রুহিতপুরের জমিলা

রুহিতপুরের জমিলা লুঙ্গি বুনছেন।  ছবি: প্রথম আলো
রুহিতপুরের জমিলা লুঙ্গি বুনছেন। ছবি: প্রথম আলো

লক্ষ্য এখন একটাই, মেজো মেয়ে হালিমাকে বিয়ে দেওয়া। সে জন্য টাকা জমাচ্ছেন জমিলা। অষ্টম শ্রেণি পর্যন্ত পড়ে মেয়েটা স্কুল ছেড়েছে। ইংরেজিতে ফেল করার পর মা জমিলা অবশ্য আবার মেয়েকে স্কুলে ভর্তি হতে বলেছিলেন। কিন্তু মেয়ে রাজি হয়নি। এমনিতেই সে একটু লম্বা, তার ওপর ছোটদের সঙ্গে একই ক্লাসে পড়তে তার ‘শরম’ করে। তাই পড়া বন্ধ করে দিয়েছে। বয়স এখন আঠারো ছুঁই ছুঁই।

বড় মেয়ে রহিমার বিয়ে হয়েছে রুহিতপুরের নারায়ণপট্টির কাছেই। বাচ্চাও হয়েছে কিছুদিন আগে। মধ্যপ্রাচ্য থেকে জমিলার জামাই (রহিমার স্বামী) টাকা পাঠান। সংসার খারাপ চলছে না। এই মেয়ের বিয়ের সময় তাঁর মামারা সাহায্য করেছিলেন। জমিলার তিন ভাই মধ্যপ্রাচ্যে চাকরি করেন। তাঁর স্বামী আবদুর রহিমকে সেখানে নিয়ে গিয়েছিলেন তাঁরা। স্বামীর কপাল মন্দ, মালিক পাগল হয়ে গেল। আর কোনো কাজের সুযোগ হলো না, ফিরে আসতে হলো দেশে। কিছুদিন আগেও রুহিতপুরে ভ্যান চালাতেন তিনি, এখন বয়নকর্মী। ঘরের কাছেই তাঁত। জমিলা হানায় সুতা প্রস্তুত করে দেন, আবদুর রহিম বো নামের হাত-যন্ত্রে সেটিকে প্রস্তুত করেন তাঁতের জন্য।

 ঢাকার কেরানীগঞ্জ উপজেলার রুহিতপুর তাঁতিদের অঞ্চল। রুহিতপুরের লুঙ্গির খ্যাতি সারা দেশেই। এখানকার তাঁতিদের হাতে তৈরির পর লুঙ্গিগুলো বিভিন্ন নামে বাজারে ছড়িয়ে পড়ে। লুঙ্গির জন্য প্রথমে কিনতে হয় সুতা। সেই সুতায় মাড় দেওয়া ও রং করার পর শুকাতে হয়। মাড় দেওয়ার কাজটি যাঁরা করেন, দুই ঘণ্টার জন্য তাঁদের দিতে হয় ২০০ টাকা করে। এর পর হানা নামের একটি কাঠামোয় সেই সুতা পরানো হয়। চুলের সমান সূক্ষ্ম ফাঁক গলিয়ে ৫৪ ইঞ্চি দৈর্ঘ্যের সেই কাঠামোয় সুতা পরাতে সময় লাগে দেড় থেকে ২ ঘণ্টা। হানায় সুতা প্রবেশ করিয়ে বো নামের হাত-যন্ত্রের জন্য প্রস্তুত করা হয়। এ কাজগুলো চুক্তিভিত্তিক। মজুরি ৪০ থেকে ৪৫ টাকা। একটি কাজ মানে একটি থান। যাঁর যখন সংসারের কাজ কম থাকে, তখন তিনি এই কাজ নেন। রুহিতপুরের তাঁতের রমরমা অবস্থা এখন অবশ্য নেই। এখন তাঁত মোটে আছে দশটা। এসব কাজের প্রায় অর্ধেকই করেন নারীরা।

রুহিতপুরের জমিলা কাজ করে যাচ্ছেন। টাকা জমাচ্ছেন। সুতার সঙ্গে সখ্য তাঁর শৈশব থেকেই। লুঙ্গি বয়নে তাঁর মতো অনেক নারীই কাজ করছেন। যেমন তাঁর দুই জা। তাঁত বসানোর খরচ তেমন নয়। কিন্তু জমিলারা সেই ঝামেলা নিতে চান না। যে কাজটুকু করছেন, তাতেই তাঁর চলে যাচ্ছে। সপ্তাহে ৮০০ থেকে ১ হাজার টাকা আসে। স্বামী-সন্তান নিয়ে খারাপ নেই তিনি। তাঁর মেয়েরা বিনা মূল্যে পড়েছে, ছোট ছেলে রনির খরচ নিয়ে ভাবনা কম। ষষ্ঠ শ্রেণির রনিকে স্কুলে যাওয়ার সময় বিশ টাকা করে দিলে সে খুশি। এখন মেজো মেয়ে হালিমার বিয়ে হয়ে গেলে জমিলার আর কোনো চিন্তা নেই।