প্রবীণদের প্রেরণা মুন্নী সোবাহানী

মুন্নী সোবাহানী
মুন্নী সোবাহানী

নাচের মাধ্যমেও প্রবীণদের মনে যে আনন্দের ছাপ ফেলা যায়, বাড়িয়ে দেওয়া যায় জীবনীশক্তি—সেদিন মুন্নী সোবাহানীর দলের পরিবেশনা না দেখলে অজানাই থেকে যেত। ১ জুলাই ছিল কানাডা ডে, দেশটির জাতীয় দিবস। এই উপলক্ষে টরন্টো শহরের আগা খান মিউজিয়ামের খোলা মঞ্চে সেই পরিবেশনা দেখার সুযোগ হলো। অংশগ্রহণকারীরা নানা ভাষাভাষীর মানুষ; বয়স ৫০ থেকে ৮০ বছর। শুরুতে তাই উপস্থিত দর্শকদের অনেককেই দ্বিধাগ্রস্ত দেখাচ্ছিল। কানে ভেসে আসছিল এমনও কথাও—এই বয়সে কেউ কি নাচে! তবে পরিবেশনাটি শেষ হওয়ার পর উচ্ছ্বাসটা ছুঁয়ে গেল কুশীলব থেকে দর্শক—সবার মধ্যেই। তখন কেউ কেউ মঞ্চে এসে জড়িয়ে ধরেছেন এই মানুষদের, কেউ বাহবা দিচ্ছেন। কানাডা দিবসের আয়োজনে অনন্য মাত্রা যোগ করেছিল বয়স্ক মানুষদের এই প্রচেষ্টা।

ব্যতিক্রমী এই আয়োজনের পেছনের মানুষ বাংলাদেশি বংশোদ্ভূত মুন্নী সোবাহানী। তিনিই এই ‘থেরাপিউটিক ইন্ডিয়ান এক্সারসাইজ’ বা ‘হিলিং ড্যান্স’–এর উদ্যোক্তা। অনুষ্ঠানে আসা স্থানীয় সমাজকর্মী সুদীপ সোম তাঁর প্রতিক্রিয়ায় জানালেন, ‘এই বয়সের মানুষজন শারীরিক, মানসিক নানা সমস্যায় ভোগেন। একাকিত্ব ভর করে তাঁদের। তাদের উচ্ছলতা প্রমাণ করে, তারা কতটা প্রাণশক্তি পেয়েছেন এই বিশেষ নাচের (ড্যান্স থেরাপি) মাধ্যমে।’

তখন অনুষ্ঠান শেষ। ভর রোদে লাল পোশাক পরা মানুষের ভিড় বেড়েই চলেছে। মাঠজুড়ে বসেছে নানা স্টল। বিনা মূল্যে খাবার পরিবেশন করছেন স্বেচ্ছাসেবীরা। চীনা বংশোদ্ভূত কানাডীয় প্যাট লির কাছে জানতে চাই, এই বয়সে নাচতে এলেন কেন? এমন প্রশ্নে চমকে গেলেন তিনি। লি জোর দিয়ে বললেন, ‘নাচের চেষ্টাই আমাকে জীবনে ফিরিয়ে এনেছে। বেঁচে থাকার প্রেরণা দিয়েছে। মুন্নী ছাড়া এসব সম্ভব হতো না।’

মুন্নী সোবাহানীর চেষ্টা

চট্টগ্রামে জন্ম নেওয়া মুন্নী সোবাহানী কানাডায় এসেছিলেন ১৯৭৩ সালে। এরপর থেকেই কাজ করে চলেছেন দেশটির সাংস্কৃতিক, সামাজিক নানা মাধ্যমে। ছড়িয়ে দিচ্ছেন বাংলাদেশের নাম। এ বছর তিনি ওন্টারিও ভলান্টিয়ার সার্ভিস অ্যাওয়ার্ডসহ বেশ কয়েকটি পুরস্কার পেয়েছেন। এই নারীর এই উদ্যোগের সুফল ভোগ করছেন, প্রেরণা পাচ্ছেন টরন্টোর অনেক মানুষ। মুন্নী বললেন, ‘জীবনের শেষ প্রান্তে আসা এসব মানুষের জীবনে ফেরা, নিজেকে জানার অদম্য চেষ্টা আমাকে বিস্মিত করেছে। কথা বলে দেখেন, আমার চেয়ে ওদের অভিব্যক্তি কতটা প্রাণবন্ত?’

