জলাবদ্ধতায় কর্মজীবী নারীর ভোগান্তি

অল্প বৃষ্টিতেই রাজধানীতে তৈরি হওয়া জলাবদ্ধতায় দুর্ভোগে পড়েন নগরবাসী। কর্মজীবী নারীদের দুর্ভোগ যেন আরও বেশি। ছবি: দিপু মালাকার
অল্প বৃষ্টিতেই রাজধানীতে তৈরি হওয়া জলাবদ্ধতায় দুর্ভোগে পড়েন নগরবাসী। কর্মজীবী নারীদের দুর্ভোগ যেন আরও বেশি। ছবি: দিপু মালাকার

সোনিয়া সুলতানা মতিঝিলের একটি বেসরকারি ব্যাংকে কাজ করেন। থাকেন মিরপুরের কাজীপাড়ায়। প্রতিদিন কর্মস্থলে যাতায়াতে তাঁকে কমপক্ষে পাঁচ ঘণ্টা খরচ করতে হয়। বৃষ্টি হলে গন্তব্যে পৌঁছানোর কোনো হিসাব-নিকাশই কাজে আসে না। একই জায়গায় গাড়ি অনেকক্ষণ আটকে থাকে।

পুরান ঢাকার কসাইটুলির একটি কমিউনিটি ক্লিনিকের স্বাস্থ্য কর্মকর্তা মিলি আশরাফী থাকেন লালমাটিয়ায়। বৃষ্টি হলেই তাঁর বাড়ি ফেরার পথ কাজী আলাউদ্দিন রোড পানিতে তলিয়ে যায়। তখন কোনো যানবাহন পাওয়া যায় না। আবার ধানমন্ডির ২৭ নম্বরের জলাবদ্ধতাও তাঁকে পাড়ি দিতে হয়। ফলে অনেক ভোগান্তি সয়ে তাঁকে রোজ যাতায়াত করতে হয়।

কয়েক বছর ধরেই রাজধানীতে যানজটের পাশাপাশি জলাবদ্ধতা একটি বড় সমস্যা হিসেবে চিহ্নিত হয়েছে। এবারের বর্ষা মৌসুমে সেটা প্রকট আকার ধারণ করেছে। অল্প বৃষ্টিতেই ঢাকার অনেক এলাকা পানিতে তলিয়ে যায়। পরিবেশ অধিদপ্তরের হিসাব অনুযায়ী, ২৩ জুলাই মাত্র ৩৬ মিলিমিটার বৃষ্টিতেই ঢাকা তলিয়ে যায়। ইতিমধ্যে মিরপুরের কালশী এবং কাজীপাড়ায় বৃষ্টি হলে পথচারীদের রাস্তার এক পাশ থেকে অন্য পাশে পারাপারে নৌকা ব্যবহার চালু হয়েছে।

শহরে জলাবদ্ধতার কারণে কর্মব্যস্ত শহরবাসীকে নানা ধরনের ভোগান্তি পোহাতে হয়। ভিজে বা নোংরা পানি মাড়িয়ে যেতে হয় গন্তব্যে। গন্তব্য পৌঁছাতেও দেরি হয়। নিত্যপ্রয়োজনীয় কাজে বিঘ্ন ঘটে। আবার বৃষ্টি শেষ হওয়ার আগেই তলিয়ে যায় এসব এলাকার মূল এবং সংযোগ সড়কগুলো। সৃষ্টি হয় ভয়াবহ যানজটের। এতে কর্মজীবী নারীদের ভোগান্তি অন্যদের তুলনায় বেশি। অনেক সময় সেটা অসহনীয় হয়ে পড়ে।

কর্মজীবী নারীরা বলেন, উন্নয়নকাজের নামে পুরো শহর খোঁড়াখুঁড়ি করা। অনেক রাস্তা কেটে রাখা। সংকুচিত এসব রাস্তায় দুটি বাস একসঙ্গে পাশাপাশি চলতে পারে না। আবার রাস্তার যে অংশ দিয়ে গাড়ি চলে, তা ভাঙাচোরা থাকে। কার্পেটিং উঠে গিয়ে ইট বের হয়ে আছে। কোথাও কোথাও রাস্তার মধ্যে বড় বড় গর্ত। একটু বৃষ্টি হলেই এসব এলাকায় পানি জমে যায়। তখন পানি ভেঙে অথবা যানবাহন ছেড়ে গিয়ে গন্তব্যে পৌঁছাতে হয়। এমনকি ফুটপাতগুলোও হাঁটার উপযোগী নেই।

