ছবিতে সৌরভের গৌরব

সৌরভ দাশ
সৌরভ দাশ
>সড়কের গোলচত্বরে পাতা বিছানা। আশপাশে আলোর খেলা। কম্বল মুড়িয়ে শুয়ে আছেন একজন মানুষ। গভীর ঘুমে আচ্ছন্ন। কোলাহল, গাড়ির হর্নের শব্দ—কোনো কিছুই স্পর্শ করছে না তাঁকে। সারা দিনের খাটুনির পর ক্লান্ত শরীর যেন খানিকটা বিশ্রাম পেয়েই সবকিছুর ঊর্ধ্বে চলে গেছে। ইট-পাথরের এই শহরে এভাবেই রাত কাটে শ্রমজীবী মানুষদের। চেনা এই দৃশ্য অন্যরূপে ধরা পড়েছে আলোকচিত্রী সৌরভ দাশের ক্যামেরার ফ্রেমে।

ভাসমান মানুষের রাতযাপনের এসব চিত্র সিরিজ আকারে প্রকাশিত হয়েছে যুক্তরাজ্যভিত্তিক আলোকচিত্রবিষয়ক অনলাইন সাময়িকী লেনস কালচারে (www.lensculture.com)। শিরোনাম ‘ভাসমান নায়কেরা’। সৌরভ জিতেছেন ‘লেনস কালচার স্ট্রিট ফটোগ্রাফি পুরস্কার-২০১৮’-এর ‘সিরিজ ছবি’ ক্যাটাগরিতে প্রথম পুরস্কার। আলোকচিত্রের জগতে এই পুরস্কার মর্যাদাপূর্ণ।

ভাসমান মানুষের রাতযাপনের এমন ছবি তুলেই পুরস্কার জিতেছেন আলোকচিত্রী সৌরভ দাশ
ভাসমান মানুষের রাতযাপনের এমন ছবি তুলেই পুরস্কার জিতেছেন আলোকচিত্রী সৌরভ দাশ

১৯ জুন লেনস কালচার তাদের ওয়েবসাইটে বিজয়ীদের নাম প্রকাশ করেছে। ১৭০টি দেশের আলোকচিত্রীদের মধ্যে সেরা হয়েছেন বাংলাদেশের সৌরভ। পুরস্কারজয়ী ও নির্বাচিত ৩৯টি ছবি নিয়ে আগামী ২ থেকে ৭ জুলাই ফ্রান্সের আলস শহরে প্রদর্শনী অনুষ্ঠিত হবে।

ছবির পেছনের গল্প শোনান সৌরভ। ভাসমান ছবি নিয়ে কাজ করছেন ২০১৭ সাল থেকে। কিন্তু মনের মতো ছবি হচ্ছিল না। আরও মনোযোগ দিলেন। চলতি বছরের জানুয়ারি থেকে নামেন আটঘাট বেঁধে। ক্যামেরা কাঁধে শুরু হয় রাতের নগর দেখা। অবশেষে ১৭ জানুয়ারি আসে প্রথম ছবি। চট্টগ্রাম নগরের লাভ লেন সড়কের গোলচত্বরে ভাসমান নারী শ্রমিকের রাতযাপনের চিত্র। ২০ বছরের আসমা দিনে টুকটাক কাজ করেন। রাতে এখানেই ঘুমান।

ভাসমান মানুষের রাতযাপনের এমন ছবি তুলেই পুরস্কার জিতেছেন আলোকচিত্রী সৌরভ দাশ
ভাসমান মানুষের রাতযাপনের এমন ছবি তুলেই পুরস্কার জিতেছেন আলোকচিত্রী সৌরভ দাশ

এ রকম ২ ফেব্রুয়ারির ফ্রেমে ধরা পড়ে চট্টগ্রাম নগরের কোতোয়ালি মোড়ে আরেক শ্রমিকের চিত্র। নাম তাঁর খোকন। শহরে মাথা গোঁজার ঠাঁই নেই। প্রতিদিন পাশেই বাংলাদেশ ব্যাংক চট্টগ্রাম কার্যালয়ে আসা টাকার বস্তা বহন করেন। আর রাতেই গোলচত্বরে পাতা খোলা বিছানায় ঘুম। দুই মাসের মধ্যেই তোলা হয় একে একে আটটি ছবি। স্লো শাটার ব্যবহার করায় ছবির গল্পগুলো নতুন চেহারা পেয়েছে। শুয়ে থাকা মানুষগুলোকে ঘিরে বয়ে গেছে গতির রেখা। কখনো তা তৈরি করেছে ছোট-বড় বৃত্ত, কখনো ঝরনাধারার মতো তাঁদের ছুঁয়ে চলে গেছে।

