বুকের ভেতর কিছু পাথর নিয়ে

>বাংলাদেশের তরুণেরা মেলে ধরছেন নিজেদের। নানা ক্ষেত্রে তাঁদের প্রতিভা দেশের মধ্যে তো বটেই, দেশের বাইরেও দ্যুতি ছড়াচ্ছে। শোনা যাচ্ছে তারুণ্যের জয়ধ্বনি। প্রতিবছর বাংলা নববর্ষে তরুণ প্রতিভাবানদের নিয়ে বিশেষ সংখ্যা করে ‘ছুটির দিনে’। এবারও ১৪২৫ নতুন বঙ্গাব্দে ‘ছুটির দিনে’ তুলে ধরছে ক্রীড়া, সংগীত, চলচ্চিত্র, টিভি নাটক, আলোকচিত্র, সামাজিক ব্যবসা, স্থাপত্য-নানা ক্ষেত্রের উজ্জ্বল তরুণদের। অগ্রগামী এই তরুণদের জন্য আমাদের শুভকামনা। তাঁদেরই একজন তানভীর আহসান
তানভীর আহসান। ছবি: ছুটির দিনে
তানভীর আহসান। ছবি: ছুটির দিনে

২০০০ সালের শুরু থেকে আমি বেশ কিছু বিজ্ঞাপন নির্মাণ করি। সেই সময় আমার সঙ্গে প্রধান সহকারী হিসেবে বিপুল ও আইরিন কাজ করত। ওই সময়টাতেই পলিটেকনিকে পড়ুয়া এক ছেলে আসে কাজ করতে। বিজ্ঞানের ছাত্র হওয়ার কারণে কিনা জানি না (অন্য কারণও হতে পারে) ছেলেটি বিজ্ঞাপন নির্মাণের চমৎকার সব কারিগরি সমাধান বাতলে দিতে পারত। ফলে তার কাজের প্রতি একটা নির্ভরতা তৈরি হলো প্রথমেই।

বছর কয়েক কাজ করার পর, একদিন চোখে পড়ল—ছোটখাটো এই ছেলেটি কবিতা আর গদ্য লেখাতেও বেশ পারদর্শী। সে সময় খুব যে কথা হতো, তা কিন্তু নয়। তাই ঠিকঠাক জানতে পারিনি ছেলেটাকে। ধীরে ধীরে যখন সে তৃতীয় থেকে দ্বিতীয় এবং ক্রমশ প্রথম সহযোগী হয়ে উঠল, তখনই তাকে আরও গভীরভাবে বোঝার সুযোগ পেলাম।

জানলাম, ছোটখাটো চুপচাপ ছেলেটির সঙ্গে সিনেমার যোগাযোগ অনুভূতির, ভালোবাসার। বুঝতে শুরু করলাম, সিনেমার সঙ্গে সম্পর্কের মূল সুতাটি সে হৃদয়ের গভীরে বেঁধে রেখেছে। কবিতামাখা দৃশ্যকল্প নির্মাণের এক অনবদ্য সম্ভাবনা নিয়ে প্রতিদিন কী দারুণভাবে বেড়ে উঠতে থাকে আমার সহকারী তানভীর আহসান—বিষয়টি আমি একেবারে সরাসরি অভিজ্ঞতা অর্জন করতে থাকলাম।

তানভীরের সঙ্গে কাজ করতে করতে দারুণ সব মিথস্ক্রিয়া ঘটতে থাকে আমাদের মধ্যে। দৃশ্যের চিত্রায়ণ করতে গিয়ে প্রতিটা কাজে আমরা একটু একটু করে আমাদের ভাবনার কাছাকাছি দৃশ্যকাব্য নির্মাণ করতে থাকি। আমার নির্মাণ করা বেশ কিছু উল্লেখযোগ্য বিজ্ঞাপনে—যেমন গ্রামীণফোনের ‘আওলা বাতাস’, অনলাইন স্কুল...ইত্যাদিতে দৃশ্যকল্পের যে কাব্যময়তা প্রকাশ পেতে শুরু করেছিল, তার পেছনে তানভীরের অবদান বেশ গুরুত্বপূর্ণ। তানভীরের উপস্থিতির কারণেই প্রত্যেকটা দৃশ্য ধারণের সময় একটা আবেগী ছোঁয়া স্বতঃস্ফূর্তভাবেই থাকত। ফলে বিজ্ঞাপনগুলো একটা বিশেষ রূপ পেতে শুরু করল। আয়নাবাজি চলচ্চিত্রেও দৃশ্যকল্পের যে আবেশটি তৈরি হয়েছিল; যেসব খুঁটিনাটি অনুষঙ্গের ফলে আয়নাবাজিতে একটা অভিনব গল্প বলার ঢং পাওয়া গিয়েছিল, তার অধিকাংশটাই তানভীরের অবদান। আয়নাবাজির চিত্রনাট্য থেকে শুরু করে লোকেশন খুঁজে বের করা, ছবির লুক বা ছবিটা দেখতে কেমন হবে এবং যাবতীয় বি-রোল শুটিং তানভীর আহসানের করা। দৃশ্য ভাবনার জায়গায় তানভীর এভাবেই আমার প্রাণের সহচর হয়ে উঠল।

