আম কুড়াতে কুড়াতেই শুরু

বানেশ্বর বাজারে আম কেনাবেচা করেন মিরা।  ছবি: প্রথম আলো
বানেশ্বর বাজারে আম কেনাবেচা করেন মিরা। ছবি: প্রথম আলো

শুধুই মিরা। এই নামের আগে-পিছে আর কোনো পদ-পদবি নেই। কোলে দুই মাসের সন্তান। স্বামী থেকেও নেই, কারণ সংসারে যা আয় হয়, স্বামী মাদকের পেছনেই তা শেষ করে দেন। মিরা দেখলেন তিনি না খেয়ে মারা যাচ্ছেন। সঙ্গে শিশুসন্তানও।

এ গল্পটি আজ থেকে ছয় বছর আগের। তখন আমের মৌসুম। বাড়ি থেকে প্রায় ১০ কিলোমিটার দূরে রাজশাহীর সবচেয়ে বড় আমের বাজার—বানেশ্বর। মিরা সন্তানকে নিয়েই বানেশ্বর আসেন। বাজারে ঘুরে ঘুরে সারা দিন আম কুড়াতে থাকেন। ব্যবসায়ীদের কাছেও হাত পাতেন। তাঁরা দয়া করে দু-চারটে করে আম দেন। বেলা শেষে কুড়ানো আম একটি ‘জুস কোম্পানি’র কাছে বিক্রি করেন। কিছু টাকা আসে। প্রতিদিনই মিরা এই কাজ করতে থাকেন। একটু একটু করে আয় বাড়তে থাকে।

একপর্যায়ে আম কুড়ানো বাদ দিয়ে নিজেই আম কেনা-বেচা শুরু করেন। ছয় বছরের মাথায় এই ব্যবসাই তাঁকে ‘আমকুড়ানি’ থেকে ক্ষুদ্র ব্যবসায়ী বানিয়ে তুলেছে। এ জন্য তাঁকে লড়াই করতে হয়েছে বেশ।

মিরা শিশুসন্তান কোলে নিয়ে বাজারে আম কুড়িয়েছেন, ব্যবসা করেছেন তখন তাঁর টাকা নিয়ে ঘরে বসে স্বামী মাদক সেবন করেছেন। মিরা স্বামীকে সংশোধনের চেষ্টা করেন। কোনো কাজ হয় না। উপায় না দেখে একপর্যায়ে স্বামীর নামে মাদকের মামলা দিয়ে কারাগারে পাঠিয়ে দেন। তারপর ভালোভাবে ব্যবসা চালিয়ে যান। আমের মৌসুম শেষ হলে মাছ কিনে বিক্রি করেন। পাশাপাশি ঢাকা থেকে মেয়েদের ব্যাগ নিয়ে এসে বিকিকিনি করেন রাজশাহী বাজারে। বানেশ্বর বাজারে তাঁকে এখন সবাই একনামে চেনেন।

 মিরার বয়স এখন প্রায় ২৫ বছর। বাবার বাড়ি রাজশাহীর চারঘাট উপজেলার মুক্তারপুর গ্রামে। আট বছর আগে বিয়ে হয়েছিল রাজশাহীর কাঁটাখালী গ্রামে। স্বামীর নাম আরমান আলী। মিরা জানান, তাঁর স্বামী ঢাকার চকবাজার থেকে মেয়েদের ব্যাগ কিনে নিয়ে এসে রাজশাহীর বাজারে বিক্রি করতেন। ‘একটা সুন্দর সংসার শুরু করেছিলাম। বুঝতে পারিনি কখন আমার স্বামী মাদকাসক্ত হয়ে পড়লেন। একপর্যায়ে নিজের ব্যবসা ছেড়ে তিনি মাদক ব্যবসায়ীদের সঙ্গে সখ্য গড়ে তোলেন। মাদক ব্যবসায়ীদের ফেনসিডিল নিয়ে কখনো সিরাজগঞ্জে যান, কখনো ঢাকায় যান।’

