অব্যাহত ছিল ষড়যন্ত্র

বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। ছবি: জহিরুল হক
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। ছবি: জহিরুল হক

১৯৭৯ সন। আমি মিরপুর স্টাফ কলেজ সম্পন্ন করে সেনাসদরে মিলিটারি অপারেশন ডাইরেক্টরেট জিএসও-১ (লে. কর্নেল পদবির) পদে নিযুক্ত হই। তখন জিয়াউর রহমান নির্বাচিত রাষ্ট্রপতি ও বিএনপির প্রতিষ্ঠাতা চেয়ারম্যান। লে. জেনারেল হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ সেনাপ্রধান, মেজর জেনারেল মান্নাফ সিজিএস। অবশ্য কয়েক মাস পরে মান্নাফ কুমিল্লা বদলি হলে মেজর জেনারেল নুরুদ্দীন খান সিজিএস হয়ে আসেন। আর ডিএমও ছিলেন ব্রিগেডিয়ার আব্দুল ওয়াহেদ (পরে মেজর জেনারেল, অবসরপ্রাপ্ত)। ১৯৭৫ সনের পরে আমি দ্বিতীয়বারের মতো ঢাকায় চাকুরি করার সুযোগ পেলাম। মাসে প্রায় একবার করে জিয়াউর রহমান এমও ডাইরেক্টরেটে অপারেশনাল ব্রিফিংয়ে আসতেন। সেনাসদরে থাকার সুবাদে প্রায় সব সিনিয়র অফিসারদের সাথেই পুনঃ পুনঃ দেখা হতো। তখন জিয়াউর রহমানের জনপ্রিয়তা তুঙ্গে এবং সেনাবাহিনীতে তাঁর ছিল অত্যন্ত দৃঢ় অবস্থান। তাঁর দল বিএনপি ক্ষমতার শিখরে। বিএনপি গড়া হয় বিভিন্ন দলছুট নেতা আর কিছুসংখ্যক অবসরপ্রাপ্ত সেনাবাহিনীর সদস্যকে নিয়ে। বিএনপি গড়ার পেছনেও সেনাবাহিনীর বিভিন্ন সংস্থার যথেষ্ট অবদান রয়েছে। তিনি রাষ্ট্রপতি হওয়ার পর সমগ্র বাহিনীর সুপ্রিম কমান্ডার হিসেবে একজন পিএসওর নিচে সেনানিবাসে সেনাসদরের কাছেই একটি ছোট অফিস স্থাপন করেন, যেটা বেগম খালেদা জিয়া প্রধানমন্ত্রী হওয়ার পর প্রধানমন্ত্রীর সশস্ত্র বিভাগ কার্যালয় নামে পরিচিত। জিয়াউর রহমান এ অফিস সশস্ত্র বাহিনীতে তাঁর কর্তৃত্ব বহাল এবং যোগসূত্র রাখার জন্য স্থাপন করেছিলেন। উল্লেখ্য, তিনি প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়ও নিজের হাতে রেখেছিলেন। তাঁর পরে এরশাদ রাষ্ট্রপতি থাকাকালে এ অফিস শুধু ব্যবহারই করেননি বরং এর মাধ্যমে তিনি সমগ্র সশস্ত্র বাহিনীকে তার নিয়ন্ত্রণে আনার জন্য একে আরও শক্তিশালী করে প্রতিরক্ষা সচিবালয়কে এ রকম নিষ্ক্রিয় করে দেন। এরশাদ প্রতিষ্ঠিত ব্যবস্থা এখনো বলবৎ আছে। এ ছাড়া জিয়াউর রহমান সশস্ত্র বাহিনীর প্রায় প্রতিটি বড় অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি থাকতেন। এমনকি প্রতিবছর সশস্ত্র বাহিনীর মহড়াগুলোতে প্রতিটি ফরমেশনে নিজে উপস্থিত থাকতেন। আর এসব অনুষ্ঠানে তার সাথে বেশ কয়েকজন রাজনৈতিক মন্ত্রী নিয়ে আসতেন। এসব করার পেছনে তাঁর উদ্দেশ্য ছিল দ্বিমুখী। প্রথমত, তিনি সশস্ত্র বাহিনীতে তাঁর প্রভাব কোনোভাবেই কমতে দেননি। দ্বিতীয়ত, তাঁর পার্টি (বিএনপি) এবং মন্ত্রিসভাকে পরোক্ষভাবে সেনাবাহিনীতে তাঁর কর্তৃত্বের কথা স্মরণ করিয়ে দিতেন। রাজনৈতিক স্লোগান হিসেবে জনতাই ক্ষমতার উৎস বললেও তাঁর মৃত্যু পর্যন্ত সশস্ত্র বাহিনীই তাঁর ক্ষমতার উৎস হয়ে থাকে। একই ভাবধারা এরশাদের নয় বছর শাসন আমলেও বলবৎ থেকে যায়। অবশ্য এরশাদ এ ব্যাপারে জিয়াউর রহমান থেকে আরও এক ধাপ এগিয়ে থাকেন। তিনি (এরশাদ) রাজনৈতিক মিটিংগুলোতেও সেনাবাহিনীর এরিয়া কমান্ডারদেরকে সাথে হাজির রাখতেন। তার সময়েই তৈরি হয় রাষ্ট্রপতির স্পেশাল সিকিউরিটি ফোর্স, যদিও তিনি ন্যূনতম সিকিউরিটি নিয়ে জনগণের সাথে মেলামেশা করতেন।

