'সবার আমি ছাত্র'

আলোকচিত্রী শহিদুল আলম। ছবি: কবির হোসেন
আলোকচিত্রী শহিদুল আলম। ছবি: কবির হোসেন
>সম্প্রতি আলোকচিত্রের মাধ্যমে সমাজে অবদান রাখার জন্য যুক্তরাষ্ট্রের লুসি ফাউন্ডেশন শহিদুল আলমকে এ বছর ‘হিউম্যানিটারিয়ান অ্যাওয়ার্ড’-এর জন্য নির্বাচিত করেছে। বাংলাদেশের গুণী একজন আলোকচিত্রী, পাঠশালা সাউথ এশিয়ান মিডিয়া  ইনস্টিটিউটের প্রতিষ্ঠাতা, দৃকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক ও মানবাধিকারকর্মী শহিদুল আলম। তাঁর জীবনের নানা সময়ের গল্প, ভাবনা, জীবনবোধ ও দর্শনের কথা বললেন ছুটিরদিনের সঙ্গে আলাপচারিতায়।

তাঁর পায়ের তলায় যেন সর্ষে। ক্যামেরা হাতে ছবি তুলছেন, ভিডিও করছেন। আজ এখানে তো কাল ওখানে।  ২৬ জুন বিকেলের ফ্লাইটে লন্ডন যাবেন। সেদিনের সকালে কথা বলবেন, জানিয়েছিলেন। তাই বেলা ১১টায় গিয়ে হাজির হলাম ঢাকার পান্থপথের দৃক আলোকচিত্র গ্রন্থাগার কার্যালয়ে। সভা করছিলেন। এই ফাঁকে দৃকের গ্যালারিতে তাঁর তোলা ছবিগুলো দেখছিলাম। এমন সময় তিনি এলেন। বলতে থাকলেন একেকটা ছবি তোলার পেছনের গল্প। একজন প্রবাসী শ্রমিকের ছবি দেখিয়ে বললেন, ‘মায়ের জন্য এই মোবাইল কিনেছিল। আমাকে দিয়েছিল বাড়িতে পৌঁছে দেওয়ার জন্য।’

ছেলের কেনা সেই মোবাইল ফোন বিদেশ থেকে বয়ে এনে মায়ের কাছে পৌঁছে দিয়েছিলেন বরেণ্য আলোকচিত্রী শহিদুল আলম। এ ঘটনা যখন বলছিলেন, সেই কাজটি করার তৃপ্তি তাঁর চোখেমুখে। এমন মানুষই তো তিনি। মানুষে মানুষের সম্পর্কই তাঁর কাছে বড়, শ্রেণিবৈষম্য তাঁর জীবনের অভিধানে নেই। তিনি শিক্ষক, তবে মনে করেন ‘সবার আমি ছাত্র’।

সম্প্রতি আলোকচিত্রের মাধ্যমে সমাজে অবদান রাখার জন্য যুক্তরাষ্ট্রের লুসি ফাউন্ডেশন তাঁকে এ বছর ‘হিউম্যানিটারিয়ান অ্যাওয়ার্ড’-এর জন্য নির্বাচিত করেছেন। আলোকচিত্রের ‘অস্কার’ বলা হয় এ পুরস্কারকে। ২৮ অক্টোবরে যুক্তরাষ্ট্রে তিনি এ পুরস্কার গ্রহণ করবেন। বাংলাদেশের গুণী একজন আলোকচিত্রী, পাঠশালা সাউথ এশিয়ান মিডিয়া ইনস্টিটিউটের  প্রতিষ্ঠাতা, দৃকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক ও মানবাধিকারকর্মী শহিদুল আলম। ওয়ার্ল্ড প্রেস ফটো প্রতিযোগিতায় এশিয়া থেকে একমাত্র তিনিই ছিলেন  জুরি বোর্ডের সভাপতি। তাঁর জীবনের নানা সময়ের গল্প, ভাবনা, জীবনবোধ ও দর্শনের কথা বললেন সেদিনের আলাপচারিতায়।

মায়ের কাছ থেকে ছোটবেলায় ‘আনন্দলোকে...’ গানটি শেখা হচ্ছে। ছবি: পারিবারিক অ্যালবাম থেকে
মায়ের কাছ থেকে ছোটবেলায় ‘আনন্দলোকে...’ গানটি শেখা হচ্ছে। ছবি: পারিবারিক অ্যালবাম থেকে

