চমকে দিয়েছেন জান্নাতুন ও রুপা

রুপা খাতুন, জান্নাতুন নেছা
রুপা খাতুন, জান্নাতুন নেছা

অভাব-অনটনের কারণে এসএসসি পরীক্ষার পরই মেয়ের বিয়ে দিয়ে দেন ভ্যানচালক আহসান আলী। এসএসসি পরীক্ষায় জিপিএ-৫ পাওয়ায় মেয়ের বাবা ও স্বামীর পরিবারের সবাই খুশি। এর আগে জেএসসি পরীক্ষাতেও জিপিএ-৫ পেয়েছিলেন তিনি। এসএসসির পর গ্রামের কলেজেই ভর্তি করানো হয়। তবে এক বছর পর স্বামীর পরিবার আপত্তি জানায় পড়াশোনার ব্যাপারে। তারা পড়া বাদ দিয়ে ঘরসংসার সামলাতে বলে। সে প্রস্তাবে রাজি হননি মেয়েটি। এ নিয়ে বিবাহবিচ্ছেদও হয়। এতেও দমেননি তিনি। লেখাপড়া চালিয়ে যান। চলতি বছরের উচ্চমাধ্যমিক পরীক্ষায় জিপিএ-৫ পেয়ে নিজের যোগ্যতা দেখিয়ে দিয়েছেন। তাঁর নাম জান্নাতুন নেছা। রাজশাহীর বাগমারা উপজেলার বাগমারা পূর্বপাড়া গ্রামে তাঁর বাড়ি।
ওদিকে যৌতুক আর বাল্যবিবাহের কাছে হার মানা রুপা খাতুনও চমক দেখিয়েছেন। জান্নাতুন নেছার মতো তিনিও জিপিএ-৫ পেয়েছেন উচ্চমাধ্যমিক পরীক্ষায়। এবার শোনা যাক তাঁদের সফলতা আর সংগ্রামের গল্প।

চিকিৎসক হতে চান জান্নাতুন নেছা, কিন্তু...
মেয়ে লেখাপড়ায় ভালো, কিন্তু আর্থিক অবস্থা ভালো না। তাই মাধ্যমিক পরীক্ষার পরই মেয়ের বিয়ে দিয়েছিলেন আহসান আলী। তিনি বললেন, ‘জামাইয়ের পরিবার যৌতুকের দাবি করে এবং মেয়ের পড়ালেখায় আপত্তি জানায়। এ কারণে দুই পরিবারের মধ্যে বিরোধের সৃষ্টি হয়। বছরখানেক আগে ছাড়াছাড়ি হয়ে যায়।’ স্বামীর ঘর থেকে বের হয়ে আবারও বাবার ঘরে আশ্রয় নেন জান্নাতুন নেছা। সেখান থেকে চালিয়ে যান লেখাপড়া। আবারও অভাব-অনটন। টাকার অভাবে সবগুলো বইপুস্তক কিনতে পারেননি। তারপরও নিয়মিত ক্লাস করে এবং বন্ধুদের কাছ থেকে ধার করা বই পড়ে এইচএসসি পরীক্ষা দেন তিনি।
এইচএসসিতে বিজ্ঞান বিভাগ থেকে জিপিএ-৫ পেয়েছেন জান্নাতুন নেছা। তবে ভবিষ্যৎ নিয়ে চিন্তিত। তিনি বলেন, ‘পড়াশোনা করে চিকিৎসক হতে চাই। কিন্তু অভাবের সংসারে তা পারব কিনা, জানি না। বাবার বাড়ি ফিরে এসে কষ্ট করে লেখাপড়া চালাতে হয়েছে। বিয়ে হওয়ার কারণে উপবৃত্তিও পাইনি। কলেজের অধ্যক্ষ বিভিন্নভাবে সহযোগিতা করেছেন। এ জন্য ভালো ফলাফল ধরে রাখা সম্ভব হয়েছে।’
বাগমারা কলেজের অধ্যক্ষ জিয়াউল আলম প্রথম আলোকে বলেন, ‘অদম্য আগ্রহের কারণেই ভালো ফলাফল করতে পেরেছে জান্নাতুন নেছা। কলেজ ও বাবা-মায়ের মুখ উজ্জ্বল করেছে।’