অনেক চেষ্টা করেও আরমানকে ওই পথ থেকে ফেরানো যায় না। সিরাজগঞ্জে ফেনসিডিলসহ ধরা পড়েন। মিরা বলেন, ‘সিরাজগঞ্জ গিয়ে ভালো উকিল ধরে স্বামীর জামিন করাই। কিন্তু নেশার পথ থেকে তিনি ফেরেন না। বাড়ির সবকিছু বিক্রি করে নেশার টাকা জোগাড় করেন। এমনকি বাচ্চার পায়ের স্যান্ডেলও বিক্রি করে দেন।’

বাঁচার কোনো উপায় না দেখে স্বামীর পরিবারের লোকজনের সহযোগিতায় স্বামীর নামে মাদকের মামলা দিয়ে তাঁকে কারাগারে পাঠিয়ে দেওয়া হয়। এরপর স্বামীর বাড়িতে আর থাকার অবস্থা ছিল না মিরার। সাত মাসের সন্তান নিয়ে মিরা রাস্তায় বেরিয়ে পড়েন। জায়গা হয় চারঘাট উপজেলার হলিদাগাছি গুচ্ছগ্রামে। এখান থেকেই আম কেনাবেচা চালিয়ে যেতে থাকেন।

গতকাল শনিবার বানেশ্বর বাজারে গিয়ে মিরাকে খুবই ব্যস্ত দেখা গেল। আমের বাজারে ছোটাছুটি করছেন। আম কিনছেন। নিজেই মাথায় করে জুস কোম্পানির আড়তে নিয়ে যাচ্ছেন। দাঁড়িয়ে ছবি তোলার সময়ও যেন নেই। মিরা বলেন, ‘দিনে ৫০০ থেকে ১ হাজার কেজি আম কিনি।’ প্রতি হাটে ন্যূনতম ১ হাজার টাকা আয় মিরার। কোনো হাটে ৫ হাজার টাকা পর্যন্তও আয় হয়েছে।

বাজারের ব্যবসায়ীরা সবাই মিরাকে একনামে চেনেন। বানেশ্বরের ব্যবসায়ী শাহিনুর ইসলাম বলেন, প্রথম দিকে মিরা বাজারে আম কুড়াতেন। অন্যের কাছে চাইতেন। সবাই দিতেন। একসময় তিনি নিজেই আম কেনা শুরু করেন।

 মজার ব্যাপার, সবাই তাঁকে সহযোগিতা করছেন। মিরা যে ধরনের আম কেনেন, সেই আম বাজারে এলেই সবাই মিরাকে ডেকে দিয়ে দিচ্ছেন। এত বড় আমের বাজারে মাত্র একজন মেয়ে। সবাই তাঁকে সমীহ করেন। এই সুবাদে মিরা আম কেনার সময় দামেও একটু কম পান। 

 মিরা প্রথমে বুঝতে পারেননি যে এই আমের ব্যবসা তাঁর জীবনটাই বদলে দেবে। বললেন, ‘আমার জীবনে এখন একটাই স্বপ্ন, ছেলে নীরবকে লেখাপড়া শিখিয়ে মানুষ করা।’ গুচ্ছগ্রামে এতিমের মতো থাকতে তাঁর ভালো লাগে না। সুবিধামতো একটা জমি কিনে বাড়ি করবেন।

মিরা জানালেন, গত সপ্তাহে তাঁর স্বামী কারাগার থেকে বের হয়েছেন। তবে মিরার কাছে আসার সাহস পাচ্ছেন না। মিরা বলেন, ‘আমার সংসারটা খুব ভালো ছিল। স্বামী আমাকে খুব ভালোবাসতেন। সর্বনাশা মাদক আমার সর্বনাশ করেছিল। শেষবারের মতো আরেকবার তাঁকে ভালো করার চেষ্টা করব।’