাহিক জোরে বোলিং করতে পারে।

স্লেজিংকে আমি বলি ‘গেমসম্যানশিপ’। এখন আমরা মাঠে কোনো বর্ণবাদী আচরণ বা মাত্রাতিরিক্ত বাজে ভাষা প্রয়োগ করতে চাই না। তবে মাঠে আপনাকে আক্রমণাত্মক হতে হবে। হ্যাঁ, এটা নিয়ন্ত্রণ করা হচ্ছে। আমরা কখনো সীমা অতিক্রম করি বটে। তবে মাঠে রোবটও দেখতে চাই না। আপনি ব্যাটসম্যানের দিকে অগ্নিদৃষ্টিতে তাকাতে পারবেন না, বোলারের দিকে তেড়ে যেতে চাইবেন না—দেখতে চাই না একটা রোবট ক্রিকেট খেলছে! ক্রিকেটে আমি আক্রমণাত্মক মেজাজ দেখতে ভালোবাসি। তবে মাত্রাতিরিক্ত কিছু না করাই ভালো।