পাশে দাঁড়ালেন পারভেজ

পারভেজ হাছানের ভিডিওতে দেখা যাচ্ছে এভাবেই মায়ের মাথায় পানি ঢালছে শিশুটি
পারভেজ হাছানের ভিডিওতে দেখা যাচ্ছে এভাবেই মায়ের মাথায় পানি ঢালছে শিশুটি

ফুটপাতে অসুস্থ নারীর মাথায় বোতল থেকে পানি ঢালছিল ছোট এক শিশু। পারভেজ হাসান সেই দৃশ্য মুঠোফোনে ধারণ করলেন। বাসায় ফিরে ভিডিওর সঙ্গে নিজের অভিজ্ঞতার কথা লিখলেন ফেসবুক প্রোফাইলে। তাতেই মাথা গোঁজার ঠিকানা পেল অসহায় পরিবারটি।

ধানমন্ডির পুরোনো ২৮ নম্বর সড়ক থেকে সোবহানবাগ মসজিদ হয়ে ধানমন্ডি লেক। ফুটপাত ধরেই এই গন্তব্যে যান পারভেজ হাসান। প্রতিদিন নয়, সপ্তাহে দুদিন। এই দুদিনই গ্রাফিকস ডিজাইনের ক্লাস করতে সাভার থেকে ঢাকায় আসেন তিনি। ক্লাস শেষে বিকেলে কিছুটা সময় কাটান ধানমন্ডি লেকে। তারপর বাস ধরেন সাভারের।

৬ জুলাই বিকেলেও ওই পথেই যাচ্ছিলেন। সোবহানবাগ মসজিদ পেরিয়ে খানিকটা সামনে যেতেই থমকে দাঁড়াতে হলো পারভেজকে। দাঁড়াতে হলো ফুটপাতের এক করুণ দৃশ্য দেখে। জীর্ণ কাপড়ে হাড্ডিসার এক নারী শুয়ে আছেন। দেখে মনে হয় অচেতন। প্রায় জট বাঁধা চুলে বোতল হাতে পানি ঢালছে এক শিশু। দৃশ্যটা এগোতে দিল না পারভেজকে। তিনি দুই কদম এগিয়ে সেখানে গেলেন। শিশুর কাছে জানতে চাইলেন, কী হয়েছে।

কয়েক দিন ধরে জ্বর। ভিক্ষা করতে করতে কলাবাগান থেকে এটুকু এসেছেন ওই নারী। এখন বেঘোরে পড়ে আছেন। চিকিৎসা তো হয়ইনি, ভিক্ষা না করায় খাবার কেনারও অর্থ নেই। শিশুর কাছে তার মা ফরিদা বেগম সম্পর্কে এসব কথা শুনে, পারভেজ মাথায় হাত দিয়ে দেখেন, জ্বরে পুড়ে যাচ্ছে। তিনি ওষুধ আর কিছু খাবার কিনে দিলেন।

এক ফাঁকে মাথায় পানি ঢালার দৃশ্যের ভিডিও ধারণ করেছিলেন পারভেজ। রাতে বাসায় ফিরে সেটা দিলেন নিজের ফেসবুক প্রোফাইলে। মানবিক গল্পের ভিডিওটি রাতের মধ্যেই ছড়িয়ে পড়ল। অনেকে সহায়তার আগ্রহ প্রকাশ করে পারভেজকে বার্তা পাঠালেন।

ঢাকায় অসহায় পরিবারটির সঙ্গে পারভেজ
ঢাকায় অসহায় পরিবারটির সঙ্গে পারভেজ

পারভেজ হাসান বলছিলেন, ‘আমি তো ফ্রিল্যান্স কাজ করি। কাজটাও রাতে। তাই দিনের অনেকটা সময় ঘুমিয়ে থাকি। সেদিন ঘুম থেকে উঠে দেখি, ভিডিওটি অনেকে শেয়ার করেছেন, মন্তব্য করেছেন, সাহায্য করার আগ্রহ প্রকাশ করেছেন।’

