ধর্ষণের শিকার নারীর টু ফিঙ্গার টেস্ট নিষিদ্ধ, বিশেষজ্ঞদের মতামত

সালমা আলী, মালেকা বানু ও সারা হোসেন
সালমা আলী, মালেকা বানু ও সারা হোসেন
>
ধর্ষণের প্রমাণ অনেকাংশে শারীরিক (ডাক্তারি) পরীক্ষার ওপর নির্ভরশীল। এ জন্য ধর্ষণের শিকার মেয়েটিকে ‘দুই আঙুলি পরীক্ষা’ নামে একটি পরীক্ষার মধ্য দিয়ে যেতে হতো, যা তাঁকে মানসিকভাবে আরও বিপর্যস্ত করে দিত। এটি নারীর জন্য অবমাননাকর। দুই আঙুলের মাধ্যমে ধর্ষণ পরীক্ষা পদ্ধতির বৈধতা চ্যালেঞ্জ করে বাংলাদেশ লিগ্যাল এইড অ্যান্ড সার্ভিসেস ট্রাস্ট-ব্লাস্ট, আইন ও সালিশ কেন্দ্র (আসক), বাংলাদেশ মহিলা পরিষদ, ব্র্যাক, মানুষের জন্য ফাউন্ডেশন, নারীপক্ষসহ দুই চিকিৎসক রিট আবেদনটি করেন। ২০১৩ সালের ৯ অক্টোবর নারী ও শিশুর স্বাস্থ্য পরীক্ষায় তথাকথিত ‘দুই আঙুলি পরীক্ষা’ কেন আইনবহির্ভূত এবং অবৈধ ঘোষণা করা হবে না, তা নিয়ে রুল দেন হাইকোর্ট। রুল দেওয়ার পাশাপাশি এ বিষয়ে একটি নীতিমালা তৈরির নির্দেশ দেন। ২০১৪ সালের মে মাসে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের পক্ষ থেকে এ ব্যাপারে দিকনির্দেশনা তৈরি করা হয়। ১২ এপ্রিল ধর্ষণের শিকার হওয়া নারীদের শারীরিক পরীক্ষা ‘টু ফিঙ্গার টেস্ট’ নিষিদ্ধ করেছেন হাইকোর্ট। হাইকোর্টের বিচারপতি গোবিন্দ চন্দ্র ঠাকুর ও বিচারপতি এ কে এম সহিদুল হক এ রায় দেন।
সালমা আলী
সালমা আলী


দুই আঙুলি পরীক্ষা ভয়ানক অবমাননাকর
সালমা আলী
মানবাধিকার আইনজীবী
পাঁচ বছর ধরে এই রায়ের আইনি প্রক্রিয়া চলছে। আমার মনে হয়, ধর্ষণের মতো মামলা দ্রুত বিচার প্রক্রিয়ায় হওয়া উচিত। কোনো অবস্থাতেই অপরাধীর জামিন দেওয়া যাবে না। দীর্ঘ সময় ধরে হলেও শেষ পর্যন্ত ইতিবাচক একটি রায় পাওয়া গেছে, সেটা ভালো দিক। তবে রায়ের থেকে বেশি জরুরি এর প্রয়োগের প্রক্রিয়া।
ধর্ষণের শিকার হওয়া নারীকে থানা, হাসপাতাল ও আদালতে বারবার বিব্রতকর পরিস্থিতিতে পড়তে হয়। আর এই দুই আঙুলি পরীক্ষা ভয়ানক অবমাননাকর। কোনো মেয়ে আগে যৌন সম্পর্কে ছিলেন কি না, আসলেই ধর্ষণ হয়েছেন কি না, তা এই পরীক্ষার মধ্য দিয়ে প্রমাণিত হয় না আসলে।
ভিত্তিহীন, অবৈজ্ঞানিক একটি বিষয়কে গুরুত্ব দেওয়ার কিছু নেই। মামলা করার সময় থানাগুলো নারীবান্ধব হতে হবে। তা না হলে পরিস্থিতির উন্নতি হবে না। প্রথম আলোকে ধন্যবাদ দিতে হবে। তারা ধর্ষণের পুরো বিষয়টি নিয়ে সিরিজ প্রতিবেদন, গবেষণা প্রকাশ করেই যাচ্ছে। সমাজে বিষয়গুলো নাড়া দেয়। একবার একটা প্রতিবেদন লিখে থেমে যাওয়া যাবে না। এ বিষয়ে কথা বলে যেতেই হবে।

