নারী খেলোয়াড়দের পারিশ্রমিক কম

এশিয়া কাপে চ্যাম্পিয়ন হয়ে দেশকে আনন্দিত করেছিলেন নারী ক্রিকেটাররা। কিন্তু তাঁদের কম পারিশ্রমিক বিস্মিত করেছিল অনেককে। ছবি: সংগৃহীত
এশিয়া কাপে চ্যাম্পিয়ন হয়ে দেশকে আনন্দিত করেছিলেন নারী ক্রিকেটাররা। কিন্তু তাঁদের কম পারিশ্রমিক বিস্মিত করেছিল অনেককে। ছবি: সংগৃহীত
>
  • প্রশ্ন শুনলে বিব্রত হন সাবিনা
  • জানেন, পুরুষ ফুটবলারদের তুলনায় আর্থিক সুযোগ-সুবিধায় কতখানি পিছিয়ে মেয়েরা
  • বাংলাদেশের নারী খেলোয়াড়েরা বঞ্চিত

কোনো অনুষ্ঠানে গেলে সাবিনা খাতুনকে প্রায়ই প্রশ্নটার মুখোমুখি হতে হয়, ‘খেলাধুলা করে তুমি কত টাকা পাও?’ বাংলাদেশ জাতীয় নারী ফুটবল দলের অধিনায়ক ঠিকমতো উত্তর দিতে পারেন না। বিব্রত সাবিনা নিজেও জানেন, পুরুষ ফুটবলারদের তুলনায় আর্থিক সুযোগ-সুবিধায় কতখানি পিছিয়ে মেয়েরা। তাই তো এসব তথ্য জানাতেও লজ্জা পান সাতক্ষীরার এই মেয়ে।

শুধু সাবিনাই নন, এমন পরিস্থিতির মুখে পড়তে হয় দেশের অন্য সব খেলায় অংশ নেওয়া বেশির ভাগ মেয়েরই। যেন অদৃশ্য এক বৈষম্যের অচলায়তনে বন্দী, বঞ্চিত বাংলাদেশের এই নারী খেলোয়াড়েরা।

সত্যিই তো ক্রিকেটার সাকিব আল হাসান, তামিম ইকবালদের তুলনায় বার্ষিক আয়ে একেবারেই নস্যি ক্রিকেটার সালমা খাতুনেরা। ফুটবলেও নিয়মিত রেকর্ড পারিশ্রমিক গড়ে ক্লাব বদল করছেন মামুনুল ইসলাম, তপু বর্মণেরা। কিন্তু সাবিনা, সালমাদের শুধুই চেয়ে থাকতে হয় ক্রিকেট বোর্ড ও ক্লাবের কর্তাদের দিকে।

গত মৌসুমে প্রিমিয়ার ক্রিকেট লিগের সর্বোচ্চ পারিশ্রমিক পেয়েছেন রুমানা আহমেদ। রূপালী ব্যাংকের হয়ে খেলা এই অলরাউন্ডার পেয়েছিলেন ৭ লাখ টাকা। একমাত্র ব্যতিক্রমই বলতে হবে ঘটনাটি। কিন্তু এমন অনেক ক্লাব রয়েছে, যারা পুরো দলই গড়েছে মাত্র ২ থেকে ৩ লাখ টাকা দিয়ে! অনেক ক্লাব কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে অভিযোগ, মেয়েদের বিনা পারিশ্রমিকেই নাকি খেলিয়ে থাকেন। শুধু যাতায়াত ভাড়াটা দেওয়া হয় তাঁদের।

