সন্তান রেখে বাইরে পড়তে যান যখন মা

>

পেশাগত কারণে অনেক নারীকে পাড়ি জমাতে হয় বিদেশে। কিন্তু সন্তান-সংসারের বাস্তবতায় অনেকে পিছিয়েও যান। কেউ কেউ আবার সে সুযোগ নেন, পাথরচাপা কষ্ট নিয়ে সন্তান রেখে চলে যান উচ্চশিক্ষার জন্য। প্রশিক্ষণের জন্য। এমন দুজন, একজন শিশু হৃদ্‌রোগ বিশেষজ্ঞ তাহেরা নাজরিন ও ক্যানসার বিশেষজ্ঞ রাহনূমা পারভীন। তাঁদের সঙ্গে কথা বলে লিখেছেন দিলরুবা শারমিন

তাহেরা নাজরিন
তাহেরা নাজরিন

আড়াই বছরে নিজের বাচ্চাদের দেখেছেন চার দিন

‘বাচ্চাদের রেখে যাওয়ার পর কিছুতেই কাজে মন দিতে পারছিলাম না। প্রথম তিন মাস আমি ঠিকমতো ঘুমাতে পারিনি। ঘুমের মধ্যে মনে হতো ওদের খাইয়ে দিচ্ছি। এরপর ঠিক করলাম, আমাকে শক্ত হতে হবে। ওদের দেখলে ঠিক থাকতে পারব না বলে স্কাইপে কথা বন্ধ করে দিলাম। তবে দিন শেষে ফোনে বাচ্চাদের সঙ্গে কিছুক্ষণ কথা বলতাম। প্রচণ্ড মানসিক যন্ত্রণা নিয়ে নিজেকে শক্ত করে পড়ালেখা করেছি। প্রায় আড়াইটা বছর আমি বহু রোগীর জীবন বাঁচিয়েছি, কিন্তু আমার নিজের বাচ্চাদের দেখেছি মাত্র চার দিন।’

কথাগুলো বলতে বলতে কণ্ঠ ভারী হয়ে এল শিশু হৃদ্‌রোগ বিশেষজ্ঞ তাহেরা নাজরিনের। বাচ্চাদের জীবন বাঁচিয়ে শত শত মায়ের কান্না থামানো মা নিজেই কাঁদছেন। ফোনের ওপাশে স্পষ্ট কান্নার শব্দ শুনি। কাঁদতে কাঁদতেই বললেন, ‘পড়তে যাওয়ার সময় আমাকে সব থেকে বেশি সহায়তা করেছেন আমার শাশুড়ি।’

বর্তমানে একটি বেসরকারি হাসপাতালে তিনি ইন্টারভেনশনাল পেডিয়াট্রিক কার্ডিওলজিস্ট হিসেবে কাজ করছেন। ২০১১ সালে তাহেরা নাজরিন যখন ভারতের নারায়ণা হৃদয়ালয়া হাসপাতালে পড়তে যান, তাঁর বড় মেয়ে সৈয়দা শেহেজাদী হাবীব তখন ষষ্ঠ শ্রেণিতে পড়ে। ছেলে সৈয়দ সারজীল হাবীব এক বছরের ছোট, পড়ত পঞ্চম শ্রেণিতে। পেশাগত কারণে এমনিতেই ব্যস্ত থাকতেন। কিন্তু সন্তানদের সঙ্গে তাঁর সম্পর্ক ছিল অন্য রকম। ছেলেটা ছিল মায়ের নেওটা। প্রতিদিন না খেয়ে, না ঘুমিয়ে বসে থাকত। বাড়ি ফিরে ছেলেকে খাইয়ে দিত, নানা গল্প বলে ঘুম পড়াতেন।

জানতে চাইলাম, কার কাছ থেকে পেয়েছেন এত শক্তি? বললেন, ‘মা সৈয়দা নাসিমা হায়দার। তিনি কর্মজীবী ছিলেন। তাঁকে দেখে শিখেছি অনেক কিছু। আর শাশুড়ি, স্বামী তো পাশে ছিলই।’ ততক্ষণে জেনে গেছি বাংলাদেশে সব মিলে ২০ জনও ইন্টারভেনশনাল পেডিয়াট্রিক কার্ডিওলজিস্ট নেই। কষ্ট না করলে তাহেরা নাজরিন আজ এমন পেশায় নিজেকে যুক্ত করতে পারতেন কি আদৌ?

