প্রতিরোধেই প্রতিকার

ময়মনসিংহের ত্রিশালে মেয়েদের এমন ‘ব্রিগেড’ ঠেকিয়েছে অনেক বাল্যবিবাহ। ছবি: প্রথম আলো
ময়মনসিংহের ত্রিশালে মেয়েদের এমন ‘ব্রিগেড’ ঠেকিয়েছে অনেক বাল্যবিবাহ। ছবি: প্রথম আলো

বাল্যবিবাহ প্রতিরোধের বছরভিত্তিক যে সংখ্যা তা কমছে। প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের গভর্ন্যান্স ইনোভেশন ইউনিট (জিআইইউ) বলছে, দেশে বাল্যবিবাহ কম হচ্ছে বলেই প্রতিরোধের সংখ্যাও কমছে।

জিআইইউর তথ্য বলছে, দেশে ২০১৩ সালে ৩ হাজার ২৬৬টি বাল্যবিবাহ প্রতিরোধ করা হয়। তবে এর পরের বছর সংখ্যাটি গিয়ে দাঁড়ায় ১৩ হাজার ৩৩৪টিতে। ২০১৫ সালে তা আরও বেড়ে হয় ১৫ হাজার ৭৭৫টি। কিন্তু তারপরই আবার সংখ্যা কমতে শুরু করে। ২০১৬ সালে ৬ হাজার ৩৮৯টি এবং গত বছর সংখ্যাটি দাঁড়ায় ৫ হাজার ৪৬৩টিতে।

জিআইইউর পরিচালক ড. ইসমাত মাহমুদা প্রথম আলোকে বলেন, ‘২০১৩ সাল থেকে জিআইইউ উদ্ভাবনী উপায়ে বাল্যবিবাহ প্রতিরোধের কাজ শুরু করে। স্কুলশিক্ষক, ইমাম, পুরোহিতসহ যে ব্যক্তিরা মৌখিকভাবে বিয়ে পড়ানোর কাজ করেন (পরে আর নিবন্ধন করানো হয় না), সে ধরনের ৬৫ হাজার ব্যক্তির ডেটাবেইস তৈরি এবং তাঁদের প্রশিক্ষণের আওতায় আনার কাজটি হয়েছে গত বছর পর্যন্ত। কাজ শুরুর প্রথম বছর বাল্যবিবাহ প্রতিরোধের সংখ্যাটা একটু কম ছিল। তবে পরের বছরই কার্যক্রম জোরদার করা, সচেতনতা বাড়ানোর ফলে বাল্যবিবাহ প্রতিরোধের সংখ্যাটা অনেক বেড়ে যায়। তার পরের বছরও এ ধারা অব্যাহত থাকে। এরপর দেশে বাল্যবিবাহের সংখ্যা কমতে থাকে আর বাল্যবিবাহ প্রতিরোধের সংখ্যাটিও কমতে থাকে। আমরা মনে করছি, বাল্যবিবাহের সংখ্যা কম হচ্ছে বলেই প্রতিরোধের সংখ্যাটাও কমছে।’

ইসমাত মাহমুদা জানান, জিআইইউ বর্তমানে বিভাগ ধরে ধরে বিভিন্ন কার্যক্রম পরিচালনা করছে। গত বছর রাজশাহীর পর বর্তমানে বরিশাল বিভাগে বিভিন্ন কার্যক্রম পরিচালনা করা হচ্ছে।

জিআইইউর তথ্য বলছে, গত বছর ঢাকা বিভাগে বাল্যবিবাহ প্রতিরোধ করা হয় ৭৮৮টি। চট্টগ্রাম বিভাগে ৮৩৪টি, রাজশাহীতে ১ হাজার ১৮০, খুলনায় ৬৯০, বরিশালে ২৯৭, সিলেটে ২৯৬, রংপুরে ৯৫৪ ও ময়মনসিংহে ৪২৪টি বাল্যবিবাহ প্রতিরোধ করা হয়। হিসাব অনুযায়ী, সব থেকে বেশি বাল্যবিবাহ প্রতিরোধ করা হয় রাজশাহীতে।