ভাষণ দিচ্ছেন বঙ্গবন্ধু। ছবি: অমিয় তরফদার
ভাষণ দিচ্ছেন বঙ্গবন্ধু। ছবি: অমিয় তরফদার

রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমান বোধ হয় সমসাময়িক সময়ের তৃতীয় বিশ্বের একমাত্র নেতা, যিনি সবচেয়ে বেশি সময় বিদেশ সফরে থাকতেন। তাঁর সময়েই বাংলাদেশ আন্তর্জাতিক অঙ্গনে এবং মুসলিম বিশ্বের অতি নিকটে চলে আসে। পাকিস্তানের জিয়াউল হক আর সেনেগালের আহমেদ সেকুতরের অতি নিকটস্থ মানুষ হয়ে ওঠেন। তিনি ইয়াসির আরাফাতের সাথেও ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক গড়ে তোলেন। জিয়াউর রহমান এবং মঞ্জুরের পার্বত্য চট্টগ্রামে পরিবর্তিত নীতির ফলে শান্তি বাহিনীর সন্ত্রাস বৃদ্ধি পেতে থাকে-এ অজুহাতে মঞ্জুর শান্তি বাহিনীর বিরুদ্ধে অভিযানকে আরও শক্তিশালী করার লক্ষ্যে চট্টগ্রাম ডিভিশনের শক্তি আরও বৃদ্ধি করতে থাকেন। Counter Insurgency commander হিসেবে তিনি পার্বত্য চট্টগ্রামের সাথে জড়িত সকল সিভিল আর্মড ফোর্সেস, বেসামরিক প্রশাসনের ওপরও কর্তৃত্বের অধিকার অর্জন করেন। কার্যত সেনাসদরে এমও ডাইরেক্টরেট সব ধরনের সামরিক অভিযান প্ল্যান ও পরিচালনা করার কথা থাকলেও এ ডাইরেক্টরেট পার্বত্য চট্টগ্রামের ব্যাপারে শুধুমাত্র কো-অর্ডিনেটর হয়ে দাঁড়ায়। বস্তুত পার্বত্য চট্টগ্রামের অভিযানের ব্যাপারে মঞ্জুর সরাসরিই সরকার এবং বেসামরিক প্রধানদের সাথেই যোগাযোগ রক্ষা করে চলতেন। অনেক সময় সেনাসদরও মঞ্জুরের কার্যক্রমের ব্যাপারে একরকম অজ্ঞই থাকত। মঞ্জুরকে এ ধরনের শক্তি জোগাবার পেছনে অনেক আমলাও তাকে মদদ জোগাতে থাকে।