স্মৃতির ফ্ল্যাশব্যাকে বিলেতি জীবন
শহিদুল আলম বারবার হারিয়ে যাচ্ছিলেন জীবনের ফ্ল্যাশব্যাকে। স্মৃতি যেন ফল্গুধারার মতো বেরিয়ে এল। ঢাকার মধ্যবিত্ত পরিবারের এক ছেলে পড়তে যাবেন বিলেতে। মা-বাবা বিমানের টিকিটটা শুধু কেটে দিলেন। তবে ছেলেকে পড়তে হবে নিজের টাকায়। তখন তাঁর বয়স মাত্র ১৭।  প্রথমে গেলেন যুক্তরাজ্যের লিভারপুলে। কী করেননি তখন? কাঠমিস্ত্রি–রাজমিস্ত্রির সহকারী, বাথরুম পরিষ্কার থেকে শুরু করে বাগানের মালি, নাইটগার্ড—সব কাজই করেছেন তিনি। এসব করে লিভারপুলে নিজের পড়ার খরচ জোগাতেন। শহিদুল আলম বললেন, ‘পশ্চিমাদের নিয়ে অনেক সমালোচনা করি। সেই সময় তাদের কাছ থেকে একটা বড় শিক্ষা পেয়েছি। আমি যে বিল্ডিংয়ের নির্মাণকাজে শ্রমিক ছিলাম, সেখানকার পরিচালক নিজেও কাঠমিস্ত্রির কাজ করতেন। প্রতিদিন সন্ধ্যার পর পাবে যেতাম। মদ পান না করলেও সবার সঙ্গে আড্ডা দিতাম।  সেখানে যখন আড্ডা হতো, তখন কে শ্রমিক, কে মালিক কোনো পাথর্ক্য থাকত না। আমি তো এটা দেখে অভ্যস্ত ছিলাম না। যে সমাজে বড় হয়েছি, সেখানে শ্রেণিবৈষম্য একটি বড় বিষয়। আমাদের সম্বোধন, ব্যবহার বদলে যায় শ্রেণি দেখে। আমি ঠিক করলাম আমার জীবনে যেন কোনো কিছুতে শ্রেণিবৈষম্য বা মানুষে মানুষে ভিন্ন আচরণ প্রকাশ না পায়। কতটুকু পেরেছি জানি না। তবে চর্চা করে চলেছি এখনো।’

লিভারপুলে প্রাণরসায়নে স্নাতক হয়ে লন্ডন বিশ্ববিদ্যালয়ে পিএইচডি করছিলেন। চলছিল গবেষণা সহকারী হিসেবে কাজ ও খণ্ডকালীন শিক্ষকতা। এ সময় তিনি যুক্ত হলেন ইংল্যান্ডের সোশ্যালিস্ট ওয়ার্কার্স পার্টির সঙ্গে। সমাজের বৈষম্যগুলো তাঁকে নাড়া দিত।
এসবের মধ্যে আলোকচিত্র এল কী করে? ‘পিএইচডির শেষের দিকে দেশে ফেরার কথা ভাবলাম। মনে হলো সমাজের যে বৈষম্যগুলো আমাকে ভাবায়, সেসবের পরিবর্তনের জন্য আলোকচিত্র একটি শক্তিশালী মাধ্যম। গণমাধ্যমের গুরুত্বও বুঝেছিলাম। বাংলাদেশে তখন সাক্ষরতার হার অনেক কম ছিল। ফলে গণমাধ্যমে যা আসবে তা তারা পড়তে পারবে না। তারা যে মাধ্যমে নিজেদের যুক্ত করতে পারবে, বুঝতে পারবে, সেটা আলোকচিত্র। আরও মনে হয়েছিল দেশে আরেকজন রসায়নবিদের বোধ হয় প্রয়োজন নেই এই মুহূর্তে। আমি একজন রাজনৈতিক মানুষ। লন্ডনে বিভিন্ন আন্দোলনে যুক্ত ছিলাম। মনে হলো গতানুগতিক পিএইচডি ডিগ্রিধারী না হয়ে আমাকে আলোকচিত্র নিয়ে কাজ করতে হবে।’ বলেন শহিদুল আলম।

বাবা কাজী আবুল মনসুর ও মা কাজী আনোয়ারা মনসুরের সঙ্গে তরুণ শহিদুল আলম
বাবা কাজী আবুল মনসুর ও মা কাজী আনোয়ারা মনসুরের সঙ্গে তরুণ শহিদুল আলম