মালেকা বানু
মালেকা বানু


যত দ্রুত সম্ভব এটি প্রয়োগ করতে হবে
মালেকা বানু
সাধারণ সম্পাদক, বাংলাদেশ মহিলা পরিষদ
এই পরীক্ষা নারীর জন্য অপমানজনক, বৈজ্ঞানিকভাবে এটি নির্ভরযোগ্য কোনো পদ্ধতি না। এর ফলে মানুষ হিসেবে লিঙ্গবৈষম্যের শিকার হন নারী। এমনিতেই ধর্ষণের শিকার মেয়েটি মানসিক ট্রমার মধ্য দিয়ে যান। তারপর তাঁকে যদি ধর্ষণের শিকার হয়েছেন কি না প্রমাণ করতে হয়, সেটা খুব কঠিন।
কোন পরিস্থিতিতে ছিলেন, অতীতে কী করছেন সেগুলো বারবার তাঁকে জিজ্ঞাসা করা হয়। নিশ্চয় তিনি ধর্ষণের শিকার হওয়ার সময় সাক্ষী-প্রমাণ রেখে দেননি।
হতবাক পরিস্থিতিতে মেয়েটি কী করবে সেটাই প্রথমে বুঝতে পারে না। সেখানে যদি উল্টো তাঁকে প্রমাণ করতে হয়, তাহলে তা দুঃখজনক। এই আইনি প্রক্রিয়া শুরু হওয়া থেকে নানাজনের সঙ্গে মতপার্থক্য হয়েছে আমাদের।
একধরনের লড়াইয়ের মধ্য দিয়ে গিয়েছি। তবে যেহেতু শেষ পর্যন্ত নিষিদ্ধ হয়েছে, তাই যত দ্রুত সম্ভব এর প্রয়োগ করতে হবে।

সারা হোসেন
সারা হোসেন


এই রায় হওয়ায় সবাই কড়াকড়িভাবে মানবেন
সারা হোসেন
আইনজীবী, বাংলাদেশ লিগ্যাল এইড অ্যান্ড সার্ভিসেস
ট্রাস্ট-ব্লাস্ট
যাঁরা এই রিটের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন, তাঁরা যে সময় দিয়েছেন, তা খুব ইতিবাচক দিক। প্রত্যেকে সময় দিয়ে পর্যালোচনা করেছেন কোনটা ঠিক, কোনটি বেঠিক। আদালত গুরুত্ব দিয়ে দেখেছেন। হাইকোর্ট রুল দেওয়ার পাশাপাশি একটি নীতিমালা তৈরির নির্দেশ দেন।
সেটা মেনে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় চার বছর আগে দিকনির্দেশনা তৈরি করে এবং প্রয়োগের কথা বলে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার এ বিষয়ে যে নীতিমালা আছে, সেটিও যুক্ত করা হয়েছে। স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের নির্দেশনার পরও কোনো কোনো জায়গায় এটি করা হতো। তবে এই রায় হওয়ায় সবাই কড়াকড়িভাবে মানবেন।
এটি ঠিক যে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের এই নির্দেশনার কারণে রায় কিছুটা দ্রুত হয়েছে। বাস্তবায়ন প্রক্রিয়া আরও পরিষ্কার হতে হবে। যাঁরা নারী ও শিশু নির্যাতনের বিচার কাজের সঙ্গে যুক্ত থাকেন, তাঁদেরও প্রশিক্ষণের দরকার আছে। কারও যদি কোনো যৌন ইতিহাস থাকে, তিনি ধর্ষণের শিকার হতে পারেন না, এই ধারণা থেকে বের হতে হবে।