যখনই রাষ্ট্রপতি বিদেশে থাকতেন, তখনই সব সময়ের জন্য সেনাসদরে এমও এবং এমআই ডাইরেক্টরেটে একজন করে ডিউটি অফিসার মোতায়েন থাকত। এমনিতেই সেনাসদরে প্রতিদিনই একজন করে ডিউটি অফিসার নিযুক্ত থাকে।

১৯৮০ সনের ১৬-১৭ জুনের রাতে হঠাৎ করে এমও ডাইরেক্টরেটের সকল অফিসারের ডাক পড়ে। অফিসে এসে দেখলাম ডিএমও অনেক আগেই অফিসে হাজির হয়ে সিজিএসের সাথে জরুরি মিটিংয়ে আছেন। সেখানে সামরিক গোয়েন্দা সংস্থাগুলোর কর্মকর্তারা ছাড়াও ঢাকায় ব্রিগেড কমান্ডারগণও উপস্থিত রয়েছেন। আমি ধারণা করলাম, আবার হয়তো কিছু ঘটেছে বা ঘটতে যাচ্ছে। রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমান দেশের বাইরে। রাত প্রায় ১১টা হবে, তখন খবর এল মিরপুরের একটি আর্টিলারি, ঢাকার একটি অ্যান্টিএয়ারক্রাফট ও সাভারের একটি ইউনিটে কিছুসংখ্যক সৈনিক তৃতীয়বারের মতো ‘সিপাহি বিপ্লব’ ঘটাবার উদ্দেশ্যে ‘আরমরি’ (কোত) ভাঙার প্রচেষ্টায় গ্রেপ্তার হয়েছে এবং কিছুসংখ্যক সিপাহি পালাতে সক্ষম হয়। এতে গুটিকয়েক চাকুরিরত অফিসার জেএসডির আর্ম ক্যাডার আর ১৫ আগস্ট বিপ্লবে জড়িত কিছু অফিসারের যোগসাজশ পাওয়া যায়। এর প্রধান হোতা হিসেবে একজন মুক্তিযোদ্ধা আর্টিলারি অফিসার লে. কর্নেল দিদারুল আলমকে শনাক্ত করা হয়। লে. কর্নেল দিদারুল আলমের নেতৃত্বে এ অভ্যুত্থান পরিকল্পনা করা হয়, কিন্তু তাকে অভ্যুত্থানের নির্ধারিত তারিখের সন্ধ্যা থেকে পাওয়া যায়নি এবং তাকে গ্রেপ্তার করাও সম্ভব হয়নি। নুরুন্নবী খান, যিনি বগুড়ায় ডিভিশন হেডকোয়ার্টারে কর্মরত ছিলেন, তারও যোগসাজশ থাকায় তাকে গ্রেপ্তার করা হয়। আরও গ্রেপ্তার করা হয় জাসদের দুজন সদস্য ছাত্রনেতা মুনির হোসেন আর ব্যাংকে শিক্ষানবিশ অফিসার মোশারফ হোসেনকে এ ব্যর্থ অভ্যুত্থানের সাথে জড়িত থাকার অপরাধে। এসব গ্রেপ্তার অত্যন্ত ক্ষিপ্রতার সাথে দু-এক দিনের মধ্যেই সম্পন্ন করা হয় এবং সশস্ত্র সেনানিবাসগুলোতে কড়া নিরাপত্তাব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়। এ অভ্যুত্থান ছিল জাসদ এবং বামপন্থী গুপ্ত রাজনৈতিক দলগুলোর জিয়া সরকারকে উৎখাত করে ক্ষমতা দখলের আর এক প্রচেষ্টা। কিন্তু এবার সেনাসদরের সময়মতো হস্তক্ষেপে এ প্রচেষ্টা অঙ্কুরেই বিনষ্ট হয়।

বাংলাদেশ পুলিশের এক অনুষ্ঠানে বঙ্গবন্ধু। ছবি: সংগৃহীত
বাংলাদেশ পুলিশের এক অনুষ্ঠানে বঙ্গবন্ধু। ছবি: সংগৃহীত

