পাখির প্রেমে জেনিফার

জেনিফার আজমিরী। পাখির কষ্ট তাঁকে ভাবায়।  ছবি: সংগৃহীত
জেনিফার আজমিরী। পাখির কষ্ট তাঁকে ভাবায়। ছবি: সংগৃহীত

জনমানবহীন দ্বীপে রাত নামে। একলা তাঁবুতে। শিয়াল এত কাছে আসে, নিশ্বাসও শোনা যায়। মেয়েটির মাথায় পাখির ভাবনা। শিয়ালকে আমলে নেন না। ঘুম থেকে উঠে ছোটেন নতুন পাখির খোঁজে। হাঁটেন জোয়ার-ভাটার কাদার ভেতরে। ঘুটঘুটে অন্ধকারে ডিঙিতে বসে জালে আটকানো পাখি ছাড়াতে ছাড়াতে ডুবতে গিয়ে ভেসে ওঠেন। সবই করেন বন্য প্রাণীদের প্রতি ভালোবাসা থেকে। বছরের ছয় মাসের বেশি সময়—কখনো দামার চর, কখনো নিঝুম দ্বীপ, পঞ্চগড়, রাজশাহীর চর, লাউয়াছড়া, টাঙ্গুয়া, হাকালুকি হাওর, আবার কখনো নাগাল্যান্ডে ‘হর্নবিল ফেস্টিভ্যালে’—ছুটতে ছুটতে এখন কাজটা তাঁর নেশা থেকে পেশায় গিয়ে দাঁড়িয়েছে। তিনি এখন আন্তর্জাতিক প্রকৃতি ও প্রাকৃতিক সম্পদ সংরক্ষণ সংঘের (আইইউসিএন) প্রকল্প সহকারী। এ পর্যন্ত পাখি দেখেছেন ৩৫০টির বেশি। নেটিং করেছেন প্রায় দেড় হাজার। মেয়েটির নাম জেনিফার আজমিরী। দেশে তাঁর মতো আরও কয়েকজন মেয়ে পাখির ভালোবাসা থেকে এই কাজে জড়িয়েছেন।

জেনিফার আজমিরীর সঙ্গে প্রথম পরিচয় হয় রাজশাহী চিড়িয়াখানায় একটি ঘড়িয়াল অবমুক্ত করার সময়। রাজশাহীর নিঃসঙ্গ মেয়ে ঘড়িয়ালটার জন্য বন বিভাগের সহযোগিতায় তাঁরা ঢাকা চিড়িয়াখানা থেকে একটি ছেলে সঙ্গী নিয়ে এসেছিলেন। গত মার্চ মাসে দিনাজপুরের শালবনে কথা হয় তাঁর সঙ্গে। সেখানে তাঁরা আহত শকুনের শুশ্রূষা করে সুস্থ হলে আকাশে উড়িয়ে দিচ্ছিলেন। সেখানেই পাখিসহ বন্য প্রাণীর প্রেমে পড়ার গল্পটি শোনান তিনি।

জেনিফার আজমিরীর বাড়ি গাজীপুরে। জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় থেকে প্রাণিবিদ্যায় পড়াশোনা করেছেন। বাবা ছিলেন ব্যাংক কর্মকর্তা। মা শিক্ষক। ছোটবেলায় পরিবারের সবার স্বপ্ন ছিল মেয়ে চিকিৎসক হবে, কিন্তু পড়তে হলো প্রাণিবিদ্যায়। অবশ্য বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হওয়ার পরই জেনিফারের স্বপ্ন বদলে যায়। পাখি নিয়ে নতুন স্বপ্ন শুরু হয়। তাঁর ভাষায়, ‘এমনিতেই ছোটবেলায় গ্রামে গেলে খুব বনে-বাদাড়ে ঘুরে বেড়াতাম। বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়তে গিয়ে ওরিয়েন্টেশন ক্লাসেই বুঝে গিয়েছিলাম আমাকে কী নিয়ে পড়তে হবে। আমাদের বিভাগে তিনটি শাখায় স্নাতকোত্তর করানো হয়। মাৎস্যবিদ্যা, পতঙ্গবিদ্যা ও বন্য প্রাণী সংরক্ষণ—যেকোনো একটিকে বেছে নিতে হয়। আমি চোখ বন্ধ করে বন্য প্রাণী নিয়ে কাজ করার স্বপ্ন দেখে ফেললাম।’

