চাপ যত বাড়ে, খেলা তত সহজ হয়

>
এবারের বিশ্বকাপের উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে রোনালদো
এবারের বিশ্বকাপের উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে রোনালদো
ব্রাজিলের সাবেক ফুটবলার রোনালদো অনেকের চোখেই সর্বকালের অন্যতম সেরা খেলোয়াড়। দুর্দান্ত গতি, অসাধারণ ড্রিবলিং আর নিখুঁত ফিনিশিংয়ের জন্য তাঁর সময়ে তিনি সেরা ছিলেন। যাঁর কাছে ফুটবল মাঠটাই জীবন, ইনজুরির জন্য তাঁকে দীর্ঘদিন খেলার বাইরে থাকতে হয়েছে। ফিরে এসে ব্রাজিলের হয়ে বিশ্বকাপ জিতেছেন ঠিকই। কোন ঘটনা তাঁকে অনুপ্রাণিত করল? পড়ুন দ্য প্লেয়ারস ট্রিবিউনে প্রকাশিত রোনালদোর লেখায়

বিশ্বকাপের কথা ভাবলে আমার মাথায় প্রথমেই যা আসে, তা হলো রং। ছোট ছোট রঙের কৌটা...নীল, সবুজ, হলুদ। কল্পনায় যত উজ্জ্বল রং ভাবা যায়, সব।

বিশ্বকাপ ফুটবল শুরু হওয়ার আগে ব্রাজিলের শহরগুলো রঙিন হয়ে ওঠে। নিজ নিজ এলাকায় দেয়ালচিত্র ও আলপনা আঁকার একটা প্রতিযোগিতা শুরু হয়। ১৯৮২ সালের বিশ্বকাপে আমার এলাকার অন্য শিশুদের মতো আমিও রাস্তায় রং করতে নেমেছিলাম। ছোট-বড় সবাই মিলে দেয়ালচিত্র এঁকেছি। কত রং, কত ছবি—পাখি, ব্রাজিলের পতাকা, জাতীয় দলের খেলোয়াড়।

আমাদের পাড়ায় রেনাটো নামে এক বৃদ্ধ লোক থাকতেন। তাঁর কথা এখন আর খুব ভালো মনে নেই। শুধু মনে আছে, ছোটবেলায় তাঁকে অনেক বড় দেখাত। তিনি সম্ভবত বিমানবাহিনীর অবসরপ্রাপ্ত কর্মকর্তা ছিলেন। আঁকাআঁকি শেষ হলে তিনি ফ্রেঞ্চ ফ্রাই আর সোডা কিনে দিতেন। সে সময় এটা ছিল বিরাট ব্যাপার। এ রকম খাবার আমাদের খুব বেশি খাওয়ার সুযোগ হতো না। বন্ধুদের সঙ্গে ফ্রেঞ্চ ফ্রাই আর সোডা খেতে খেতে ফুটবল ম্যাচ দেখা, আর মনে মনে ভাবা, একদিন আমিও বড় ফুটবলার হব...সে এক অদ্ভুত সময়! এমন একটা দিনও বোধ হয় কাটেনি, যেদিন ফুটবল নিয়ে কোনো কথা হয়নি।

সত্যি বলছি, পাঁচ বছর বয়স হওয়ার আগেই দেখেছি, আমার পৃথিবীটা ফুটবলময়। এটা আমি ঠিক বোঝাতে পারব না। ফুটবল আমার হৃদয়ে শুরু থেকেই ছিল। আমি ফুটবলার হতে চাই—ছেলেবেলায় এই কথা বলা খুব সহজ। কিন্তু এ কথাটার মানে তখন খুব ভালো জানতাম না। বুঝতাম না, এটা কত বড় একটা ব্যাপার। আমি শুধু নিশ্চিন্ত মনে রঙের কৌটায় তুলি ডোবাতাম। হাত দুটো রঙে মাখামাখি করতাম। আর দেয়ালে আঁকা জিকোর ছবিটা আমার দিকে তাকিয়ে থাকত।

তখন জানতাম না, সময় কত দ্রুত কেটে যায়। কীভাবে একটা স্বপ্নই জীবন হয়ে ওঠে।

পাড়ার অন্য ছেলেদের মতো আমি কেবল ফুটবল খেলতাম। সারা দিন...সারা দিন খেলতাম। পেছনে তাকালে মনে হয়, অন্য ছেলেদের তুলনায় আমি ব্যতিক্রম ছিলাম স্রেফ একটা কারণে। সবাই মনে মনে বিশ্বসেরা ফুটবলার হতে চাইত, আর আমি সত্যিই মন থেকে সেটা বিশ্বাস করতাম—একদিন আমি পৃথিবীর অন্যতম সেরা খেলোয়াড় হব! জীবনের প্রথম ফুটবলে লাথি মারার সময় থেকে শুরু করে এটাই ছিল আমার লক্ষ্য।