নারী ক্রিকেটটা যা–ও বা মাঠে রয়েছে, কিন্তু ফুটবলে সর্বশেষ নারী লিগ হয়েছে ২০১৩ সালে। এরপর থেকে নিয়মিত মাঠে গড়াচ্ছে না লিগ। এই নিয়ে আক্ষেপের শেষ নেই সাবিনার, ‘আমাদের অনেক মেয়ে বিজেএমসিতে চাকরি করছে স্বল্প বেতনে। কিন্তু আগামী মৌসুমে খেলা না থাকলে চাকরিতেও নাকি রাখবে না ওরা। ফুটবল খেলে আমরা আহামরি কিছু চাই না। আমরা চাই লিগটা অন্তত যেন মাঠে গড়াক।’ কোথায় ছেলেদের সমান টাকাপয়সা পাচ্ছেন না বলে দুঃখ করবেন উল্টো বললেন, ‘আমাদের বেতনটা সম্মানজনক হলেই খুশি।’

হাতে গোনা কিছু নারী ফুটবলার রয়েছেন, যাঁরা জাতীয় ও বয়সভিত্তিক দলগুলোর প্রতিনিধিত্ব করেন। এই মেয়েরা রয়েছেন বাংলাদেশ ফুটবল ফেডারেশনের তত্ত্বাবধানে। বাফুফে ভবনে সারা বছর চলে তাঁদের আবাসিক ক্যাম্প। বিভিন্ন আন্তর্জাতিক টুর্নামেন্টের সাফল্যের পর পৃষ্ঠপোষক প্রতিষ্ঠান ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার কাছ থেকে কিছু আর্থিক প্রণোদনা পেয়ে থাকেন এই মেয়েরা। তবে সারা দেশে ছড়িয়ে–ছিটিয়ে থাকা মেয়েদের অবস্থা একেবারে সঙিন। শুধু খেলা ভালোবেসেই অনেকে ফুটবলে আসেন, কিন্তু ছেলেদের তুলনায় আর্থিক বৈষম্যের কারণে কোনো সুযোগ-সুবিধাই সেভাবে পান না।

জাতীয় দলের হ্যান্ডবল খেলোয়াড় ডালিয়া আক্তারের দুঃখ একটু বেশি। গত ১০ জুন এশিয়া কাপে চ্যাম্পিয়ন হওয়া বাংলাদেশ জাতীয় নারী ক্রিকেট দলকে সম্প্রতি সংবর্ধনা দিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী। সালমাদের হাতে প্রধানমন্ত্রী সেদিন তুলে দেন দুই কোটি টাকার আর্থিক পুরস্কার। দলটি এরপর টি–টোয়েন্টি বিশ্বকাপের চূড়ান্ত পর্বে উঠেছে ১২ জুলাই। ওদিকে ২০১৫ সালে আইএএইচএফ (আন্তর্জাতিক হ্যান্ডবল ফেডারেশন) ট্রফির আঞ্চলিক চ্যাম্পিয়ন হয়েছিল নারী হ্যান্ডবল দল। ডিসেম্বর মাসে পাকিস্তানের মাটিতে হারিয়েছিল পাকিস্তানকে। আর্থিক পুরস্কার তো দূরের কথা, ওই টুর্নামেন্টের পর এতটুকু সংবর্ধনাও জোটেনি মেয়েদের ভাগ্যে। দুঃখ করে ডালিয়া বলছিলেন, ‘আমরা যে চ্যাম্পিয়ন হয়েছিলাম, সেটা কেউ জানেওনি। ফেডারেশন আমাদের যে আর্থিক অনুদান দিয়েছিল, সেটা বলতেও লজ্জা লাগে।’

হ্যান্ডবলেও নিয়মিত লিগ হয় না। ছেলেদের তুলনায় মেয়েরা এখানেও বঞ্চিত। ২০১৪ সালে হওয়া সর্বশেষ নারী হ্যান্ডবল লিগে সর্বোচ্চ পারিশ্রমিক পেয়েছিলেন মোহামেডানের ডালিয়া। সেটাও মাত্র ৬৫ হাজার টাকা! অথচ ছেলেরা সেই তুলনায় অনেক বেশি টাকা উপার্জন করছে হ্যান্ডবল খেলে। খেলাধুলায় ছেলে ও মেয়েদের মধ্যে পারিশ্রমিকের এমন তফাতে হতাশ ডালিয়া। তিনি বললেন, ‘এটা আমাদের জন্য লজ্জাজনক। ছেলেদের মতো আমরাও তো সাফল্য এনে দিই দেশকে। অথচ ছেলেদের চেয়ে অনেক বেশি পরিশ্রম করে খেলি আমরা। কিন্তু আর্থিক পুরস্কারের বেলায় কেন এমন বৈষম্য?’