তানভীর আহসান ঢাকার পলিটেকনিক ইনস্টিটিউট থেকে তড়িৎ ও ইলেকট্রনিকসে পড়াশোনা সম্পন্ন করেছে। পেশার বদলে বেছে নিল সিনেমা নির্মাণের স্বপ্নকে। মা আর বোনকে নিয়ে ঢাকায় থাকে সে। একা মা হিসেবে এই প্রতিকূল শহরে সন্তানদের বড় করে তোলা বরাবরই কঠিন বিষয়। তানভীরের মা একা একা সেটি করেছেন এবং প্রতি মুহূর্তে তাকে কী অসম্ভব জীবনসংগ্রামের মধ্য দিয়ে যেতে হয়েছে, বলে হয়তো শেষ করা যাবে না। হয়তো বুকের মধ্যে একটা পাথর নিয়ে থাকার মতো। এই পাথর আরও ভারী হয় যখন একা মায়ের সন্তানটি সিনেমা নির্মাণের মতো একটা অনিশ্চিত স্বপ্নপূরণকে জীবনের পাথেয় করে নেয়।

তা ছাড়া তানভীর যেহেতু একটু স্বল্পভাষী এবং নিজের অনুভূতির গল্পটা বলতে গিয়ে জনপ্রিয় ও ঝকমকে চিত্রধারণ থেকে দূরে থাকে; সেহেতু তাকে উচ্চকিতভাবে দেখা যায় না। উচ্চকিতভাবে দেখা যায় না বলেই ঝকমারি বিজ্ঞাপন নির্মাণের জনপ্রিয়তার ভিড়ে তানভীরের জন্য সিনেমাকে উপজীব্য করে জীবনধারণ কঠিনতর আরও এক ধাপ। তাকে তাই তার মতো করে লিপ্ত ভঙ্গিমায় নিজের গল্পটি সাবলীলভাবে বলে যাওয়ার পথ খুঁজে নিতে হয়। সেই পথ খুঁজে নিয়েই সে নির্মাণ করে ‘বুকের ভেতর কিছু পাথর থাকা ভালো’ নামের এক অনবদ্য টিভি ফিকশন। জীবনের গল্পগুলো এভাবে লিপ্ত ভঙ্গিতে, এভাবে মায়াভরা আবেশে দৃশ্যের মধ্য দিয়ে তানভীর আহসান যখন বলতে থাকে, তখন আমাদেরও মনে হয়, আসলেই বুকের ভেতর কিছু পাথর থাকা ভালো। বুকের ভেতর এমন কিছু পাথর নিয়েই একজন তানভীর আহসান আমাদের ঘনিষ্ঠ অনুভূতিগুলোর দৃশ্যকাব্য নির্মাণ করে যাচ্ছে; এবং আমার বিশ্বাস এটা সে করে যাবে।

তানভীর আহসান নামের ছোটখাটো নির্লিপ্ত সেই ছেলেটি আমার কাছে এভাবে তার স্বপ্নের সমান বড় হয়ে উঠতে থাকল, দীর্ঘ হয়ে উঠতে থাকল। খুব গভীরভাবে লক্ষ করলে আমরা দেখব, বাংলাদেশের টেলিভিশন ফিকশনে এভাবে আগে কখনো গল্প বলা হয়নি, অস্থির সময়ে স্বস্তির গল্পে তানভীর তার নিজস্ব ‘অতঁর’ গল্প হাজির করেছিল। তিশাকে দিয়ে নন–অ্যাকটিং করানো, ক্যামেরার সাবজেক্টিভ মুভমেন্ট আর ডাইজেনটিক শব্দের ব্যবহারের মাধ্যমে গল্পের দ্যোতনা তৈরি—সবকিছুই তৈরি করেছে একজন পাকা সিনেমা করিয়ের মতো। মেরিল–প্রথম আলো পুরস্কার যখন সে আমার সঙ্গে মনোনীত হয়ে পুরস্কার পায়, সেই মুহূর্তে সত্যি আমার আনন্দের সীমা ছিল না। তারপর কলকাতা এসভিএফ ওয়েব সিরিজ করার জন্য তারা বাংলাদেশের একজন নির্মাতা চাইলে আমি তানভীরকে পাঠানোর ব্যবস্থা করি। সেখানেও তানভীর চমৎকার এক ১২ পর্বের ওয়েব সিরিজ ‘সিকস’ নির্মাণ করে। যা ভারতে কেন, বাংলাদেশেও ওয়েব সিরিজ করা হয়নি। দুই মাস কাজ করে সেই তানভীর তার যোগ্য পারিশ্রমিকটাও পায়নি। সহজ–সরল তানভীর এক বুক পাথর নিয়ে তার গল্প বলার বাসনা আর বেঁচে থাকার লড়াই করে যাচ্ছে একটা যোগ্য পৃষ্ঠপোষকতার খোঁজে। যদি পেয়ে যায় একজন সৃজনশীল প্রযোজক, যে তার পাথর বহনে হাত বাড়াবে—আমি তো সেই দিনের অপেক্ষা করি, আর প্রাণ ভরে ভালোবাসি তানভীরকে।

লেখক: বিজ্ঞাপন ও চলচ্চিত্রনির্মাতা