এ অভ্যুত্থানের সাথে জড়িত সাধারণ সৈনিকদের আলাদাভাবে সাভারে কোর্ট মার্শালের মাধ্যমে বিভিন্ন মেয়াদে কারাদণ্ড দেওয়া হয়। আর যেহেতু প্রধান আসামি দিদারুল আলমকে গ্রেপ্তার করা যায়নি, তাই অফিসারদের কোর্ট মার্শালে বিলম্ব হয়।
১৯৮১ সনের জানুয়ারির দিকে আমাকে ডিএমও জানালেন যে ১৭ জুন ১৯৮০ সনের ব্যর্থ অভ্যুত্থানের হোতা অফিসারদের কোর্ট মার্শালে আমাকে সেনাবাহিনীর তরফ থেকে সরকারি কৌঁসুলি নিয়োগ করা হয়েছে। আমার জন্য এ এক বিষণ্ন অভিজ্ঞতা মনে করে আমি ডিএমও ব্রিগেডিয়ার ওয়াহেদকে আমাকে নিয়োগ না করার জন্য অনুরোধ জানালে তিনি জানালেন যে এ ব্যাপারে তার হস্তক্ষেপ করার কোনো অবকাশ নেই, কারণ ডিজিএফআই থেকে সেনাসদরে আমার নাম পাঠানো হয়েছে। সেনাবাহিনীতে ওজর-আপত্তির কোনো সুযোগ নেই বিধায় অগত্যা আমাকে এ অপ্রিয় কাজ হাতে নিতে হলো। এ ধরনের একটি জটিল মামলার সরকারি কৌঁসুলি হওয়া, বিশেষ করে আইনের সম্যক জ্ঞান ব্যতিরেকে অত্যন্ত কষ্টকর ব্যাপার। তা ছাড়া এ অভিজ্ঞতাও খুব সুখকর হবে না, কারণ একজন অফিসার হয়ে নিজেদের সংস্থার অন্য অতিপরিচিত অফিসারদের সরকার উৎখাতের মতো গুরুতর মামলায় দোষী সাব্যস্ত করে গুরুতর শাস্তির জন্য ওকালতি করা আমার জন্য মোটেই সুখবর হবার কথা নয়। দ্বিতীয়ত, এ ধরনের মামলায় অতি উত্সাহী হয়ে অথবা মামলাকে শক্ত করার জন্য Stock witnessও তৈরি করা বা এক Witness-কে দিয়ে সবাইকে implicate করার যে প্রবণতা থাকে, সেটা আমার দ্বারা কোনোভাবেই সম্ভব হবে না। এ কথা আমি কেসের প্রথম ব্রিফিংয়ে বিবাদী পক্ষকে পরিষ্কার ভাবে জানাই। যাহোক, নিজের নীতির ওপরে দৃঢ় থেকে কেস পরিচালনা করার সিদ্ধান্ত নিলাম।

কেস ব্রিফিংয়ে জন্য ডিজিএফআইয়ের সাথে যোগাযোগ করলাম। সেখান থেকে প্রাথমিক তথ্যে জানতে পারলাম কয়েক দিন পূর্বেই দিদারকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে এবং কেসের পুনঃ তদন্ত সমাপ্ত করে কোর্ট মার্শালের অর্ডার দেওয়া হয়েছে। তাদের বিরুদ্ধে প্রাথমিক চার্জশিট তৈরি করে তাদের ডিফেন্সের জন্য আইন বিশেষজ্ঞ নিযুক্ত করার অনুমতি দেওয়া হয়েছে। তাদের সকলের বিরুদ্ধে সেনাবাহিনীতে অভ্যুত্থানের মাধ্যমে সরকার উৎখাতের ষড়যন্ত্র করার সাথে জড়িত থাকার অভিযোগ আনা হয়, যার সর্বোচ্চ শাস্তি প্রাণদণ্ড পর্যন্ত হতে পারে। ডিজিএফআইয়ের ব্রিফিংয়ের পর আমি লে. কর্নেল আনিসের (বর্তমানে ব্রিগেডিয়ার) সাথে দেখা করে এর পূর্বে অনুষ্ঠিত এ অভ্যুত্থানের সাথে জড়িত সৈনিকদের কোর্ট মার্শালের বিবরণ নিয়ে সম্যক ধারণা নিয়েছি। আনিস ওই কোর্ট মার্শালের সরকারি কৌঁসুলি ছিল। এর পরে ডিজিএফআইয়ের তরফ থেকে কেসের এবং ব্যর্থ অভ্যুত্থানের পটভূমির সম্পূর্ণ ব্রিফিং পাই।

