রাষ্ট্রপতির আমন্ত্রণে...

রাষ্ট্রপতি হালিমা ইয়াকুবের সঙ্গে অতিথিরা। ছবি: লেখক
রাষ্ট্রপতি হালিমা ইয়াকুবের সঙ্গে অতিথিরা। ছবি: লেখক
>

১৪ জুলাই সিঙ্গাপুরে অনুষ্ঠিত হলো ইন্টার রেসিয়াল ইন্টার রিলিজিয়াস হারমনি নাইট। সে দেশের রাষ্ট্রপতি হালিমা ইয়াকুবের আমন্ত্রণে অনুষ্ঠানে উপস্থিত ছিলেন সিঙ্গাপুরে বসবাসরত বাংলাদেশের এক দল তরুণ। তাঁদের মধ্যে একজন তাসরিফ আহমেদ

শনিবারগুলো বরাবরই আমার কাছে একটু বিশেষ। ১৪ জুলাই বিকেলে ‘১৭০’ বাসে চেপে বসলাম, গন্তব্য বুকিত পানজাং হয়ে সিঙ্গাপুর এক্সপো। সন্ধ্যা ছয়টায় বসবে ইন্টার রেসিয়াল ইন্টার রিলিজিয়াস হারমনি (আইআরআইআরএইচ) নাইটের ১৫তম আসর। সরাসরি রাষ্ট্রপতি আমাদের আমন্ত্রণ জানিয়েছেন, বিশাল ব্যাপার!

আমি সিঙ্গাপুরে একটা প্রকৌশল কোম্পানিতে ‘টেকনিশিয়ান’ হিসেবে কাজ করছি। এর পাশাপাশি দুটি সংগঠনে স্বেচ্ছাসেবক ও বাংলা অনুবাদক হিসেবে কাজ করছি। সোশ্যাল ডেভেলপমেন্ট ইনিশিয়েটিভ (এসডিআই) একাডেমিতে কাজ করছি দীর্ঘদিন ধরে। এসডিআই একাডেমি মূলত সিঙ্গাপুরে বসবাসরত প্রবাসী বাঙালিদের ইংরেজি শেখানোসহ বিভিন্ন দক্ষতা উন্নয়নে প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করে থাকে।

প্রতি সপ্তাহের শনি, রোববার চলে ইংরেজি শেখানোর ক্লাস। ৫ হাজারের বেশি বাঙালি শ্রমিকদের আমরা এসডিআই একাডেমি থেকে ইংরেজি শিখিয়েছি। আইআরআইআরএইচ নাইটে বিভিন্ন সামাজিক, সাংস্কৃতিক, স্বেচ্ছাসেবী সংগঠনকে রাষ্ট্রপতির পক্ষ থেকে আমন্ত্রণ জানানো হয় প্রতিবছর। এসডিআই থেকে আমরা ১৫ সদস্যের প্রতিনিধিদল উপস্থিত ছিলাম এবারের আসরে।

প্রায় এক ঘণ্টা দশ মিনিটের পথ, এ মাথা থেকে ও মাথা বলা চলে। ট্রেনে বসে গত আসরের ছবিগুলো দেখছিলাম। এত বড় মানের অনুষ্ঠানে অংশগ্রহণের সুযোগ কখনো হয়নি। খুব সাধারণ, ছোট একজন বিদেশি শ্রমিকের কাছে এটা সত্যিই বড় ব্যাপার। এক্সপো এমআরটি স্টেশনে এক্সিট নিয়ে ওপরে উঠতেই এক স্বেচ্ছাসেবী ‘হাই’ বলে এগিয়ে এলেন। অনুষ্ঠানে এসেছি কি না, জিজ্ঞেস করলেন। মাথা নাড়তেই উত্তর এল, ‘গো স্ট্রেট অ্যান্ড টার্ন রাইট’ (সোজা গিয়ে ডানে যাও)।

হল ৭–এর সামনে পিঁপড়ার মতো মানুষ এসে জড়ো হচ্ছিল। স্বেচ্ছাসেবকেরা এতই বন্ধুসুলভ যে প্রায় পদে পদেই ‘হাই-হ্যালো’র জবাব দিতে হচ্ছিল। এসডিআই একাডেমির ১৫ সদস্যের প্রতিনিধিদলের নেতৃত্ব দিচ্ছিলেন তৌফিক ভাই। রাইসা আপু, মামুন ভাই, নজরুল ভাই, জাব্বির ভাই, রুবেল ভাই, সাব্বিরসহ একে একে সবাই হাজির। আমাদের সঙ্গে যুক্ত হলেন বন্ধু সংগঠন ‘আইওয়াইসি’ ও চ্যানেল নিউজ এশিয়ার দুজন তরুণ প্রতিবেদক। হলের চোখ ধাঁধানো লাইটিং মুগ্ধ করার মতো। হাজারো স্পট, টার্গেট লাইট চোখে এসে পড়ছিল। কত্ত বড় আয়োজন! সুন্দর করে সাজানো চেয়ার, টেবিল।

বাঁশি, সানাই, গিটার, পিয়ানো, হারমোনিয়াম...আরও নানা বাদ্যযন্ত্রে বাজছিল অদ্ভুত সুরে। নিজ নিজ চেয়ার-টেবিল খুঁজে নিয়ে আমরা অনুষ্ঠান উপভোগ করতে শুরু করলাম। উপস্থাপক–উপস্থাপিকা মঞ্চে এলেন, ইংরেজিতেই চলছে সব। ঘোষণা করা হলো, মূল অতিথি রাষ্ট্রপতি হালিমা ইয়াকুব কিছুক্ষণের মধ্যেই উপস্থিত হবেন।