যদিও আলোকচিত্রের ওপর কোনো প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা নেই। তাতে কী! বই তো আছে। ১৯৮০ থেকে ১৯৮৩ এই তিন-চার বছর আলোকচিত্রের ওপর প্রায় ৮০০ বই পড়ে ফেললেন শহিদুল আলম। বই পড়ে, প্রচুর ছবি তুলতে তুলতে এবং ডার্ক রুমে কাজ  করে ছবি তোলা ও প্রিন্ট করা  শিখে ফেললেন। এর মধ্যে একটি সংস্থায় ছবি তোলার কাজও পেলেন। রসায়ন পড়ার কারণে অনেক আলোকচিত্র পরিস্ফুটনের রাসায়নিক বৈজ্ঞানিক বিষয়গুলো রপ্ত ছিল। যে কাজটা পেলেন, সেটায় শহিদুল আলমকে মূলত শিশুদের ছবি তুলতে হবে। তখন নিজের ক্যামেরাও নেই। লন্ডনের সেই সংস্থা থেকে পেনট্যাক্স কে ১০০০ মডেলের একটি ক্যামেরা দেওয়া হলো তাঁকে। সঙ্গে ফ্ল্যাশগানও। 

শহিদুল আলম রাস্তায় দাঁড়িয়ে থাকতেন, বাচ্চাসহ কাউকে দেখলে তাঁর বাচ্চার ছবি তোলার অনুমতি চাইতেন। রাজি হলে সময় ঠিক করে তাঁদের বাড়ি যেতেন বাচ্চার হাসিখুশি ছবি তুলতেন। একজন মায়ের কাছে বাচ্চার হাসিখুশি ছবির থেকে সেরা ছবি নেই—এমনটাই মনে হতো শহিদুল আলমের। তাই বিনা মূল্যে ছবি তুলে দিতেন। নিজে থেকে চারটা ছবি প্রিন্ট করে দিতেন। ‘কেউ চাইলে প্রিন্ট কিনতে পারত। এভাবে প্রচুর টাকা আয় করলাম। আমার সংস্থা খুব খুশি আমার ওপর। সারাক্ষণ আমাকে বাহবা দিত।’

সবই ঠিকঠাক চলছিল। হঠাৎ তাঁর উপলব্ধি হলো, তিনি যে কারণে আলোকচিত্রী হতে চেয়েছেন, এটা তো সেই কাজ না। এই স্বচ্ছন্দের পরিবেশে থাকলে সেটা সম্ভব না। শহিদুল আলম বললেন, ‘নিম্নমানের ছবি তুলে যদি বেশি টাকা পাই, তাহলে এই জীবন আমাকে আলিঙ্গন করবে। একসময় হয়তো বিশ্বাস করতে শুরু করব, আমি আসলেই ভালো ছবি তুলি। আমি ওদের কাজ করব না আর বলে দিলাম। দেশে ফেরার সিদ্ধান্ত নিলাম।’
যুক্তরাজ্যে সে সময় ছবি তুলে প্রায় ২ হাজার ৮০০ পাউন্ড জমিয়ে ফেললেন তিনি। ভাবলেন দেশে ফিরে এই টাকা দিয়ে আলোকচিত্রের কাজ শুরু করবেন।

 ১৯৮৪ সালে দেশে ফিরলেন শহিদুল আলম। বাবা কাজী আবুল মনসুর চিকিৎসক, অণুজীববিজ্ঞানী ও অধ্যাপক। মনসুর’স মিডিয়ার আবিষ্কারক ছিলেন তিনি। মা কাজী আনোয়ারা মনসুর, অগ্রণী স্কুলের প্রতিষ্ঠাতা এবং প্রধান শিক্ষক। বাড়িতে এসে শুনলেন তাঁর আব্বা গৃহনির্মাণ ঋণ নিয়ে বাড়ি করেছিলেন। যে টাকা বাকি আছে তা ২ হাজার ৮০০ পাউন্ডের সমপরিমাণ। কোনো কথা না বলে জমানো টাকাটা দিয়ে দিলেন। আব্বাকে টাকাটা দিতে পেরে ভালোই লেগেছিল। কিন্তু নিজের হাত শূন্য। সে সময় বাংলাদেশে আনোয়ার হোসেন, বিজন সরকার, মনজুর আলম বেগ প্রতিষ্ঠিত আলোকচিত্রী। শহিদুল আলমকে তো কেউ তখন চেনে না। কোনো পত্রিকার সঙ্গেও যুক্ত ছিলেন না। মা-বাবার নাম-পরিচয় আছে, সেটা তো সেই ছোটবেলা থেকে এড়িয়ে চলেন। দুই ভাই এক বোনের মধ্যে শহিদুল আলম ছোট। তখন বয়স ছয় কি সাত, দুই ভাই ঠিক করলেন তাঁরা নাম পরিবর্তন করবেন। কারণ তাঁরা মা-বাবার পরিচয়ে পরিচিত হতে চান না। তাঁরা মা-বাবার সঙ্গে কথা বললেন। ‘আমার মা-বাবা, বিশেষ করে বাবা সব কথা মনোযোগ দিয়ে শুনতেন। কেন করতে চাই, সেটি যেমন গুরুত্ব দিতেন আবার কোনো কিছু যদি মনে করতেন করা যাবে না, সে ব্যাখ্যাও পরিষ্কারভাবে দিতেন।’ বলেন শহিদুল আলম। পরিবারের দেওয়া নাম জাহেদ মনসুর বদলে করলেন শাহেদুল আলম। স্কুলে কখন সেটা ‘শহিদুল আলম’ হয়ে গেল এখন সেটা আর তাঁর খেয়াল নেই।