পারভেজ পরদিন আবার চলে এলেন। এবার সোবহানবাগ মসজিদ নয়, দেখা পেলেন তাঁদের থাকার জায়গায়। ধানমন্ডি ক্রীড়াচক্রের সামনের ফুটওভার ব্রিজের নিচে পলিথিনে মোড়ানো খুপরিতে দুই মেয়ে, এক ছেলে আর হৃদ্‌রোগে আক্রান্ত স্বামীকে নিয়ে ওই নারীর বাস। পারভেজ এসে দেখেন, তাঁর ভিডিও দেখে চারজন তরুণ এসেছেন। নারী তখনো অসুস্থ। তবে গত দিনের মতো অচেতন নন। রাতে ওষুধ আর খাবার খেয়ে চোখ মেলতে পারছেন। পাঁচজন মিলে তাঁকে নেওয়া হলো ধানমন্ডির গণস্বাস্থ্য নগর হাসপাতালে। প্রাথমিক চিকিৎসার পর বিশ্রামে থাকার পরামর্শ দিলেন চিকিৎসক। প্রয়োজনীয় খাবার, ওষুধসহ রেখে আসা হলো অস্থায়ী ঘরে।

ভিন্ন কিছু হোক
এখানেই ঘটনার সমাপ্তি হতে পারত কিন্তু ততক্ষণে পারভেজ জেনেছেন ফরিদা বেগম আর তাঁর পরিবারের করুণ গল্প। পারভেজ বলছিলেন, একসময় তাঁদের অবস্থা এমন ছিল না। আবাদি জমি ছিল। সবকিছু নদীর পেটে গেছে। তাঁরা পেটের দায়ে এখানে এসেছেন। ভিক্ষা করছেন। তিনি ভাবলেন, যাঁরা সাহায্য করতে চাচ্ছেন, এই সাহায্যে হয়তো সাময়িক ব্যবস্থা হবে। কিন্তু স্থায়ী ব্যবস্থা করতে পারলে ভিক্ষাবৃত্তি বন্ধ করে নতুন জীবন পাবে পরিবারটি।

পারভেজ ফেসবুকে এসব কথা লিখলেন। পাশে দাঁড়ানোর আহ্বান জানালেন সামর্থ্যবান মানুষদের, প্রতিষ্ঠানের কর্তাদের, বিশেষ করে কুড়িগ্রামের মানুষদের। কারণ, অসহায় পরিবারটি নিঃস্ব হয়ে এসেছে কুড়িগ্রামের এক গ্রাম থেকে। তাঁর পোস্ট নজরে এসেছিল ঢাকার কুড়িগ্রাম সমিতির নেতাদের। সমিতির মাধ্যমে এগিয়ে আসেন কুড়িগ্রামের জেলা প্রশাসক সুলতানা পারভীন। পুরো পরিবারকে পুনর্বাসনের দায়িত্ব নিল জেলা প্রশাসন। ১২ জুলাই ফরিদা বেগম ও তাঁর পরিবার ঢাকার করুণ জীবন ফেলে কুড়িগ্রামের বাসে উঠল। পারভেজ তৃপ্তির হাসি নিয়ে বাসায় ফিরলেন সে রাতে। বলছিলেন, ‘একটা অসহায় পরিবারকে সাহায্যের ব্যবস্থা করতে পেরে আমি ভীষণ আনন্দিত।’

পারভেজ হাছান। ছবি: আশরাফুল আলম
পারভেজ হাছান। ছবি: আশরাফুল আলম

পারভেজের ফেলে আসা দিনগুলো
হাস্যোজ্জ্বল, প্রাণদীপ্ত পারভেজের যে অসহায় অতীত আছে, তা ধরা দিল কথায় কথায়। ১৯৯৭ সালে চাঁদপুর সদর উপজেলায় পারভেজের জন্ম। বেড়ে ওঠার দিনগুলোতে পারভেজ আঁচ করতে পেরেছেন দারিদ্র্য। বলছিলেন, ‘আমার জন্মের পরপরই আমার পরিবারে অন্ধকার নেমে আসে।’