ঘটনার পূর্ণ বিবরণে প্রকাশ পায় যে, ১৫ আগস্টের অভ্যুত্থানে জড়িত অফিসাররা, যারা বিদেশে আছে তাদের প্ররোচনায় এ অভ্যুত্থানের নীলনকশা তৈরি করা হয়। অনেকটা কর্নেল তাহেরের সিপাহি বিপ্লবের অনুকরণে বিপ্লবী সৈনিক সংস্থাকে পুনর্গঠিত করে। তবে এর সাথে তারা একটি রাজনৈতিক পার্টিরও সহযোগিতা পাওয়ার জন্য বিশেষত বামঘেঁষা পার্টির সাথে সম্পর্ক স্থাপনের প্রয়াসে জেএসডির আর্ম ক্যাডারের সাথে সম্পৃক্ত হয়। এতে যাদের নাম জড়িত হয় তাদের মধ্যে ডালিম, পাশা, হুদা, নূর, রশিদ এবং পরে ফারুকের নামও পাওয়া যায়। একমাত্র রশিদ আর ফারুক ছাড়া বাকি সবাই পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের অধীনে বিদেশের দূতাবাসে চাকুরিরত বিধায় তদন্তের পর তাদেরকে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমে দেশে পরামর্শের জন্য ডেকে পাঠালে একমাত্র লে. কর্নেল (অব.) আব্দুল আজিজ পাশা ছাড়া আর কেউ আসেনি। পাশা দেশে ফেরার সাথে সাথে অভ্যুত্থানে জড়িত থাকার অপরাধে তাকে গ্রেপ্তার করা হয়। ১৯৭৯ সনের মে মাসের প্রচণ্ড গরমের মধ্যে পাকিস্তানের রাজধানী ইসলামাবাদে বাংলাদেশ দূতাবাসের দ্বিতীয় সচিব মেজর (অব.) বজলুল হুদার বাসায় সুদূর আঙ্কারা থেকে তার ভগ্নিপতি অতিথি হয়ে আসে। এ অতিথি আঙ্কারার বাংলাদেশ দূতাবাসের প্রথম সচিব লে. কর্নেল (অব.) আব্দুল আজিজ পাশা। এর কয়েক দিন পর হুদা আর একজন অতিথিকে স্বাগত জানায় আর এবারের অতিথি সুদূর চীনে বাংলাদেশ দূতাবাসে চাকুরিরত লে. কর্নেল (অব.) শরিফুল হক ডালিম। ডালিম তাদেরকে রশিদ আর ফারুকের আগমনের কথাও জানায় কিন্তু তারা সময়মতো পৌঁছেনি বলে এ তিনজনই একমত হয় যে দেশে ফিরে গিয়ে তারা সক্রিয় রাজনীতিতে অংশগ্রহণ করবে। তবে তারা এ আলোচনাও করে যে রাজনৈতিক পার্টির মাধ্যমে রাষ্ট্রীয় ক্ষমতায় যাওয়া সহজ হবে না। আরও একমত হয় যে বাংলাদেশে বামঘেঁষা রাজনীতিকে গতিশীল করার উদ্দেশ্যে তারা একটি বামঘেঁষা রাজনৈতিক দল গঠন করবে, তবে এ দলের দুটি শাখা থাকবে। এর প্রথমটি হবে খোলামেলা রাজনীতির আর এক শাখা হবে গোপন সশস্ত্র সংগঠন, যার কার্যক্ষেত্র সশস্ত্র বাহিনীতে প্রাধান্য বিস্তারের জন্য সশস্ত্র বাহিনী হতে সদস্য সংগ্রহ আর সমন্বয় করার জন্য বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর মধ্যম পর্যায়ের র‍্যাংকের একজন অফিসারকে প্রাথমিকভাবে দায়িত্ব দেওয়া হবে। রাজনৈতিক শাখা নিয়মতান্ত্রিক রাজনৈতিক কার্যকলাপের পাশাপাশি গোপন সংগঠনের তৎপরতার ওপরেও প্রভাব আর কর্তৃক খাটাবে। আর সুযোগমতো সামরিক অভ্যুত্থানের মাধ্যমে বামঘেঁষা সরকার গঠন করা হবে। যেহেতু বিশুদ্ধ বামপন্থী সরকার বাংলাদেশের জনগণের কাছে গ্রহণযোগ্য হবে না বিধায় ইসলামিক ভাবধারার সমন্বয় করে ‘ইসলামিক সোশ্যালিজম’-এর প্রবর্তন করা হবে বলে সাব্যস্ত করা হয়। প্ল্যানটি অতি সাধারণ এবং সুদূরপ্রসারী, কাজেই একে কার্যকরী করতে হলে প্রয়োজন প্রত্যক্ষ রাজনৈতিক অঙ্গন ছাড়াও সেনাসদস্য সংগ্রহ করা আর সে সাথে প্রয়োজনীয় অর্থের জোগাড় করা। ডালিম একপর্যায়ে পাশা আর হুদাকে আশ্বাস দেয় যে অর্থের কোনো অভাব হবে না, প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা করা হবে, Money is no problem, this will come.