ভিনদেশি ও বাংলাদেশি তরুণ দলের সঙ্গে লেখক (ডানে)
ভিনদেশি ও বাংলাদেশি তরুণ দলের সঙ্গে লেখক (ডানে)

হলের বাইরে ম্যাডাম হালিমা তখন ১৫টি ছবিতে স্বাক্ষর করছেন। অনেকেই রাষ্ট্রপতির সঙ্গে হাত মেলাতে আগ্রহী। আমরাও তাঁদের সঙ্গে লালগালিচার পাশে জায়গা করে নিলাম। রাষ্ট্রপতির সঙ্গে একে একে অন্য অতিথিরাও মিলনায়তনে পা রাখলেন। ৬টি বড় পর্দায় তখন অনুষ্ঠানটি সরাসরি দেখা যাচ্ছিল।

রাষ্ট্রপতি এগিয়ে এলে আমি সালাম দিয়ে হাত বাড়িয়ে দিলাম। বললেন, ‘ইউ আর ফ্রম...?’ (তুমি কোথা থেকে?’ বললাম, ‘আই অ্যাম ফ্রম বাংলাদেশ।’ ধন্যবাদ জানিয়ে তিনি এগিয়ে গেলেন। অতিথিরা আসন গ্রহণ করার পর আমি ক্যামেরায় কিছু ভালো মুহূর্ত ধরে রাখার দিকে মনোযোগী হলাম।

সিঙ্গাপুরের বিভিন্ন জাতি ও ধর্মের মানুষের মধ্যে পারস্পরিক বিশ্বাস ও সমঝোতা তৈরির লক্ষ্যে প্রতিবছর এই আয়োজন করে থ্যি হুয়া কুয়ান ম্যুরাল সোসাইটিসহ সাতটি প্রতিষ্ঠান। বিভিন্ন দেশ, ধর্ম, বর্ণ, গোত্রের লোকজন উপস্থিত হন এখানে। দুই উপস্থাপকের ঘোষণার পর কয়েকটি ধর্মীয় গ্রন্থ থেকে কিছুটা অংশ পাঠ করা হলো। সবাই চুপ করে শুনলেন।

এরপর শুরু হলো সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান। ইউরোশিয়ান অ্যাসোসিয়েশনের দলনেতা তাঁদের দেশীয় গান গেয়ে শোনালেন, পেছনে নাচ চলছিল একই সঙ্গে। এরপর থাইল্যান্ডের সংস্কৃতি তুলে ধরতে মঞ্চে এলেন থাইল্যান্ডের সাংস্কৃতিক দল। নাচলেন সিঙ্গাপুর ইন্ডিয়ান ডেভেলপমেন্ট অ্যাসোসিয়েশনের বন্ধুরা। ইয়াইয়াসান মেনডাকি দলের সদস্যরা উচ্চাঙ্গসংগীত শোনাতে মঞ্চে উঠলেন। আলো ঝলমলে পরিবেশে অনুষ্ঠানের পাশাপাশি টুং টাং শব্দে চলছিল খাওয়াদাওয়াও। কত রকমের খাবার! একটা যায় তো আরেকটা আসে। কোমল পানীয়ের গ্লাস কখনো ফাঁকা হচ্ছিল না। বাহারি সব খাবার পরিবেশন করা হচ্ছে টেবিলে, আমরা রীতিমতো বিপদে পড়েছি। চপস্টিক চালিয়ে খাওয়ার অভ্যাস নেই আমাদের কারোরই। অথচ অন্যরা দিব্যি খেয়ে নিচ্ছেন। আমরা একে অন্যের চপস্টিক ধরা দেখে হাসাহাসি করলাম কিছুক্ষণ।

একসময় রাষ্ট্রপতি মহোদয়কে শুভেচ্ছা বক্তব্যের জন্য মঞ্চে আমন্ত্রণ জানানো হলো। দীর্ঘদিন ধরে ৪০টির বেশি সামাজিক সংগঠনের সঙ্গে যুক্ত ম্যাডাম হালিমা। তিনি স্বেচ্ছাসেবী সংগঠনের কাজ খুব উৎসাহিত করেন। আমরা যাঁরা আমন্ত্রিত হয়েছিলাম, সবার কাজ সম্পর্কেই তিনি আগে খোঁজ নিয়েছেন। আমাদের কাজ তাঁর পছন্দ হয়েছে বলেই হয়তো, আমরা জায়গা পেয়েছিলাম একেবারে সামনে।

উপস্থিত সবাইকে শুভেচ্ছা জানিয়ে হালিমা ইয়াকুব বললেন, ‘ধর্মীয় ও জাতিগত বৈচিত্র্য আমরা উদ্‌যাপন করি। যদিও বিশ্বের অনেক দেশে এটা সংঘাত ও দ্বন্দ্বের কারণ।’ মানবতার উন্নতিতে অবদান রাখার আহ্বান জানিয়ে তিনি বক্তব্য শেষ করেন। জানি না কেন, তাঁকে দেখে খুব সাধারণ, সাদাসিধে মানুষ বলে মনে হলো।

অনুষ্ঠান শেষে সব পারফরমার রাষ্ট্রপতির সঙ্গে মঞ্চে উঠলেন। গাইলেন ‘স্ট্যান্ড ফর সিঙ্গাপুর’। আমরা যতটা পারি ছবি তুলে নিলাম। কে জানে, এমন সুযোগ কি আর কখনো হবে! নানা দেশের তরুণদের সঙ্গে দেখা হয়েছে এই অনুষ্ঠানে। কেন জানি না, হাত বাড়িয়ে ‘আই অ্যাম ফ্রম বাংলাদেশ’ বলতে খুব ভালো লাগছিল।