সোনিয়া সুলতানা জানান, সকালে ছেলেকে স্কুলে দিয়ে তাঁকে কর্মস্থলে পৌঁছাতে বেশ বেগ পেতে হয়। বাজার বহন করার ঝক্কিও বেড়ে গেছে। তিনি বলেন, পুরো বর্ষা মৌসুমে কাজীপাড়া পানিতে ডুবে থাকে। কিন্তু সন্তানদের পড়াশোনা এবং স্বামীর ব্যবসার জন্য বাসা পরিবর্তনও সম্ভব নয়।

কর্মজীবী নারীরা বলেন, তাঁদের চাকরির পাশাপাশি সন্তান পালন এবং সংসারের কাজ করতে হয়। তাই এক কাজের জন্য বেশি সময় ব্যয় করার সুযোগ নেই। অথচ জলাবদ্ধতার জন্য রোজ বাড়তি সময় কেটে যায়। রান্নার কাজে বেশ ঝামেলা হয়। নিজেরা ক্লান্ত হয়ে পড়েন। এর প্রভাব ব্যক্তিজীবনেও পড়ে। এ নিয়ে অনেক সময় পারিবারিক কলহেরও সৃষ্টি হয় বলে জানান কয়েক নারী।

একই রকম অভিজ্ঞতার কথা বলেন রাজধানীর আরও বেশ কয়েকজন নারী। তাঁরা বলেন, শহরে যানজটের ভোগান্তি অনেক দিনের। কিন্তু জলাবদ্ধতার কারণে যানবাহন পেতে দেরি হয়। তখন বৃষ্টিতে ভিজতে হয়, শরীর খারাপ করে। এতে তাঁদের ঘরের-বাইরের দুই কাজেই অসুবিধা হয়।

কলেজশিক্ষক রুবিয়া হক জানান, এই মৌসুমে যানবাহনে উঠতে গিয়ে তাঁকে কয়েক দিন ভিজতে হয়েছে। এতে তিনি পাঁচ দিন জ্বরে ভুগেছেন। এ জন্য কলেজ থেকে ছুটি নিতে হয়েছে। রুবিয়ার ভাষ্য, ভোগান্তির পাশাপাশি রোজ যাতায়াতে বাড়তি টাকা গুনতে হয়। কিন্তু রাস্তায় খানাখন্দের কারণে চলাচলে খুব ঝাঁকি লাগে। বাসায় ফিরে প্রতিদিন শরীরে ব্যথা হয়। আবার জ্বরেও ভুগতে হয়।

নারীদের এ সমস্যা নিয়ে কথা হয় বেসরকারি সংস্থা অ্যাকশন এইডের কান্ট্রি ডিরেক্টর ফারাহ কবিরের সঙ্গে। তিনি বলেন, ঢাকা অপরিকল্পিত নগরী হিসেবে গড়ে উঠছে। এতে অন্যদের তুলনায় নারীদের বেশি ভোগান্তি পোহাতে হচ্ছে। এ জন্য তিনি ঢাকার নকশা পরিকল্পনা এবং রক্ষণাবেক্ষণের দায়িত্বে যাঁরা আছেন, তাঁদের অবহেলাকে দায়ী করেন।

ফারাহ কবির আরও বলেন, ঢাকাকে নারীবান্ধব শহর হিসেবে গড়ে তুলতে পাড়াভিত্তিক, এলাকাভিত্তিক উদ্যোগ নিতে হবে। ব্যক্তিপর্যায়েও সচেতন হতে হবে। যত্রতত্র ময়লা ফেলা বন্ধ করতে হবে। পরিবেশ পরিচ্ছন্ন রাখতে আন্তরিক হতে হবে।