১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট বঙ্গবন্ধুকে সপরিবারে হত্যা করা হয়েছিল। ছবি: ফোকাস বাংলা
১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট বঙ্গবন্ধুকে সপরিবারে হত্যা করা হয়েছিল। ছবি: ফোকাস বাংলা

ডালিম পাকিস্তানে তার মিটিং শেষ করে তেহরানে মেজর (অব.) নূরের সাথে তার পরিকল্পনা সম্বন্ধে আলোচনা করতে যায়। তেহরানের বৈপ্লবিক পরিবেশে ডালিম নূরকে তার পরিকল্পনা বুঝিয়ে বললে নূর তাতে সম্মত হয়। এর কিছুদিনের মধ্যে ডালিম এবং পাশা ছুটি নিয়ে দেশে আসে। এবার তাদের যোগাযোগের পালা এবং সেই উদ্দেশ্যেই ডালিম সমমনা রাজনৈতিক দলগুলোর সাথে আর পাশা ভার নেয় সেনাবাহিনীর ভেতর সমমান অফিসার নির্বাচন করার। পাশা এমন একজন মাঝারি র‍্যাংকের অফিসারের খোঁজ করতে থাকে যে সেনাবাহিনী সংগঠনের দায়িত্ব নেবে আর প্রয়োজনবোধে নেতৃত্বও দিতে পারবে। পাশা ঢাকায় দিদারুল আলম আর উত্তরবঙ্গে কর্মরত লে. কর্নেল নুরুন্নবীকে তাদের (ডালিম গং) পরিকল্পনা সম্বন্ধে জানালে দিদার এবং নুরুন্নবী দুজনেই যোগ দিতে এবং সেনাবাহিনীতে সেনা সংগঠনের কাজ আরম্ভ করার দায়িত্ব নিতে সম্মত হয়। পাশা, দিদার এবং নুরুন্নবীকে দুজন জেএসডির কর্মীর সাথে পরিচয় করিয়ে দেওয়া হয়। এদের একজন জগন্নাথ কলেজের বামপন্থী ছাত্রনেতা মুনির হোসেন এবং একজন কৃষি ব্যাংকের শিক্ষানবিশ অফিসার মোশারফ হোসেন। এদিকে ডালিম তার প্রচেষ্টা চালাতে থাকে। প্রথম পর্যায়ে সর্বহারা পার্টির কর্নেল জিয়াউদ্দিনের সাথে যোগাযোগ করে তাদের ডালিমসহ পরিকল্পনা সম্বন্ধে জানিয়ে তার (জিয়াউদ্দিনের) সহযোগিতা কামনা করে কিন্তু জিয়াউদ্দিন ডালিম এবং অন্যদের বিশ্বাস করতে পারলেন না শুধু তা-ই নয়, হঠাৎ তাদের বামপ্রীতিও সন্দেহের চোখে দেখলেন। জিয়াউদ্দিন ডালিমের প্রস্তাব সরাসরি প্রত্যাখ্যান না করে সর্বহারা পার্টি এ কাজের জন্য সুসংগঠিত নয় বলে এড়িয়ে যান। ডালিম তার প্রচেষ্টায় অনেক বামপন্থী নেতার সাথে শুধুমাত্র রাজনৈতিক আলোচনা করে এবং সৈনিক সংগঠনের কথা ঊহ্য রাখে।