শরীয়তপুরের এই কিশোরীরাই ঠেকিয়ে দেয় বাল্যবিবাহ। ছবি: প্রথম আলো
শরীয়তপুরের এই কিশোরীরাই ঠেকিয়ে দেয় বাল্যবিবাহ। ছবি: প্রথম আলো

মহিলা ও শিশুবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের প্রতিমন্ত্রী এবং সচিবও দেশে বাল্যবিবাহের সংখ্যা কমছে, তা বারবার উল্লেখ করছেন বিভিন্ন অনুষ্ঠানে। গত বছরের ৩১ জুলাই রাজধানীতে একটি হোটেলে ‘বাল্যবিবাহ রুখতে হলে আওয়াজ তোলো তালে তালে’ স্লোগান নিয়ে এক প্রচারাভিযানের উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে প্রতিমন্ত্রী মেহের আফরোজ চুমকি বলেছেন, ২০১৫ সালে দেশে ১৫ বছর বয়সের নিচে বাল্যবিবাহের হার ছিল ২৩ দশমিক ৮ শতাংশ, তা কমে ২০১৭ সালে হয়েছে ১০ দশমিক ৭৮ শতাংশ। আর ১৮ বছরের নিচে বাল্যবিবাহের হার ২০১৫ সালে ছিল ৬২ দশমিক ৮ শতাংশ, তা কমে ২০১৭ সালে হয়েছে ৪৭ শতাংশ।

মহিলা ও শিশুবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের বাল্যবিবাহবিরোধী ক্যাম্পেইনের আওতায় ‘আওয়াজ তোল’ বিভিন্ন টেলিভিশনে প্রচারিত বিজ্ঞাপনচিত্রটি ‘এপেক ইফি অ্যাওয়ার্ড ২০১৮’ পেয়েছে। গত ২৭ এপ্রিল সিঙ্গাপুরের ফোর সিজন হোটেলে এপেক (এশিয়া প্যাসিফিক) এই অ্যাওয়ার্ড ঘোষণা করে। ১৯০টি পাবলিক সার্ভিস অ্যানাউন্সমেন্ট এই প্রতিযোগিতায় অংশ নেয়। গোল্ড, সিলভার ও মেটাল-এই তিনটি ক্যাটাগরিতে এই অ্যাওয়ার্ড দেওয়া হয়। আওয়াজ তোল ক্যাম্পেইনটি সিলভার অ্যাওয়ার্ড পেয়েছে।

 গত ৯ ফেব্রুয়ারি প্রথম আলোর প্রতিবেদন অনুযায়ী, নেত্রকোনার বারহাট্টা উপজেলা প্রশাসনের হস্তক্ষেপে স্কুল থেকে ঝরে পড়া এক ছাত্রীর বাল্যবিবাহ বন্ধ করা হয়। পরে ১৩ বছর বয়সী সেই ছাত্রীর লেখাপড়া ও ভরণপোষণের দায়িত্ব নেন উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) ফরিদা ইয়াসমিন।

এ নিয়ে প্রতিবেদন প্রকাশের পর ১৫ দিনে নেত্রকোনার বারহাট্টা, কলমাকান্দা, কেন্দুয়া, খালিয়াজুরী ও সদর উপজেলায় অন্তত ১০টি বাল্যবিবাহ বন্ধ করেন ইউএনওরা।

 গত ১৬ মার্চ প্রথম আলোর কুষ্টিয়া ও মাগুরা প্রতিনিধির পাঠানো তথ্য দিয়ে প্রকাশিত প্রতিবেদন বলছে, প্রশাসনের হস্তক্ষেপে ছয়টি বাল্যবিবাহ বন্ধ করা হয়। প্রকাশিত প্রতিবেদন অনুযায়ী, কুষ্টিয়ার ভেড়ামারা উপজেলার উত্তর ভবানীপুর গ্রামে মাত্র ২০০ গজের ব্যবধানে তিনটি বাড়িতে চলছিল বিয়ের আয়োজন। তিনটি বাড়িতেই তিন ছাত্রী বিয়ের পাত্রী। এদের মধ্যে একজন সপ্তম, একজন অষ্টম শ্রেণিতে পড়ে। অন্যজন সদ্য এসএসসি পরীক্ষা দিয়েছে। সকাল থেকে চলছিল রান্নার কাজ। বিয়ের গেট-প্যান্ডেলও করা হয়েছে। শুধু বর আসার অপেক্ষা। কিন্তু বর আসার আগেই তিন বাড়িতে হাজির হন ভেড়ামারার সহকারী কমিশনার (ভূমি) মো. রাসেল মিয়া। সঙ্গে ছিল ভেড়ামারা থানার পুলিশ।

