ধর্ষকের মানসিক গঠনের কোথায় সমস্যা?

অলংকরণ: শামীম আহমেদ
অলংকরণ: শামীম আহমেদ

সম্প্রতি খাগড়াছড়ির ছোট্ট মেয়ে কৃত্তিকা ত্রিপুরার নৃশংস ধর্ষণের ঘটনা আমাদের শুধু বাক্‌রুদ্ধই করে না, আমরা শিউরে উঠি, আতঙ্কিত হই—আমাদের সন্তানের নিরাপত্তার কথা ভেবে লজ্জিত ও অপরাধী হই। কৃত্তিকার ধর্ষণের দায়ভার সমাজের একজন হিসেবে কাঁধে নিলেও স্বভাবত প্রশ্ন আসে মানসিক গঠনের কোথায় বড় ধরনের সমস্যা থাকলে বা ঘটলে একটি পাঁচ বছরের মেয়ের শরীরের ওপর এমন যৌন আগ্রাসী মনোভাব কাজ করতে পারে!

মূলত নারী-পুরুষের পরস্পরের প্রতি আকর্ষণ একটি স্বাভাবিক জৈবিক-প্রক্রিয়া। কিন্তু এই জৈবিক অনুভূতি মানে এ নয় যে যৌনাকর্ষণ হলেই সেটা নিবৃত্ত করতে হবে। ধর্ষণ শব্দটি শুধু ধর্ষকের যৌনতা নিবৃত্ত করার একটা প্রক্রিয়া নয়, বরং এ ধরনের আচরণ ধর্ষকের জটিল ও অন্ধকার মনোজগৎকে প্রতিফলিত করে।

গবেষণায় দেখা গেছে, অধিকাংশ ধর্ষকের মধ্যে একরকম হীনম্মন্যতাবোধ, ক্ষমতা দেখানোর প্রবণতা, মমত্ববোধের অভাব, নারীর প্রতি অবমাননাকর মনোভাব কাজ করে। অনেক ক্ষেত্রে এ ধরনের যৌন নিপীড়নকারীরা নানা রকম যৌন অসুস্থতা, পেডোফিলিয়া, স্যাডিজম ইত্যাদি সমস্যায়ও ভুগে থাকে। তবে বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই ধর্ষণ মূলত নারীর প্রতি সহিংসতাবোধ ও সুযোগসন্ধানী আচরণের চরম প্রকাশ। রাস্তায়, গণপরিবহন বা কর্মস্থলে নারীদের শরীরে অনাকাঙ্ক্ষিত স্পর্শ, সুযোগসন্ধানী আচরণেরই নানা প্রকাশ।

সমাজের ভূমিকা

ধর্ষণের ঘটনা কমাতে চাইলে প্রথম পদক্ষেপটা নিতে হবে পরিবার থেকে। আমাদের মানসিক গঠন অর্থাৎ অন্যের প্রতি আমাদের আচরণ, মানবিক গুণাবলি, নারীর প্রতি সম্মানবোধ, সম্পর্কের প্রতি দায়বদ্ধতাবোধ, সংবেদনশীলতা ইত্যাদি মূলত তৈরি হয়ে যায় শৈশব ও কৈশোরেই। এমনকি যৌনতা সম্পর্কে আমাদের প্রাথমিক ধারণাও তৈরি হয় এ বয়সেই। সুতরাং বিষয়টার প্রতি সম্মানবোধ, এর সঙ্গে সম্পর্কিত অন্যের প্রতি দায়িত্ববোধ, নিজের আগ্রহ বা আবেগের প্রতি সীমারেখা টানা ইত্যাদিও তৈরি হতে পারে। সুতরাং কৈশোরে পা দেওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই সন্তানদের প্রকৃত সেক্স এডুকেশন, সম্পর্কের সীমারেখা সম্পর্কে স্পষ্ট ধারণা দেওয়া ইত্যাদি একজন কিশোরকে ব্যক্তি হিসেবে গড়ে ওঠার প্রক্রিয়ায় ইতিবাচক প্রভাব রাখতে পারে। এর বাইরে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারে পরিবারের মধ্যে নারীর প্রতি সম্মানবোধের চর্চা। এ ক্ষেত্রে পরিবারের পুরুষেরা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারে। যে পরিবারে নারীদের মতামত যথেষ্ট মূল্যায়িত হয়, নারী-পুরুষের পারস্পরিক সম্মান দেখে যে কিশোরটি বড় হয়, তার মধ্যে যৌন নিপীড়নের মতো নেতিবাচক বৈশিষ্ট্য থাকার সম্ভাবনা কম থাকে।

এ ছাড়া ছেলেবেলা থেকেই ছেলেমেয়েদের মধ্যে খেলাধুলার সুযোগ, মা-বাবার সঙ্গে সন্তানের বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক, ইতিবাচক বৈশিষ্ট্যের প্রশংসা ্ আত্মবিশ্বাসী ও মানবিক হতে সাহায্য করে। মেয়ে বা ছেলেসন্তানকে ছোটবেলা থেকেই ভালো ও খারাপ স্পর্শ সম্পর্কে ধারণা দেওয়া, অপরিচিত ব্যক্তির কাছে একা না ছাড়া ইত্যাদির বিষয়ও মা-বাবার মনোযোগী হওয়া দরকার। তবে শিশুদের যৌন হয়রানি বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই পরিচিত ব্যক্তি বা পরিবারের কাছের মানুষের মাধ্যমে হয়ে থাকে। তাই ব্যক্তি যে-ই হোক, সে স্পর্শ অস্বস্তিকারক বা ভালো না বলে মনে হবে সেটা মা-বাবাকে জানাতে হবে। এ কথাও মনে রাখা দরকার, মেয়েশিশুদের নিরাপত্তার নামে যদি তার বাইরে খেলাধুলা, অন্যদের সঙ্গে মেলামেশা ইত্যাদি করতে না দেওয়া হয়, তবে তার সামাজিক দক্ষতা কম হবে, ফলে প্রকৃতপক্ষে আরও অরক্ষিত হবে।

ধর্ষণ এমন একটি নেতিবাচক অভিজ্ঞতা, যার জের বইতে হয় সারা জীবন। এটি শুধু একজন মেয়ের শারীরিক কষ্ট দেয় না, এটির মাধ্যমে তার মনোজগতে ভীষণ ক্ষত তৈরি হয়...তার আত্মবিশ্বাস, নিজের প্রতি ধারণা, পুরুষের প্রতি নেতিবাচক ধারণা, সম্পর্কে অবিশ্বাস—সবকিছুই হতে পারে। রাষ্ট্র থেকেও এ ধরনের কাজে সর্বোচ্চ শাস্তির বিধান থাকা উচিত।

সহযোগী অধ্যাপক, জাতীয় মানসিক স্বাস্থ্য ইনস্টিটিউট, ঢাকা।