সম্প্রতি মুন্নী সোবাহানীর বাসায় গিয়েই শোনার সুযোগ হলো তাঁর যাপিত জীবনের গল্প। বললেন, ‘শৈশবেই গানের সঙ্গে পরিচয়, শিখেছি নাচ। চট্টগ্রামে শংকর দাসগুপ্ত ওস্তাদজির কাছে আমার নাচের হাতেখড়ি। সুযোগ পেয়েছি উপমহাদেশের প্রখ্যাত নৃত্যগুরু বিরজু মহারাজের কাছ থেকে তালিম নেওয়ার। এ দেশে আসার পর অটোয়া শহরে বহুজাতিক কানাডা ডে সাংস্কৃতিক উৎসবে প্রথম বাঙালি হিসেবে বাংলা গান করি ১৯৭৩ সালে; আহা রে, সে কী আনন্দ!’

শিল্পী আফজাল সোবাহানী ও মুন্নী দম্পতি বিখ্যাত গজলশিল্পী মেহেদী হাসানের খুবই প্রিয় হয়ে উঠেছিলেন। গান করতে, নাচতে ছুটে বেড়িয়েছেন পৃথিবীর নানা দেশে। খ্যাতনামা উমাড মিউজিক ফেস্টিভ্যালে পরপর দুবার গান করার সুযোগ পেয়েছেন তাঁরা। ক্যারাভান, কিংস্টোন ফোক ফেস্ট, ড্রাগনবোট, রিদম অব ইন্ডিয়া, সোনার বাংলা কনসার্ট—সবখানেই আছেন মুন্নী।

১৯৭৪ সালে এই দম্পতি তাঁদের মেয়ের নামে গড়ে তোলেন লামিস স্কুল অব মিউজিক অ্যান্ড ড্যান্স। প্রায় দুই যুগে পাঁচ শর বেশি শিশু–কিশোরকে প্রশিক্ষণ দিয়েছেন, সাংস্কৃতিক পরিবেশনা নিয়ে পৃথিবীর নানা দেশে ঘুরেছেন।

তাঁর কাছে জানতে চাই থেরোপেটিক ড্যান্সের শুরুর কথা। মুন্নী বললেন, ‘প্রায় ১৫ বছর হবে। প্রতিবেশী অ্যাজমায় আক্রান্ত পাঞ্জাবি মেয়ে পুষ্পা কোনো কিছুর সঙ্গে মানিয়ে নিতে পারছিল না। ওর পরিবারের সঙ্গে কথা বলে সময় কাটানোর জন্য আমাদের বাসায় নিয়ে আসি। আমার সঙ্গে নাচতে বলি। সাহস জোগায়; একটা সময় পর আগ্রহী হয়ে ওঠে পুষ্পা; দিনে দিনে অ্যাজমা উধাও হয়।’ ব্যাপারটি মুন্নী সোবাহানীকে খুব বিস্মিত করে। ব্যাপক আশাবাদী হয়ে ওঠেন তিনি। সেই থেকে নাচকে থেরাপি হিসেবে প্রয়োগ করার চিন্তা থেকে প্রচেষ্টার শুরু করেন। তাঁর ছেলে উদ্যোগের নামকরণ করেন ‘থেরাপিউটিক ইন্ডিয়ান এক্সারসাইজ’। দুই ছেলে জুনেদ ও আবীর আর মেয়ে লামিসার পাশাপাশি নানা জাতিসত্তার ছেলেমেয়েদের কাছে ভরসার নাম মুন্নী সোবাহানী। শিক্ষকতা করেন, জড়িত আছেন কানাডার বেশ কয়েকটি স্বেচ্ছাসেবী প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে।

কানাডায় দীর্ঘদিন থাকলেও দেশের স্মৃতি অমলিন। প্রায়ই দেশে আসেন। বললেন, ‘শহর চট্টগ্রামে আমাদের বাড়ির আঙিনা, সেখানে আমাদের বেড়ে ওঠা। আমার মা আফজালুন্নেছার সঙ্গে মামাবাড়ি বরিশালের উলানিয়া চৌধুরী বাড়ির স্মৃতিগুলি বেশি মনে পড়ে।’ চট্টগ্রাম কলেজ থেকে স্নাতক হয়ে বিদেশে পাড়ি দিয়েছিলেন মুন্নী। স্মৃতির ঝুলিতে দেশের অনেক অনেক গল্প জমে আছে। বললেন, ‘শিকড় ভুলে থাকা যায় না, একটা খামতি থেকেই যায়। যেখানেই যাই, পরিচয় তো একটাই—বাঙালি।’