নিজের তোলা ছবি নিয়ে দৃক গ্যালারিতে দর্শকদের সঙ্গে কথা বলছেন শহিদুল আলম। ছবি: সংগৃহীত
নিজের তোলা ছবি নিয়ে দৃক গ্যালারিতে দর্শকদের সঙ্গে কথা বলছেন শহিদুল আলম। ছবি: সংগৃহীত


ঢাকায় শুরু হলো আলোকচিত্রীর জীবন

সনদ নেই, কিন্তু কাজ করতে চান ফটোজার্নালিস্ট হিসেবে। যে পোর্টফোলিও তাতে তিনি স্টুডিওর আলোকচিত্রী। সে সময় এলিফ্যান্ট রোডে খান মোহাম্মদ আমির নামের একজনের সঙ্গে দেখা করলেন। তাঁর পুঁজিতে পরিচালক হিসেবে শহিদুল আলম ‘ফটো ওয়ার্ল্ড’ নামের একটি প্রতিষ্ঠান চালু করলেন। কারিগরি দিকে দক্ষতা থাকায় উন্নত মানের ফটোস্টুডিও তৈরি করলেন। অনেক নামীদামি বড় মানুষ আসতেন সেখানে। ফলে শহিদুল আলমের পরিচিতির গণ্ডি কিছুটা বাড়ল। ভালোই চলছিল। আবার মনে পড়ল বাংলাদেশে ফেরার উদ্দেশ্য। খান মোহাম্মদকে জানালেন, প্রতিষ্ঠান তো খুব ভালো চলছে। তাঁর না থাকলেও চলবে। শুরু করলেন একাই—মানে ফ্রি-ল্যান্স আলোকচিত্রী। বাংলাদেশে সে সময় কোম্পানির ব্রোশিয়ার হতো না। তিনি বিভিন্ন জনকে বোঝাতে লাগলেন, কেন ব্রোশিয়ার দরকার। সেগুলো করে দিতেন।

তবে জীবনের মোড় ঘুরে গেল চট্টগ্রাম ইপিজেডের একটি কোম্পানির কাজে। এই কোম্পানি ইলেকট্রনিক সার্কিট বোর্ড নিয়ে কাজ করত। সেসব সার্কিটের ছবি তুললেন। সার্কিট বোর্ডের ছবিগুলো দেখে মনে হলো যেন নিউইয়র্কের ম্যানহ্যাটনের দিগন্তরেখা, উঁচু দালানের মধ্যে থাকা ভাসমান রাস্তা। এ ধরনের কাজ তখন বাংলাদেশে হতো না। তা খুব প্রশংসা পেয়েছিল। সেটিই হয়ে গেল শহিদুল আলমের ভিজিটিং কার্ড।

আরেকটি কাজের কথা বললেন। সে সময়ের বড় একটি প্রতিষ্ঠান। তাদের জন্য অনেক ছবি তুলে দিলেন। সে সময় ছবি তোলার জন্য ৩ সাড়ে ৩ হাজার টাকা দেওয়া হতো। ওই প্রতিষ্ঠানটি দিল ৯ হাজার টাকা। শহিদুল আলমের খরচ হয়েছিল ১১ হাজার টাকা। তিনি মনে করলেন ছবি তোলা শেখার জন্য বাকি ২ হাজার টাকা তাঁর ভর্তুকি। মজার ব্যাপার হলো, সব ছবি দিয়ে ওই প্রতিষ্ঠানটি তাদের অভ্যর্থনাকক্ষে শহিদুল আলমের একটা গ্যালারি বানিয়ে ফেললেন।