 অন্যদিকে মাগুরায়ও ঘটে এমন তিনটি বাল্যবিবাহ বন্ধের ঘটনা। সেখানকার পাত্রীদের একজন সপ্তম শ্রেণির; অন্য দুজন সবে এসএসসি পরীক্ষা শেষ করেছে। এদের মধ্যে প্রথমজনের বাড়ি মাগুরা পৌর এলাকায়। অন্য দুজনের বাড়ি ঘোড়ানাছ গ্রামে প্রায় পাশাপাশি। মাগুরায় তিনটি বাল্যবিবাহ বন্ধ করে দেন উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা আবু সুফিয়ান। ১৮ বছর বয়স হওয়ার আগে মেয়েদের বিয়ে দেবে না-এমন মুচলেকা নেওয়া হয় পরিবারগুলোর পক্ষ থেকে। পাশাপাশি পরিবারগুলো বলছে, তারা এখন থেকে নিয়মিত তাদের সন্তানদের স্কুলে পাঠাবে। উপজেলা প্রশাসন সূত্রে জানা যায়, এই তিন ছাত্রীর মধ্যে দুজনের বাবার আর্থিক অবস্থা বেশ ভালো। সে হিসেবে তাদের বিয়ের আয়োজনও ছিল ধুমধামের সঙ্গে। ১৭ মে প্রথম আলোতে প্রকাশিত খবরের শিরোনাম ‘১৮টি কিশোরী ব্রিগেডে বাল্যবিবাহমুক্ত ত্রিশাল’। খবরে প্রকাশ, গত ছয় মাসে কিশোরীরা ৬৫টি বাল্যবিবাহ বন্ধ করেছে।

জিআইইউসহ বিভিন্ন সংস্থা ও সংগঠন বাল্যবিবাহের তথ্য সংরক্ষণ করছে-বিষয়টিকে ইতিবাচক উদ্যোগ হিসেবে উল্লেখ করেন তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সাবেক উপদেষ্টা রাশেদা কে চৌধূরী। তবে তিনি প্রথম আলোকে বলেন, দেশে কতগুলো বাল্যবিবাহ হয়ে যাচ্ছে, কোন কোন এলাকায় প্রতিরোধ করা সম্ভব হলো আর কোন কোন এলাকায় প্রতিরোধ করা সম্ভব হলো না, তা নিয়ে একটি ম্যাপিং করতে হবে এবং সে অনুযায়ী কাজ করতে হবে। কিছু পদক্ষেপ কার্যকর করা গেলে এবং প্রশাসনের সদিচ্ছা থাকলে বাল্যবিবাহ প্রতিরোধ করা সম্ভব।

রাশেদা কে চৌধূরীর মতে, বর্তমানে ‘নাইট ম্যারেজ’, চলন্ত নৌকা বা মাইক্রোবাসে বিয়ে হচ্ছে বলেও শোনা যাচ্ছে। তাই প্রশাসনের বিভিন্ন তৎপরতা থেমে গেলে সবার চোখের আড়ালে নিয়ে মেয়েটিকে বিয়ের পিঁড়িতে বসতে বাধ্য করা হচ্ছে কি না, তাও নজরদারি করতে হবে।

বাল্যবিবাহ ঠেকাতে কিশোরীদের নিজেদের ও প্রশাসনের উদ্যোগ অবশ্যই প্রশংসনীয়। একটা মেয়ে আবার নতুন করে বাঁচে। তবে রাশেদা কে চৌধূরীর কথার সুর ধরে বলা যায়, নজরদারি বন্ধ করা যাবে না। রাতের অন্ধকারে একটা মেয়ের জীবন যেন থেমে না যায়!