এবার হাইতির ঈদ মিস করব

যখন মিশনে। ছবি: সংগৃহীত
যখন মিশনে। ছবি: সংগৃহীত

পেশাগত কারণে অনেকে পরিবার পরিজন ছেড়ে দূরে ঈদ উদ্‌যাপন করেন। জাতিসংঘের শান্তিরক্ষা মিশনের সদস্য হয়ে হাইতিতে গত বছর ঈদ পালন করেছেন মাহফুজা আক্তার। তিনি লিখেছেন সেই অভিজ্ঞতা।

জীবন থেমে থাকে না। তা চলে যায় জীবনের গতিতে। দেশের ডাকে সাড়া দিয়ে পরিবার-পরিজন ছেড়ে একা একা ঈদ করতে হয়েছিল ক্যারিবীয় অঞ্চলের দেশ হাইতিতে। দেশের বাইরে ঈদ একেবারেই অন্য রকম। খুব খারাপ লাগছিল পরিবার-পরিজনের জন্য। পরিবারের সঙ্গে ঈদ করার মজাই আলাদা।

২০১৭ সালের জুন মাস। আমি তখন হাইতি মিশনে কর্মরত। হাইতি বাংলাদেশ থেকে সাত সমুদ্র তেরো নদী পেরিয়ে পৃথিবীর ওই মাথার একটি দেশ।
দেশের ভাবমূর্তি উজ্জ্বল ও সমুন্নত রাখতে আমরা ১৪০ জনের একটি ‘মিনি বাংলাদেশ’ পরিবার হাইতির মাটিতে ঈদ উদ্‌যাপন করেছিলাম। এটি একদিকে যেমন আনন্দের, অন্যদিকে বেদনার। পরিবার-পরিজন, স্বামী-সন্তান রেখে বিদেশের মাটিতে ঈদ করা খুবই বেদনাদায়ক। আমার ছেলেকে খুব মিস করতাম। সেও আমাকে খুব মিস করত। বাংলাদেশ থেকে হাইতিতে সময়ের পার্থক্য ১০ ঘণ্টা। হাইতিতে ঈদ উদ্‌যাপিত হয়েছিল বাংলাদেশের আগে।

বাংলাদেশে যখন ঈদের দিন সকাল, তখন ছেলেকে ফোন দিলে কথার ফাঁকে সে বলে ওঠে, ‘আম্মু, তোমার জন্য আমি ঈদের সব খাবার ফ্রিজে রেখে দেব, তুমি এসে খাবে।’ আমার তখন কান্না চলে এসেছিল। ছেলেটা আমাকে কী পরিমাণ মিস করছিল। সে এমনিতেই আমার খুব ভক্ত। ফেসবুকে স্ট্যাটাস দিয়েছিল, ‘মাকে ছাড়া ঈদ, সবার মাঝে থেকেও একা লাগছে।’
ওদিকে হাইতিতে একই পেশার আলাদা ১৪০ জন মানুষ একসঙ্গে ঈদের আনন্দ ভাগ করে নিয়েছিলাম। আসলে আমরা ১৪০ জনের একটি পরিবার ছিলাম। সেখানে ছিলাম লজিস্টিকস অফিসার হিসেবে কর্মরত। তাই আমার কাজও ছিল বেশি। হাইতির রাজধানী পোর্ট অব প্রিন্সে থাকতাম আমরা। জাতিসংঘের শান্তিরক্ষা মিশনে কর্মরত মুসলমানেরা আমাদের ক্যাম্পে ঈদের নামাজ পড়তে আসতেন। ঈদের আগের দিন থেকে মাঠ সাজানো শুরু করতাম। এপিসি (সাঁজোয়া, বাস, ট্রাকের মধ্যে পর্দা-ত্রিপল দিয়ে পার্টিশন তৈরি করতাম, যেন ব্যারাকের মেয়েদের দেখা না যায়।

হাইতিতে ঈদের দিন সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের পর বিভিন্ন দেশের সহকর্মীদের সঙ্গে লেখক (মাঝে বসা)। ছবি: সংগৃহীত
হাইতিতে ঈদের দিন সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের পর বিভিন্ন দেশের সহকর্মীদের সঙ্গে লেখক (মাঝে বসা)। ছবি: সংগৃহীত

আবার মেয়েদের জন্য আলাদা ঈদের জামাতের ব্যবস্থা করতাম। বিভিন্ন মুসলিম দেশের নারী কর্মকর্তারা আমাদের সঙ্গে ঈদের জামাতে এসে নামাজ আদায় করতেন। আমরা সবার জন্য বাংলাদেশের ঐতিহ্যবাহী খাবারের আয়োজন করতাম। খিচুড়ি, মাংস, ডিম ও পায়েস খেয়ে সবাই খুব প্রশংসা করতেন।

আমরা সব চিফ অফিস এবং বিভিন্ন দেশের কন্টিনজেন্টে ঈদের শুভেচ্ছা ও কার্ড পাঠাতাম। ওরাও আমাদের পাঠাত। বিকেলে এতিমখানায় খাবার বিতরণ শেষে ঈদ পুনর্মিলনী, রাতে সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান হতো। আমাদের ফোর্স, অফিসার—সবাই প্রোগ্রামে অংশগ্রহণ করতেন। হাইতিতে সেমাই পাওয়া যায় না। আমাদের ফোর্সরা আগে থেকেই জেনে বাংলাদেশ থেকে সেমাই নিয়ে এসেছিলেন। ঈদের দিন সেমাই রান্না করে তাঁরা আমাদের সবাইকে খাওয়ালেন।

আমরা দেশ থেকে যাওয়ার সময় প্রতিটি উৎসবের জন্য আলাদা পোশাক নিয়ে গিয়েছিলাম। আবার ছোট ছোট উপহারও নিয়ে গিয়েছিলাম, যেগুলো বাংলাদেশকে তুলে ধরে। ঈদের সময় সেগুলো সহকর্মীদের উপহার হিসেবে দিতাম।

ছাত্রজীবনে হলে থেকে পড়াশোনা করেছি। সংসারজীবন শুরু হয়েছে এক যুগের বেশি। অনেক দিন পর মিশনে গিয়ে কেমন যেন হলের জীবন ফিরে পেয়েছিলাম।
এখন বাংলাদেশে এসে মনে হচ্ছে, হাইতির ঈদ খুব আনন্দের ছিল। এখন মিস করি হাইতির ঈদের দিনকে। কিন্তু তখন হাইতিতে থেকে বাংলাদেশের ঈদ, স্বামী-সন্তান, ভাই-বোন, মা-বাবা, পরিবার-পরিজন, আত্মীয়-স্বজন ও প্রতিবেশী—সবাইকে খুব মনে পড়ত। আসলে জীবন এমনই।

অতিরিক্ত উপপুলিশ কমিশনার, ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশ (ডিএমপি)