নিত্যনতুন ধারণা ও উন্নত কাজ দিয়ে একের পর এক কাজ পেতে থাকলেন। বাংলাদেশে প্রথম পোলারয়েড ব্যাক দিয়ে ছবি তুলতেন। সেই সময়ে এটা ছবি তোলে তাৎক্ষণিক দেখার সুবিধা করে দিত। এর মধ্যে শুরু হলো এরশাদবিরোধী আন্দোলন। তিনি পেয়ে গেলেন তাঁর পছন্দের কাজ। আন্দোলনকারী হিসেবে ছবি তুলতে লাগলেন। ১৯৮৯ সালের ১০ নভেম্বর তিনি সিদ্ধান্ত নিলেন, এরশাদবিরোধী আন্দোলনের ছবি ও নানা সময়ের ছবি দিয়ে শহীদ নূর হোসেনকে উৎসর্গ করে একটি প্রদর্শনী করবেন। তত দিনে তাঁর পরিচিতিও হয়েছে। আলিয়ঁস ফ্রঁসেজ পৃষ্ঠপোষকতা করতে আগ্রহী হলো। সব ঠিক হলো—তাঁরা ছবি দেখতে এলেন। সেখানে এক সেট ছবি ছিল এক মন্ত্রীর মেয়ের বিয়ের। ১৯৮৮ সালের ভয়াবহ বন্যার পরপরই ঢাকার আবাহনী খেলার মাঠে তৎকালীন মন্ত্রিপরিষদের একজন সদস্য বিলাসবহুলভাবে তাঁর মেয়ের বিয়ের আয়োজন করেন। অনেক মন্ত্রী, বিশিষ্ট ব্যক্তি আমন্ত্রিত অতিথি হিসেবে গিয়েছিলেন সেখানে। সবাই জানতেন কিন্তু কেউ প্রশ্ন করলেন না, দেশের এই পরিস্থিতিতে এমন বিয়ের অনুষ্ঠান হওয়া কতটা যৌক্তিক। শহিদুল আলম তাঁর তোলা বন্যার ছবির পাশে সেই বিয়ের ছবিও রাখলেন। আলিয়ঁস ফ্রঁসেজ তাতে আপত্তি জানাল। বাদ হয়ে গেল পৃষ্ঠপোষকতা। নানা জায়গায় ঘুরেছেন। কেউ রাজি হননি প্রদর্শনী করতে। তখন জাতীয় প্রেসক্লাবের একটি কক্ষ ভাড়া নিয়ে প্রদর্শনীর আয়োজন করলেন। সেখান থেকে বিয়ের ছবিগুলো চুরি হয়ে গেল। সেগুলো উদ্ধার করে পাহারাদার বসিয়ে সেবারের মতো কাজ হলো। আরেকটি শিক্ষা হলো তাঁর—যে ধরনের কাজ করতে চান শহিদুল আলম, তার জন্য নিজস্ব গ্যালারি থাকতে হবে। এরপর ১৯৯৩ সালে ধানমন্ডিতে প্রতিষ্ঠা করলেন দৃক গ্যালারি। প্রথম প্রদর্শনী ছিল ওয়ার্ল্ড প্রেস ফটোর আলোকচিত্র নিয়ে। 

যে পথে হেঁটেছেন, পালক রেখে গেছেন

শহিদুল আলম একা এগিয়ে যেতে চাননি। ১৯৯৮ সালে তাই প্রতিষ্ঠা করেন পাঠশালা। শুরুতে অনেকেই তাঁকে নিরুৎসাহিত করেছিলেন, ‘তুমি তো নিজের প্রতিযোগী তৈরি করছ?’ আর পাঠশালা নামটিও অনেকের পছন্দ হয়নি। ‘গেঁয়ো’ ধরনের নাম।

শহিদুল আলম নিজের শিক্ষা কি ছড়িয়ে দিতে পেরেছেন ছাত্রছাত্রীদের মধ্যে? উত্তরে বললেন, আমি দুটো বিষয় দেখেছি। আমার জন্ম হয়েছে লড়াই করার জন্য। একা তো লড়াই করা যায় না, তার জন্য সৈনিক দরকার। আর আমি একা থাকলে সমালোচনা করার কেউ থাকত না। আত্মতৃপ্তি নিয়ে কাটাতাম। সেটা আমি চাইনি। পাঠশালার অনেক ছাত্রছাত্রী আন্তর্জাতিকভাবে খ্যাতি পেয়েছেন। ছবিমেলার সময় যে তর্কগুলো হয়, তারা যদি নিজেরা ভালো না করত, গভীরভাবে না জানত, তাহলে এটা হতো না। আমার সীমাবদ্ধতাগুলো ধরিয়ে দেওয়ার জন্যও তো সেই মানের ছাত্রছাত্রী থাকতে হবে।

ভালো ছবি তোলাই সব নয়। ‘কেন ছবি তুলছি, কোথায় যেতে চাইছি, সেটা আসল।’ শহিদুল আলমের কাছে সমাজবদলের জন্য লড়াইয়ের হাতিয়ার আলোকচিত্র।