কাকতালীয়ভাবে এক সহপাঠীর সঙ্গে নর্থ সাউথ বিশ্ববিদ্যালয়ে পাখি চেনা প্রতিযোগিতায় অংশ নেন জেনিফার। পাঁচটি দল। এর মধ্যে একটি দলে তাঁরা দুজনেই শুধু মেয়ে। বিচারক ছিলেন পাখি বিশারদ ইনাম আল হক। তাঁদের দল রানার্স আপ হলো। ইনাম আল হক তাঁদের বাংলাদেশ বার্ড ক্লাবে আমন্ত্রণ জানালেন। ২০১২ সাল থেকে ক্লাবের হয়ে পাখি দেখা, পাখির পায়ে রিং পরানোর কাজ এখন তাঁর নেশা থেকে পেশায় পরিণত হয়েছে। এই কাজ করতে গিয়েই ২০১৫ সালে আইইউসিএনে যোগ দেন।

কাজের অভিজ্ঞতার কথা বলতে গিয়ে জেনিফার বলেন, গবেষণার জন্য জাল পেতে পাখি ধরতে হয়। পায়ে রিং পরিয়ে ছেড়ে দিতে হয়। এর মাধ্যমে পাখির আবাসস্থল জানা যায়। এই গবেষণা পরবর্তী সময়ে পাখিদের নিরাপত্তার ব্যবস্থায় কাজে দেয়।

এই রোমাঞ্চকর কাজ করতে গিয়ে একবার বনের ভেতরে ঝড়ের কবলে পড়ে পাহাড়ি ছড়ায় ডুবতে বসেছিলেন। লাউয়াছড়ায় পাখি খুঁজতে গিয়ে একবার ট্রেনের নিচে পড়তে গিয়ে বেঁচে যান। জেনিফার বলেন, ‘নতুন একটা প্রাণীর দেখা পেলে এসব আর কিছুই মনে থাকে না। মনে হয়, আমি হিমালয় জয় করে ফেলেছি। আর সব প্রাণীর পর্যবেক্ষণ করতে কখনোই মনে ক্লান্তি আসে না। বোবা প্রাণীদের অনুভূতিটা বুঝতে পারা যে কী আনন্দের!’

তবে সব এলাকার মানুষ তাঁকে যে খুব সাদরে গ্রহণ করেন, তা কিন্তু নয়। এ নিয়ে তাঁর তিক্ত অভিজ্ঞতাও রয়েছে। উপস্থিত বুদ্ধি দিয়ে তিনি তা কাটিয়ে ওঠেন। একবার এক প্রত্যন্ত এলাকায় পাখি নিয়ে কাজ করতে গেছেন। স্থানীয় লোকজন আপত্তি তোলেন। ওই এলাকায় কাজ করতে বারণ করেন। জেনিফার তাঁদের বোঝাতে সক্ষম হন। শেষ পর্যন্ত সেই এলাকাবাসী তাঁর দৃঢ়তার কাছে নমনীয় হয়েছেন। জেনিফার বলেন, তিনি যদি সেদিন সেই এলাকা থেকে ফিরে আসতেন, তাহলে আর কোনো মেয়ে ওই এলাকায় পাখি নিয়ে কাজ করতে যেতে পারতেন না। তাঁদেরও একই কথা শুনতে হতো। এ ঘটনার তিন বছর পার হয়ে গেছে। তিনি খোঁজ নিয়ে জেনেছেন, এখন অন্য মেয়েরাও স্বচ্ছন্দে ওই এলাকায় কাজ করছেন।

জেনিফারের ভাষায়, ‘খুব খারাপ লাগে যখন দেখি কেউ কেউ বন্য প্রাণীর জন্য এক রত্তি জায়গাও সংরক্ষণ করতে চান না। অল্প কিছু হলেও ভালো মানুষ আছেন। ইসরাত আপু, লিপি আপু, সহপাঠী মিলাসহ আরও অনেকে আমার মতো এই বন্য প্রাণী নিয়ে কাজ করছেন। তাঁদের দেখেই উৎসাহ পাই।’

যেখানে বন্য প্রাণী আছে, সেখানেই জেনিফার যেতে চান। গহিন বনের গভীরতাও তাঁকে টানে।