মনোবল ভাঙেনি রুপা খাতুনের
রাজশাহীর বাগমারার সেই রুপা খাতুনের কথা হয়তো আমরা ভুলে গেছি। এই শিক্ষার্থীর সফলতা এবং ঘটনাও প্রায় একই। বাল্যবিবাহের শিকার হওয়া এই রুপা ঘুরে দাঁড়িয়েছেন অনেক আগে। জেএসসি থেকে উচ্চমাধ্যমিক পর্যন্ত তিন পরীক্ষায় জিপিএ-৫ পেয়েছেন।
রাজশাহীর বাগমারার চান্দেরআড়া গ্রামের কৃষক আবুল কাশেমের মেয়ে রুপা খাতুন। চান্দেরআড়া উচ্চবিদ্যালয়ে ২০১১ সালে সপ্তম শ্রেণিতে পড়ার সময় রুপাকে নিজের ইচ্ছের বিরুদ্ধে তাঁর পরিবার বিয়ে দেয়। লেখাপড়ার খরচ বহন করতে না পারায় মেয়েকে বিয়ে দিতে বাধ্য হন বাবা-মা। একই উপজেলার মেন্দিপাড়া গ্রামে যৌতুক ছাড়াই মেয়ের বিয়ে দেওয়া হয়েছিল। আবুল কাশেম বলেন, ‘প্রথমে কোনো যৌতুক নিতে না চাইলেও পরে জামাইয়ের পরিবারের পক্ষে ১ লাখ টাকার যৌতুক দাবি করা হয়। যৌতুক দিতে অপারগতা ও নিজের অসহায়ত্বের কথা জানালেও লাভ হয়নি। বরপক্ষ যৌতুকের দাবিতে অনড় থাকে।’ একপর্যায়ে যৌতুক আনার জন্য রুপাকে ২০১৩ সালে বাবার বাড়িতে পাঠিয়ে দেওয়া হয়। এর কিছুদিন পর তালাক দেওয়া হয় কিশোরী রুপাকে।
ঘর ভাঙলেও মনোবল ভাঙেনি রুপা খাতুনের। বাবার বাড়িতে ফিরে এসে আবারও লেখাপড়া শুরু করেন। গোপনে শিক্ষকদের সঙ্গে যোগাযোগ করে স্কুলে ভর্তি হন। ২০১৩ সালে জেএসসি পরীক্ষায় অংশ নেন, ফলাফল জিপিএ-৫। বিদ্যালয়ের সহকারী শিক্ষক মোজাম্মেল হক জানান, রুপা খুব মেধাবী।
পাঁচ ছেলেমেয়ের সংসারে অভাব লেগে থাকার কারণে ছোট মেয়ের বিয়ে দিয়েছিলেন আবুল কাশেম। এখন নিজের ভুল বুঝতে পেরেছেন। মেয়েকে আর বিয়ে দেবেন না বলে জানান। সে থেকে আর পেছনে ফিরে আসতে হয়নি রুপাকে। জেএসসির পর প্রথম আলোয় রুপাকে নিয়ে প্রতিবেদন ছাপা হলে তা নজরে আসে তৎকালীন এক প্রতিমন্ত্রীর। তিনি লেখাপড়ার যাবতীয় দায়িত্ব নিয়েছিলেন। নিয়মিত খরচও দিতেন। তবে মন্ত্রিত্ব চলে যাওয়ার পর সেই পথ বন্ধ হয়ে যায়। এরপরও থেমে থাকেননি রুপা। এসএসসি পরীক্ষায় অংশ নিয়ে আবারও জিপিএ-৫ পান রুপা। এবার উচ্চমাধ্যমিক পরীক্ষায় মোহনগঞ্জ কলেজ থেকে মানবিক বিভাগে জিপিএ-৫ পেয়েছেন। কলেজের অধ্যক্ষ আবদুল লতিফ তরফদার বলেন, রুপা মেধাবী। বাল্যবিবাহ জয় করার এক দৃষ্টান্ত।
অতীতের সবকিছু ভুলে গেছেন রুপা খাতুন। তাঁর কথা, ‘এখন ভালো কিছু করার ইচ্ছে রয়েছে। আমার মতো আর কারও যেন বাল্যবিবাহ না হয়।’