বছরের পর বছর ধরে কাজের মান ধরে রেখেছেন। কোনো কিছুর গভীরে গিয়ে দেখার প্রবণতা দেখা যায় দৃকের বিভিন্ন প্রকাশনার কাজে, ছবির কাজে, এমনকি তথ্যচিত্রেও। শহিদুল আলম মনে করেন, প্রত্যেকের নিরন্তর চেষ্টা হতে হবে কোনো কিছুর শেষ প্রান্তে কী আছে, তার বাইরে গিয়ে দেখা। নতুন দরজা খোলার চেষ্টা চালিয়ে যেতে হবে। বললেন, ‘ধরুন, আমি যখন প্রদর্শনী করি, একটার থেকে আরেকটা আলাদা করি। হিল উইমেন্স ফেডারেশনের অপহৃত নেত্রী কল্পনা চাকমার ওপর তিনটি প্রদর্শনী করেছি। প্রতিটি ভিন্ন ছিল। আমার পদচারণ যদি পৃথিবীকে ভিন্ন কিছু, নতুন কিছু দিতে না পারে, তাহলে এই জন্মই বৃথা।’

নিজের প্রতিষ্ঠিত পাঠশালার সামনে। ছবি: প্রথম আলো
নিজের প্রতিষ্ঠিত পাঠশালার সামনে। ছবি: প্রথম আলো

পরিবারে, সমাজে

শহিদুল আলমের কাছে তাঁর ব্যক্তিজীবন, পারিবারিক জীবন, সামাজিক ও রাজনৈতিক জীবনের মধ্যে কোনো ভিন্নতা নেই। ব্যক্তিজীবনে অপ্রয়োজনীয় কোনো কিছু ব্যবহার করেন না। এমনকি খাবারও খান এক বেলা। ঢাকার রাস্তায় বাইসাইকেলে যাতায়াত করেন। দেশি পোশাকই পরেন সব সময়।

জীবনযাপনে দেশি ভাব থাকলেও বিচরণ তো আন্তর্জাতিক অঙ্গনে? শহিদুল আলমের উত্তর, ‘আমি নিজেকে বিশ্ব নাগরিক হিসেবে দেখি। শুধু বিদেশিরা বিশ্ব নাগরিক হিসেবে পরিচিতি পাবে, সেটি আমি মানতে নারাজ। আমার যেকোনো প্রদর্শনীর প্রথম আয়োজনটা করি বাংলাদেশে। পরে দেশের বাইরে। একসময় আমার বিদেশি বন্ধুরা এসে পড়িয়ে যেতেন পাঠশালায়। এখন আমাদের কাছে পড়তে আসে বিভিন্ন দেশের ছেলেমেয়েরা। বাংলাদেশে দৃক, পাঠশালা ও ছবিমেলা করেছি। আন্তর্জাতিকভাবে সেরা হতে হবে এদের। আমার যেমন স্বপ্ন, পাঠশালার নতুন ভবনে হবে পৃথিবীসেরা আলোকচিত্রের প্রশিক্ষণ। আমি না থাকলেও আমার ছাত্ররা নিশ্চয়ই পারবে।’

আন্তর্জাতিক ফটো এজেন্সি মেজোরিটি ওয়ার্ল্ডের সহপ্রতিষ্ঠাতা শহিদুল আলম। এই এজেন্সি এশিয়া, আফ্রিকা, দক্ষিণ আমেরিকা ও মধ্যপ্রাচ্যের মেধাবী আলোকচিত্রীদের নিয়ে স্থানীয় সংস্কৃতি, পরিবেশ ও উন্নয়ন ইস্যুতে কাজ করে।

এশিয়ার সর্ববৃহৎ আলোকচিত্র উৎসব ছবি মেলার পরিচালক শহিদুল আলম। দ্বিবার্ষিক এ আয়োজন হয় ঢাকায়। বিভিন্ন দেশ থেকে সেরা আলোকচিত্রীরা ঢাকার বিভিন্ন স্থানে প্রদর্শনীতে অংশ নেন। গত বছর নবম ছবি মেলায় ‘অবস্থান্তর’ বিষয়কে কেন্দ্র করে ১৬টি দেশের ২৭ শিল্পীর ৩১টি প্রদর্শনী ছিল। ২০১৯ সালে দশম ছবি মেলা অনুষ্ঠিত হবে। কিউরেটর, ফটো সমালোচক ও এর সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা এ সময় ছবি মেলার আমন্ত্রণে ঢাকায় আসেন। এটি আলোকচিত্রে বাংলাদেশের জন্য অনেক বড় অর্জন।