পারভেজের মা-বাবা বাধ্য হয়ে সাভারে চলে আসেন। ফের ঘুরে দাঁড়ানোর চেষ্টা তাঁদের। কিন্তু পারভেজকে রেখে আসেন গ্রামেই। নানির কাছে। সেখানেই স্কুলে ভর্তি করানো হয়। পঞ্চম শ্রেণি পর্যন্ত গ্রামের স্কুলেই কাটে। পারভেজ বলেন, ‘নানার বাড়ি থাকি বলে আশপাশের মানুষ নানা কথা বলত। কটু মন্তব্য করত। খুব কষ্ট হতো তখন। কিন্তু নানি বোঝাতেন মানুষের কথায় মন খারাপ না করতে।’

একসময় পারভেজের মামা তাঁকে ঢাকায় আনেন স্কুলে ভর্তি করাবেন বলে। কিন্তু স্কুলে পা দেওয়া হয় না। মামা কাজ দেন রাজধানীর শাহবাগে নিজের চায়ের দোকানে। বিনিময়ে জুটত থাকা-খাওয়া; মাস শেষে মায়ের হাতে তুলে দেওয়া হতো এক হাজার টাকা। পারভেজ বলেন, ‘খুব স্কুলে যেতে ইচ্ছা করত, কিন্তু যেতে পারতাম না। স্কুলে না গেলেও নিজে নিজে বই পড়তাম। আশপাশের দোকান থেকে নিয়ে প্রচুর পত্রিকা পড়তাম।’

পড়ুয়া মনটাই স্বপ্ন দেখায় পারভেজকে। তিন বছর চায়ের দোকানে কাটানোর পর কাজ নেন রাজধানীর এক রেস্তোরাঁয়। সেখানে অল্প দিনেই রান্নার কাজ শিখে ফেলেন। ভালো সম্মানী পেয়ে রেস্তোরাঁ বদলান। কিছুদিন কাজ করে ভালো একটা পুঁজি হয় তাঁর। ‘তখন নিজেই কিছু করার কথা চিন্তা করলাম। এক মামার সহায়তায় কাজও জুটল। জেলায় জেলায় অনুষ্ঠিত মেলাগুলোতে স্টল নিতাম। খাবারের দোকান দিতাম। ভালো আয় হতো তখন।’ বলেন পারভেজ।

তত দিনে পরিবারে কিছুটা সচ্ছলতা ফিরেছে। ছোট বোনেরও বিয়ে দিয়েছেন। পড়াশোনার স্বপ্নটা নতুন করে উঁকি দিচ্ছিল মনের ভেতর। তারও আগে পারভেজের পেশা বদল হয়েছে। পত্রিকায় ফ্রিল্যান্সিংয়ে তরুণদের সাফল্যের খবর পড়ে নিজেও কাজটি করার চেষ্টা করেন তিনি। ‘আমার কম্পিউটার ছিল। অনেক সময় ব্যয় করতাম। পত্রিকার খবরগুলো আমাকে অনুপ্রাণিত করত। তখন কীভাবে ফ্রিল্যান্স কাজ করা যায়, সেসব গুগল করে জানার চেষ্টা করলাম।’

চেষ্টার শুরুটা ২০১৫ সালে, ২০১৬ সালে প্রথম কাজের সুযোগ পান ফ্রিল্যান্সার হিসেবে। এখনো সে কাজই করছেন। সাভারের ছায়াবীথি এলাকায় তাঁদের বাসা। পরিবারের সঙ্গে সেখানেই তিনি থাকেন। উন্মুক্ত বিশ্ববিদ্যালয়ের এসএসসি প্রোগ্রামে ভর্তি হয়েছেন। স্বপ্ন দেখছেন সুন্দর ভবিষ্যতের।

কুড়িগ্রামের অস্থায়ী বাড়িতে স্বামী–সন্তানসহ ফরিদা বেগম
কুড়িগ্রামের অস্থায়ী বাড়িতে স্বামী–সন্তানসহ ফরিদা বেগম