স্যার সলিমুল্লাহ মেডিকেল কলেজ থেকে এমবিবিএস করেন তাহেরা নাজরিন। এরপর ভারতে নারায়ণা হৃদয়ালয়া হাসপাতালে পড়াশোনার ফাঁকেই রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ইন্টারন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অব কার্ডিয়াক সায়েন্স, নারায়ণা মাল্টিস্পেশালিটি হাসপাতাল থেকে ক্লিনিক্যাল এবং ইন্টারভেনশনাল পেডিয়াট্রিক কার্ডিওলজিতে ফেলোশিপ সম্পন্ন করেন। এ ছাড়া ন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি হাসপাতাল সিঙ্গাপুর থেকে পেডিয়াট্রিক কার্ডিওলজিতে উন্নত ফেলোশিপ লাভ করেন।

নিজের সন্তানদের দূরে রেখে উচ্চশিক্ষা নিতে গিয়ে যে কষ্ট পেতেন মা তাহেরা আজ অন্যের সন্তানের জীবন বাঁচিয়ে তা যেন পুষিয়ে দিচ্ছেন।

রাহনূমা পারভীন
রাহনূমা পারভীন

‘ছেলে বুঝে গেল মা অনেক দিন থাকবে না’

এমবিবিএস পাস করার পর মেডিসিনে এফসিপিএস করেছেন। কাজ করতে করতে মনে হলো, ক্যানসার নিয়ে পড়াশোনার। আবেদন করলেন সিঙ্গাপুরের ন্যাশনাল ক্যানসার সেন্টারে। অনলাইনে পরীক্ষা দিয়ে পেয়ে গেলেন শেখার সুযোগ।

সময়টা জুলাই ২০১৫। একমাত্র ছেলে মুহতাসিম নাসিফ রাহিল তখন ক্লাস থ্রিতে পড়ে। একদিকে উচ্চতর ডিগ্রি নিয়ে দেশের সেবা করার সুযোগ, অন্যদিকে নিজের ছোট্ট একটা বাচ্চা।

সে সময়ের কথা বলতে গিয়ে কাঁদলেন এই মা। কান্নাজড়ানো কণ্ঠে জানালেন, ‘কাজের জন্য আমি ছেলেকে খুব সময় দিতে পারতাম তা না। ছেলেটা আমার শাশুড়ির কাছেই থাকত বেশির ভাগ সময়। কিন্তু দিন শেষে দেখা তো হতো। স্বামী ডা. মোহাম্মদ মুরাদ হোসেনও সরকারি চাকরি করেন। দেশের বাইরে যাওয়ার সময় ছেলে বুঝে গেল মা অনেক দিন থাকবে না। ছেলেটা প্রথম দিকে খুব কান্নাকাটি করল। এরপর একবারের জন্যও না। এমনকি বিমানবন্দরেও সে একবার কাঁদেনি। আমি বুঝতে পারছিলাম ভেতরটা ভেঙে যাচ্ছে ওর। পুরোটা পথ আমি কেঁদেছি। ওকে ছেড়ে আসার কষ্টে। কিন্তু সে আমাকে তার কান্না দেখায়নি।’

রাহনূমা পারভীন এক বছর মেডিকেল অনকোলজিতে হাতেকলমে প্রশিক্ষণ নেন। সিঙ্গাপুর জেনারেল হাসপাতালে রেজিস্ট্রার হিসেবে কাজ করেন। সেখানে প্যালিয়েটিভ মেডিসিনেও প্রশিক্ষণ নিয়েছেন।

মহাখালী জাতীয় ক্যানসার গবেষণা ইনস্টিটিউটে থাকাকালে বিভিন্ন ধরনের গবেষণার কাজে জড়িত ছিলেন। এখনো ক্যানসার নিয়েই কাজ করে যাচ্ছেন। নিয়মিত ক্যানসারের রোগী দেখা, ফ্রি কনসাল্টেশন ও ট্রেনিং দিচ্ছেন শান্তি ক্যানসার ফাউন্ডেশনে। সম্প্রতি তাঁর একটি গবেষণাপত্রও ছাপা হয়েছে ইউরোপিয়ান সোসাইটি ফর মেডিকেল অনকোলজির জার্নালে।

 দেশের সুবিধাবঞ্চিত মানুষের জন্য কিছু করতে চাই। প্রশিক্ষণের পর আমি আবেদন করেছি ক্যানসার হাসপাতাল বা ক্যানসার-সংক্রান্ত কোথাও যেন আমাকে পোস্টিং দেওয়া হয়। ছোট্ট ছেলেটাকে রেখে বুকে কষ্ট চেপে দেশের বাইরে থেকে প্রশিক্ষণ নিয়ে তা যদি সাধারণ মানুষের সেবাতেই কাজে না লাগাতে পারি, তাহলে আর এই শিক্ষা কেন?