আলোকচিত্রের যেকোনো আয়োজনেই প্রাণবন্ত শহিদুল আলম। ছবি: সংগৃহীত
আলোকচিত্রের যেকোনো আয়োজনেই প্রাণবন্ত শহিদুল আলম। ছবি: সংগৃহীত

যেখানে দাঁড়িয়ে

ছোটবেলায় একবার গালি শিখেছিলেন শহিদুল আলম। বাড়িতে থাকা সাহায্যকারীদের সেই গালি দিয়েছিলেন। মা বলেছিলেন, ‘ওদের গালি দিয়ো না। ওরা কষ্ট পায়।’ এ পর্যায়ে আপাত রাশভারী শহিদুল আলম কেঁদে ফেলেন। বলতে থাকেন, ‘চানবানু খালা আমাকে বড় করেছিল। না বুঝে ছোটবেলায় তাকে আমি কত কষ্ট দিয়েছি। ওই দিনের পর কোনো মানুষকে আমি আর গালি দিইনি।’

যা হতে চেয়েছিলেন, তা কি হতে পেরেছেন? ‘আমাকে অন্তত থাকা-খাওয়ার কথা চিন্তা করতে হয় না। ফলে পৃথিবীকে প্রতিনিয়ত দেওয়ার নিরন্তর চেষ্টা করতে হবে।’ বললেন শহিদুল আলম। দৃক ও পাঠশালার মতো প্রতিষ্ঠান তৈরি করেছেন। আত্মতৃপ্তি হয় নাকি এখানেও স্বচ্ছন্দ এসে যাচ্ছে? শহিদুল আলম জানালেন পাঠশালার অর্জন অন্য জায়গায়। ‘আমি যখন শুরু করি, তখন আমি ছিলাম একমাত্র দেশি মাস্টার। আমি যা খেয়েছি, আমার বিদেশি বন্ধুরা এসে তা-ই খেয়েছেন, আমার সঙ্গে মেঝেতে ঘুমিয়েছেন। তাঁরা আসলে উদার। তাঁদের কারণে এই পরিবর্তন এসেছে।’ বর্তমানে পাঠশালার ২৬ শিক্ষকের মধ্যে ২৪ জনই প্রাক্তন শিক্ষার্থী। এটাকে সবচেয়ে বড় অর্জন মনে করছেন শহিদুল আলম। একটা আন্তর্জাতিক মানের স্কুলের শিক্ষকেরা বাংলাদেশি—এটা বড় পাওয়া।

পাঠশালা সাউথ এশিয়ান মিডিয়া ইনস্টিটিউট এশিয়ার মধ্যে সেরা মানসম্পন্ন আন্তর্জাতিক আলোকচিত্র শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান। ২০১৮ সালে পাঠশালা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধিভুক্ত হয়েছে। ১০০ জনের বেশি তিন বছরের কোর্স শেষ করে বের হয়েছেন। বেসিক ফটোগ্রাফি কোর্স শেষ করেছেন ছয় হাজারজনেরও বেশি। প্রায় ৪০ জন আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন আলোকচিত্রী ও ফটো সম্পাদক পাঠশালায় এসে প্রশিক্ষণ দিয়ে গেছেন।

পাঠশালার শিক্ষার্থীরা ওয়ার্ল্ড প্রেস ফটো, জুপ সোয়ার্ট মাস্টার ক্লাস, মাদার জনস অ্যাওয়ার্ড, অ্যালেক্সিয়া ফাউন্ডেশন গ্র্যান্টস, ন্যাশনাল জিওগ্রাফিক অল রোডস প্রজেক্ট, সামদানি আর্ট অ্যাওয়ার্ড, পিডিএন ফটো কনটেস্টসহ আলোকচিত্রের প্রায় সব আন্তর্জাতিক পুরস্কার ও স্বীকৃতি অর্জন করেছেন। 

দ্য গার্ডিয়ান, দ্য নিউ ইয়র্কার, টাইম ম্যাগাজিনসহ আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমে পাঠশালার শিক্ষার্থীদের কাজ প্রকাশিত হয়েছে। সারা বিশ্বের অনেক বিশ্ববিদ্যালয়ের সঙ্গে পাঠশালার যৌথ কর্মসূচি চালু আছে।