কেমন আছে ফরিদার পরিবার

সফি খান, কুড়িগ্রাম

তখন মধ্যদুপুর। ১৭ জুলাই কড়া রোদ মাথায় নিয়ে হাজির হয়েছিলাম ফরিদা বেগম আর আনছার আলীর ঘরে। আধা পাকা টিনশেড ঘরের ভেতরে পরিবারের সবাই তখন দুপুরের খাবার খাচ্ছিল। ভাতের সঙ্গে আলুভর্তা ও ডাল। কুড়িগ্রাম সদর উপজেলার পাঁচগাছি ইউনিয়নের শুলকুর বাজার ঝাকুয়াপাড়ায় এই বাড়িতেই অস্থায়ী থাকার ব্যবস্থা হয়েছে তাঁদের।

ফরিদা বেগম এখনো অসুস্থ। শরীর দুর্বল। দুই বাচ্চার জ্বর-সর্দি হয়েছে। তিনি বললেন, ‘এখানে আসার পর ডিসি আপা (সুলতানা পারভীন) আর ইউএনও (সদর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা আমিন আল পারভেজ) সাহেব দেখতে আসেন। খোঁজখবর নেন। টাকা পাঠান। তাঁরা বলেছেন, জমি ও ঘর তুলি দিয়ে হামার স্বামীকে চলার ব্যবস্থা করে দেবেন।’

১২ জুলাই পরিবারটিকে ঢাকা থেকে রাতের বাসে উঠিয়ে দেন ঢাকার কুড়িগ্রাম সমিতির মহাসচিব সাইদুল আবেদীন, যুগ্ম সম্পাদক এইচ এম জগলুল হক ও দপ্তর সম্পাদক আবদুল কাইয়ুম। ১৩ জুলাই সকালে বাস থেকে নেমে কুড়িগ্রাম প্রেসক্লাবে এসে বিশ্রাম নেয় পরিবারটি। সকাল নয়টায় পুরো পরিবারের স্বাস্থ্য পরীক্ষা করে প্রয়োজনীয় ওষুধ দেন সিভিল সার্জন এস এম আমিনুল ইসলামের নেতৃত্বে একটি চিকিৎসাদল। এ সময় প্রাথমিকভাবে পরিবারের খাবারের জন্য প্রয়োজনীয় চাল, ডাল, তেল, লবণসহ সব উপকরণ সরবরাহ করেন কুড়িগ্রাম জেলা গণকমিটির সাধারণ সম্পাদক মো. তাজুল ইসলাম।

জেলা প্রশাসক সুলতানা পারভীন বলেন, ‘সরকার প্রত্যেক নাগরিকের মৌলিক অধিকার সংরক্ষণে কাজ করে যাচ্ছে। আমাদের সবার উচিত সরকারের এ কাজে সহযোগিতার হাত বাড়ানো। অসহায় ফরিদার পরিবারকে জমিসহ স্থায়ী আবাসনের ব্যবস্থা করে দেওয়া হবে। একই সঙ্গে করা হবে কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা। তাঁদের তিন সন্তানকে স্কুলে ভর্তির উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে।’

কুড়িগ্রামের উলিপুর উপজেলার প্রত্যন্ত বেগমগঞ্জ ইউনিয়নের মরাকাটা গ্রামে আনছার আলীর বাড়ি। এলাকাটি এখন ব্রহ্মপুত্র নদের পেটে। আনছার আলী একসময় চর থেকে দুধ সংগ্রহ করে কুড়িগ্রাম শহরে এনে বিক্রি করতেন। ২০১৬ সালে বসতভিটা ও আবাদি জমি নদে বিলীন হয়ে গেলে তিনি নিঃস্ব হয়ে যান। আনছার আলী বলেন, ‘বসতভিটা হারিয়ে চর ইসলামপুরে এক বাড়ির গোয়ালঘরে এক মাস থাকার পর ঢাকায় চলি যাই।’

দুবছর পর আবার তাঁরা দেখছেন সুদিনের স্বপ্ন। এই স্বপ্ন দেখাচ্ছেন অনেকে। কুড়িগ্রামের জেলা প্রশাসক থেকে অচেনা তরুণ। তবে স্বপ্নের সুযোগটা তৈরি করে দিলেন পারভেজ হাছান, যিনি নিজেও নতুন করে স্বপ্ন বুনছেন।