ছোটবেলায় দুই ভাইয়ের সঙ্গে খেলার সময় আমি গোল করলেই ওরা চিৎকার করে উঠত, ‘দাদাদোওওওও!’ সে সময় রোনালদো শব্দটা উচ্চারণ করতে আমার সমস্যা হতো। এটা শোনাত অনেকটা ‘দাদাদো’র মতো। সেই থেকে আমার ডাকনাম হয়ে গিয়েছিল দাদাদো।

খেলা শেষে ভাইয়েরা যখন ঘরে ঢুকে পড়ত, তখন আমি একাই খেলতাম। ফুটবলে লাথি মারতাম। একবার ডান পায়ে, এরপর বাঁ পা, ডান পায়ে, বাঁ পায়ে...। বাড়িতে একটা উঠান ছিল। আর আমার চাওয়া ছিল শুধু এটুকুই—ফুটবল খেলার একটা জায়গা। পেয়ারা, আম...আরও নানা ফলের গাছ ছিল। ভাইয়েরা চলে গেলে আমি গাছগুলোর সঙ্গে ড্রিবলিং করতাম।

১৯৯৪ সাল। ব্রাজিল দলের সঙ্গে প্রথম বিশ্বকাপে গেলাম। আগেই বলেছি, সময় কেটে গেছে খুব দ্রুত। পেশাগত ফুটবলার হতে কী কী করতে হয়, আমি কিছুই জানতাম না। কোনো পরিকল্পনা ছিল না, হ্যান্ডবুক ছিল না। যেন আমার উঠানে কিংবা স্কুলের মাঠে খেলতে খেলতে হঠাৎ এক দিন আবিষ্কার করলাম, আমি বেবেতোর সঙ্গে অনুশীলন করছি!

সেই বিশ্বকাপে আমি মাঠে এক মিনিটের জন্যও খেলার সুযোগ পাইনি। কিন্তু নোট নিয়েছি, তথ্য সংগ্রহ করেছি। জানতাম, বিশ্বকাপের মাঠে আমি আবার ফিরে আসব।

১৯৯৮-এর বিশ্বকাপের সময় আমার বয়স মাত্র ২১। তখনো স্রেফ মজা করে ফুটবল খেলতাম। ফাইনালে পৌঁছানোর আগে আমি সেবার ৪ গোল করেছিলাম। কিন্তু ফাইনালের দিন আমার কী যেন কী হলো, ঠিক বর্ণনা করতে পারব না। ভীষণ অসুস্থ হয়ে বিছানায় পড়ে রইলাম। খুব ভালো মনে নেই। শেষ পর্যন্ত কিছু পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে চিকিৎসকেরা আমাকে খেলার অনুমতি দিলেন।

অবশ্যই ভালো খেলতে পারিনি। দিন শেষে ফ্রান্সের সঙ্গে আমরা ৩-০ গোলে হেরেছি।

সময়টা খুব খারাপ ছিল। কিন্তু আমার ভেতর তখন তারুণ্যের জয়গান। মনে মনে বলছিলাম, আরও কত বিশ্বকাপ আসবে, কত সুযোগ সামনে পড়ে আছে! জীবনটা তো এমনই, তাই নয় কি?

সে বছরই আমার হাঁটুতে খুব খারাপভাবে আঘাত পেলাম। কেউ কেউ বলেছিল, আমি আর কোনো দিন ফুটবল খেলতে পারব না। আমি আর কোনো দিন হাঁটতে পারব না, এমনটাও বলেছিল কেউ কেউ।

শুরু হলো কঠিন পরীক্ষা।

ফুটবল খেলতে গিয়ে অনেক কিছুই আমাকে বিরক্ত করেছে। একের পর এক ভ্রমণ, দীর্ঘ অপেক্ষা...কিন্তু মাঠের সময়টুকু আমি সব সময় উপভোগ করেছি। হোক সেটা ক্লাবের খেলা, জাতীয় দলে খেলা, আমি সব সময় সেই ছেলেমানুষি আনন্দটাই পেয়েছি। আমার মনে হতো জীবনের শুরু হয়েছে ফুটবল মাঠে, শেষও এখানেই। তাই যখন হাঁটুটা গুঁড়িয়ে গেল, মনে হলো আমার জীবনটাও যেন এখানেই শেষ।

অতএব জীবন ফিরে পেতে যা কিছু করার, আমি সব করলাম। যুক্তরাষ্ট্রে গিয়ে চিকিৎসকদের সঙ্গে দেখা করলাম। পৃথিবীর নানা প্রান্তে গেলাম। নিজেকে ফিরে পেতে পেতেই কেটে গেল প্রায় তিন বছর। আমি জানতাম, ২০০২ সালের বিশ্বকাপ আসছে সামনে। কিন্তু শিরোপা, গোল...এসব কিছুই আমাকে অনুপ্রাণিত করেনি। আমি শুধু পায়ে ফুটবল পাওয়ার অনুভূতিটা মনেপ্রাণে ফিরে পেতে চেয়েছি। অবশেষে ১৯৯৮ সালের বিশ্বকাপের চার বছর পর, এবং আমার ইনজুরির তিন বছর পর আবার মাঠে ফিরলাম।