তবে তাঁর মনে হয় অনেক কিছুই হয়নি। যেমন ছবি তোলা আলোকচিত্র জগতের খুব ছোট একটি অংশ। যে উদ্দেশ্যে ছবি তোলার কথা, সেই চর্চা বোধহয় যথেষ্ট করা হচ্ছে না। আমাদের দেশের আন্দোলনে শিল্পীরা সব সময় বড় ভূমিকা রেখেছেন। এই সময়ে লড়াকু শিল্পীর অভাব। এখানে পাঠশালাও ব্যর্থ—এমনই মনে করেন শহিদুল আলম। বললেন, ‘স্পর্শকাতর বিষয়ে কাজ করছেন না আলোকচিত্রীরা। হয়তো ভাবছেন, নিরাপদ না, সময়টা ভালো না। সময় তো আগেও ভালো ছিল না। কেউ না কেউ লড়াই করে ভালো সময় নিয়ে আসবে, তখন আমি কাজ করব। সেটা কোনো কাজের কথা হলো না। বড় পরিবর্তনের জন্য অন্যের দিকে না তাকিয়ে নিজেকে করতে হবে। পাঠশালা সেই ভূমিকা পালন করতে পারে। তাঁদের অনেক কিছু করার আছে এখানে।’

বাহন হিসেবে দ্বিচক্রযানই প্রিয় তাঁর
বাহন হিসেবে দ্বিচক্রযানই প্রিয় তাঁর

সামাজিক কাজের স্বীকৃতি

কোনো হিসাব করেননি কী কী স্বীকৃতি পেয়েছেন। কত প্রদর্শনী করেছেন সে হিসাবও নেই। বই লেখা হয়েছে কয়টা তা-ও মনে নেই। এবার পেলেন লুসি ফাউন্ডেশনের পুরস্কার। লুসি ফাউন্ডেশন যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক অলাভজনক দাতব্য প্রতিষ্ঠান। এই ফাউন্ডেশন সারা বিশ্বের অগ্রগণ্য আলোকচিত্রীদের নিয়ে এবং একইসঙ্গে সম্ভাবনাময় আলোকচিত্রীদের জন্য কাজ করে। প্রতিষ্ঠানটি আলোকচিত্র–সংশ্লিষ্ট বিভিন্ন বিষয়ে সম্মাননা পুরস্কার দিয়ে থাকে।

এই পুরস্কার পাওয়া নিয়ে শহিদুল আলম বলেন, আলোকচিত্রের জন্য নয়, সামাজিক কাজ করার জন্য এটি পেয়েছি। আলোকচিত্রের তো অনেক পুরস্কার আছে। কিন্তু কী কারণে আমি আলোকচিত্রী, সেটি আমরা অনেকে ভুলে যাই। লড়াই করার জন্য যখন যা দরকার তা-ই বেছে নেব। প্রয়োজনে কলম দিয়ে কবিতা লিখব, গান গাইব।

ব্যক্তিজীবনও নিজের দর্শন দিয়ে পরিচালনা করেন তিনি। শহিদুল আলম বললেন, ‘ব্যক্তিজীবনে আমার ও রেহনুমা আহমেদের মনে হয়েছে নিজেদের সন্তান হলে মানুষ স্বার্থপর হয়ে যায় বা স্বার্থপর হতে বাধ্য হয়। বাচ্চাদের বড় করা একটি কালেকটিভ কাজ। নিজেদের দু–একটা বাচ্চা বড় করার পরিবর্তে আমরা বহু বাচ্চা বড় করা, মানুষ করার দায়িত্বের সঙ্গে যুক্ত হতে চেয়েছি। সেভাবেই জীবন অতিবাহিত করছি। 

সবাইকে নিয়ে...

বই পড়ার সময় পান এখন? ‘পাঠশালা, ছবিমেলা, দৃক ও মেজোরিটি ওয়ার্ল্ড করতে গিয়ে পুরো যেন আমলা হয়ে গেছি। আমি কি পরিচালক হতে চেয়েছিলাম। কিন্তু কাউকে না কাউকে তো দায়িত্ব নিতে হতো। ১ জুলাই থেকে প্রথম ব্যাচের ছাত্র আবীর আবদুল্লাহ পাঠশালার অধ্যক্ষ। এটা আমার জন্য খুব গর্বের বিষয়।’ এ কথা বলতে গিয়ে আবারও আবেগে গলা বুজে আসে শহিদুল আলমের। বলতে থাকেন, ‘আজ কী যেন হয়েছে। বোকা বোকা কাজ করছি। এবারের ১০ম ছবিমেলা আমার পরিচালনায় শেষ ছবিমেলা। এরপর থেকে নতুন পরিচালক করবে। ওরা সব দায়িত্ব নিলে আমি নিজের মতো ছবি তুলব। বই পড়ব, কবিতা লিখব।’ তখনো চোখে কান্নার স্রোত। তবে এ কান্না আনন্দের। সবাইকে নিয়ে এগিয়ে যাওয়ার যে ইচ্ছা শহিদুল আলমের মনে, তা যেন এভাবেই পূরণ হবে।