ব্যাডমিন্টনে দেশের সেরা নারী খেলোয়াড় শাপলা আক্তার। ছয়বার ত্রি–মুকুট জিতেছেন জাতীয় পর্যায়ে। সব মিলিয়ে সাতবারের জাতীয় চ্যাম্পিয়ন শাপলা ছেলেমেয়ের পারিশ্রমিকের এই বিভাজনে খুব হতাশ, ‘দল গড়ার সময়ই আমাদের বলে দেয়, তোমরা এত টাকা পাবে। আমরা চাইলেও ক্লাব কর্মকর্তাদের সঙ্গে তর্ক করতে পারি না।’ ব্যাডমিন্টনে বেশির ভাগ ক্লাবই এক বছরের জন্য চুক্তি করে মেয়েদের সঙ্গে। সর্বোচ্চ ২ লাখ টাকা পান নিট কনসার্নের হয়ে খেলা শাপলা। কিন্তু এক বছরে একজন পুরুষ শাটলারের সঙ্গে ক্লাবগুলো ৬-৭ লাখ টাকায় চুক্তি করে থাকে।

খেলাধুলায় ছেলে আর মেয়েদের পারিশ্রমিকের এমন বৈষম্য দেখতে চান না সাউথ এশিয়ান গেমসের সোনাজয়ী ভারোত্তোলক মাবিয়া আক্তার, ‘আমরা একটা টুর্নামেন্টে সর্বোচ্চ ১০-১২ হাজার টাকা প্রাইজমানি পাই। কিন্তু সুযোগ-সুবিধা সব সময়ই ছেলেরা বেশি পেয়ে আসে। অথচ ওদের তুলনায় আমরা মোটেও কম কষ্ট করি না। খেলার মাঠে এমন বৈষম্য দেখলে সত্যি কষ্ট হয়। মেয়ে হয়ে জন্মেছি, সেটা তো আমার দোষ না।’

‘গ্র্যান্ড স্লামে কেন ছেলেদের সমান প্রাইজমানি পাবে মেয়েরা?’ বছর দুয়েক আগে এমন একটা প্রশ্ন তুলে বেশ সমালোচনার মুখে পড়েছিলেন টেনিস তারকা নোভাক জোকোভিচ। ১২টি গ্র্যান্ড স্লামের মালিক জোকোভিচ না চাইলেও প্রাইজমানির বেলায় এমন বৈষম্য ২০০৭ সাল থেকেই তুলে দিয়েছে আন্তর্জাতিক টেনিস ফেডারেশন (আইটিএফ)। সাবিনা, সালমারাও স্বপ্ন দেখেন বাংলাদেশের খেলাধুলায় একদিন এমন একটা মুহূর্ত আসবে, যেদিন পারিশ্রমিকের বেলায় এক মোহনায় দাঁড়াবেন সব খেলোয়াড়।

বৈষম্যের এই অচলায়তন ভেঙে মেয়েরাও যেন সমান পারিশ্রমিক পান, সেটাই চাওয়া জাতীয় নারী ক্রিকেটার সাথিরা জাকির জেসির, ‘মাঠে যখন খেলতে নামি, ছেলেদের চেয়ে কষ্টটা কম হয় না। কিন্তু আমাদের বেতন কাঠামোতেই বড় রকমের বৈষম্য। শুনেছি বিসিবি মেয়েদের জাতীয় দলের ক্রিকেটারদের মাসিক বেতন ৩০ হাজার টাকা থেকে বাড়িয়ে ৫০ হাজার করার প্রস্তাব করেছে। এটা যদিও আমাদের জন্য যথেষ্ট না। শুধু ক্রিকেটের কথা বলব না, আমি চাই সব খেলাতেই এই বৈষম্য দূর হোক।’