জার্মানির সঙ্গে ফাইনালের আগে একটা বিস্ময়কর ঘটনা ঘটল। আমরা যখন চেঞ্জিং রুমে ঢুকেছি, ম্যানেজার লুই ফিলিপ স্কলারি বললেন, টিভিতে তিনি আমাদের একটা কিছু দেখাতে চান। আমরা পরস্পর মুখ চাওয়া-চাওয়ি করলাম। বুঝলাম না কী হচ্ছে। চেঞ্জিং রুমে টিভি—ব্যাপারটা খুব স্বাভাবিক নয়।

‘বসো।’ লুই বললেন, ‘আমি তোমাদের কিছু দেখাতে চাই।’

তিনি টিভি অন করলেন। দেখলাম ব্রাজিলের টিভি চ্যানেল গ্লোবো থেকে নেওয়া একটা ভিডিও ক্লিপ। আমরা যেহেতু জাপানে খেলছিলাম, অনেক দিন নিজ দেশের টিভি চ্যানেল দেখা হয়নি।

টিভির অনুষ্ঠানটিতে একে একে আমাদের প্রত্যেকের গ্রামের বাড়ি দেখানো হচ্ছিল। আমরা সবাই টিভিতে দেখলাম, কীভাবে আমাদের প্রতিবেশীরা বিশ্বকাপটা উদ্‌যাপন করছে। একসময় ওরা আমার গ্রাম বেনতো রিবেরিওতে পৌঁছাল। যে রাস্তায় আমি ফুটবল খেলতাম, যে দেয়ালকে গোলপোস্ট বানিয়ে আমি ফুটবলে লাথি মারতাম, সব চলে এল আমার চোখের সামনে।

আমি দেখলাম, ছোট ছোট ছেলেমেয়েরা দেয়ালে আমার ছবি এঁকেছে, ঠিক যেমনটা একসময় আমি আঁকতাম।

মাঠে নামার আগে এটাই ছিল আমাদের শেষ প্রস্তুতি।

হাফ টাইমের পর স্কোরবোর্ডে তখন ০-০। অথচ আমাদের মধ্যে কোনো দুশ্চিন্তা কাজ করছিল না। সত্যি বলছি, আমরা নিজেদের মধ্যে খুব বেশি কথা বলিনি। তেমন কোনো পরিকল্পনাও ছিল না। কী করতে হবে, আমরা জানতাম। জানতাম, আমরা গোল করব এবং জিতব। কেবল এই বিশ্বাসটা আমাদের মধ্যে ছিল।

টুর্নামেন্টজুড়েই আমরা ভেবেছি: প্রতিটা ম্যাচ আমাদের। আমরা যে সেরা, এটা কাউকে বলতে হয়নি; দলের সবাই অনুভব করেছে। আমার জীবনের সেরা দল সম্ভবত এটাই। অন্যদের জন্য ব্যাপারটা কেমন আমি জানি না। কিন্তু আমার কাছে মনে হয়, চাপ যত বাড়ে, খেলা তত সহজ হয়। আমি আশপাশটা আরও পরিষ্কার দেখতে পাই।

আমি শুধু মনকে শান্ত রেখেছি। আর বুক ভরে দম নিয়েছি। আমার মনে হয় ভালো স্ট্রাইকারের গুণ এটাই: আবেগে টইটম্বুর থাকো, কিন্তু সেটা নিয়ন্ত্রণ করার কৌশলটাও জানো।

২০১১ সালে আমাকে একটা কঠিন সিদ্ধান্ত নিতে হলো। জানতাম, একদিন ফুটবলকে বিদায় জানাতেই হবে। অন্তত মাঠে আমার সময় ফুরাবে। কিন্তু ফুটবল একটা নেশা। খেলোয়াড়দের জন্য, ভক্তদের জন্য, সবার জন্য। সে জন্যই এটা পৃথিবীর এত মানুষের মনোযোগ ধরে রাখে।

আমার সবচেয়ে ভালো লাগে তখন, যখন শুনি মেসি, নেইমার, ক্রিস্টিয়ানো রোনালদোর মতো খেলোয়াড়েরা বলে, তাঁদের জীবনে আমার যথেষ্ট প্রভাব আছে। ছোটবেলায় ওরা আমার মতো হতে চেয়েছে। ঠিক যেমন আমি ছেলেবেলায় জিকোর মতো হতে চাইতাম। ব্রাজিল, আর্জেন্টিনা, পর্তুগাল, সুইডেনের ছেলেমেয়েরা আমার মতো খেলোয়াড় হতে চায়, এই আবেগটা আমি খুব ভালো বুঝতে পারি।

আমার কাছে এটাই সবচেয়ে সুন্দর। এটাই ফুটবল।

শেষ করব একটা কথা বলে: আমি আমার স্বপ্নে বেঁচেছি। পৃথিবীতে কয়টা মানুষই বা এ কথা বলার সুযোগ পায়? এত রং দেখার, এত রঙের মধ্যে বাঁচার সুযোগ কজনেরই বা হয়!

(সংক্ষেপিত)

ইংরেজি থেকে অনুবাদ: মো. সাইফুল্লাহ