সৌরভ বলেন, ‘দুই মাস ধরে ঢাকা ও চট্টগ্রামের বিভিন্ন সড়কে আমি ক্যামেরা নিয়ে দাঁড়িয়েছি। গভীর রাতে সন্তর্পণে তুলেছি ছবি, যাতে তাঁরা টের না পান। পরে গিয়ে কথা বলেছি। এ জন্য কষ্ট করতে হয়েছে। ছিল নিরাপত্তার ঝুঁকি। তবু ছবির নেশা আমাকে এগিয়ে নিয়ে গেছে। এমনও দিন গেছে, সারা দিন অফিসের কাজ সেরে রাতভর ছবি তুলেছি। এ কাজে আমাকে সব সময় সহযোগিতা করেছেন আরেক আলোকচিত্রী রবিন চৌধুরী।’

ভাসমান মানুষের রাতযাপনের এমন ছবি তুলেই পুরস্কার জিতেছেন আলোকচিত্রী সৌরভ দাশ
ভাসমান মানুষের রাতযাপনের এমন ছবি তুলেই পুরস্কার জিতেছেন আলোকচিত্রী সৌরভ দাশ

প্রতিবছর লেনস কালচার সিরিজ ও একক ছবি—এ দুই বিভাগে আলোকচিত্রীদের পুরস্কার দেয়। এবার সিরিজ ছবি ক্যাটাগরিতেই প্রথম হয়েছেন সৌরভ দাশ। এই বিভাগে দ্বিতীয় ও তৃতীয় হয়েছেন তুরস্কের ইলকার কারামান এবং ইতালির কোকোয়া ল্যানি। অন্যদিকে একক ছবিতে সেরা হয়েছেন পোল্যান্ডের মাসিয়ে ডাকোভিচ। এ ছাড়া দ্বিতীয় ও তৃতীয় হয়েছেন যথাক্রমে ইসরায়েলের ব্যারি টালিস ও চীনের জিংসেংনি। প্রথম পুরস্কার হিসেবে সৌরভ পাবেন পাঁচ হাজার ডলার ও সনদ। সিরিজ ফটোগ্রাফিতে এর আগেও পুরস্কার জেতেন সৌরভ। ২০০৯ সালে ফ্রান্সের সিপাপ্রেস ফটোগ্রাফার অব দ্য ইয়ার নির্বাচিত হন। তখন বেলুন তৈরির শিশু শ্রমিকদের নিয়ে করা সিরিজটি তাঁকে পুরস্কার এনে দেয়।

ভাসমান মানুষের রাতযাপনের এমন ছবি তুলেই পুরস্কার জিতেছেন আলোকচিত্রী সৌরভ দাশ
ভাসমান মানুষের রাতযাপনের এমন ছবি তুলেই পুরস্কার জিতেছেন আলোকচিত্রী সৌরভ দাশ

সৌরভের ফটোগ্রাফির হাতেখড়ি আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন আলোকচিত্রী শোয়েব ফারুকীর ফটোব্যাংকে। এরপর তিন বছরের স্নাতক করেছেন পাঠশালা (সাউথ এশিয়ান ইনস্টিটিউট অব ফটোগ্রাফি) থেকে। প্রথম আলোর সঙ্গে আলোকচিত্রী হিসেবে আছেন ২০১১ সালের জানুয়ারি থেকে। কাজের পেছনে ছোটা মানুষটির সব সময় চেষ্টা থাকে ভালো কিছু করার।

পুরস্কারপ্রাপ্তিতে কেমন লাগছে, এমন প্রশ্নে স্বভাবসুলভ মুচকি হাসি দিয়ে বললেন, ‘কষ্ট সার্থক হওয়া আনন্দের। আরও ভালো কাজ করে এগিয়ে যেতে চাই।’