ডালিম এবং পাশা ঢাকায় প্রাথমিক পর্যায়ের কাজ সেরে সংগঠনের কাজ চালাবার জন্য কিছু নগদ অর্থ দিয়ে যায়; আরও আশ্বাস দেয় যে প্রয়োজনীয় অর্থের অভাব হবে না। তবে নিত্যখরচের জন্য দুটি বাস ক্রয় করে উপার্জিত অর্থ থেকে আনুষঙ্গিক খরচ মেটাবার পরিকল্পনা নেয়। যেহেতু প্রচারপত্র প্রয়োজন, তাই আপাতত ছাপাখানা স্থাপন না করা পর্যন্ত হাতে লিখে মোশারফের মাধ্যমে কৃষি ব্যাংকের সাইক্লোস্টাইল মেশিন ব্যবহার করে দেশবাসীর উদ্দেশ্যে এসব লিফলেট প্রচার করা হবে আর সেনাবাহিনীতে প্রচারের দায়িত্ব নেবে দিদার। পরিকল্পনা মোতাবেক বেশকিছু লিফলেট বিতরণও করা হয়।

দিদারও সংগঠনের কাজে লেগে যায়। কিছু পুরোনো সহযোদ্ধা সৈনিকদের সাথে যোগাযোগ শুরু করে কিছু কিছু ইউনিটে ‘সৈনিক সংস্থা’ সংগঠনের প্রচেষ্টা করতে থাকে। একজন এনসিও ক্লার্ককে সৈনিকদের সাথে যোগাযোগ করার দায়িত্বে নিয়োজিত করে। এই প্রক্রিয়ায় ঢাকায় অবস্থানরত দুটি আর্টিলারি ইউনিট আর সাভারে একটি ইনফেনট্রি ইউনিট হতে কিছু সদস্য জোগাড় করে। নুরুন্নবীও অনুরূপভাবে বগুড়া আর যশোরে প্রচেষ্টা চালাতে থাকে; তবে সে দিদারের মতো অত বেশি কৃতকার্য হতে পারে না। দিদারের পক্ষে সংগঠনের কাজ চালানো একটু সহজ হয় কারণ সে সেনানিবাসসংলগ্ন পুরাতন ডিওএইচএসে থাকত, সে সুবাদে তার বাসায় মোটামুটি অগোচরে আনাগোনা করা যেত। তার বাসাতেই ছোটখাটো মিটিং হতো।

১৯৭৯ সনের শেষের দিকে আঙ্কারাতে আর একটি বৈঠক হয়, সেখানে রশিদসহ পাশা, নূর, হুদা একত্র হয়ে তাদের পরবর্তী পরিকল্পনা নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা হয়, বিশেষ করে অর্থ সংকুলানের বিষয়টি এ মিটিংয়ে প্রাধান্য পায়। এ বৈঠকে ডালিম আর শাহরিয়ারের যোগদানের কথা থাকলেও ছুটি না পাওয়াতে তারা আঙ্কারা বৈঠকে যোগদান করতে পারেনি। ফারুক তখন দেশে জেলে থাকায় তার পক্ষেও বৈঠকে আসা সম্ভব হয়নি। এ বৈঠকে আসার সময় রশিদ লিবিয়া থেকে তথাকথিত এক ব্যবসায়ীকে সাথে নিয়ে আসে এবং সেখানে সাময়িকভাবে ঢাকায় অর্থ জোগানের প্রতিশ্রুতি দেয়। একইভাবে এ কথা ঢাকায় দিদারকে জানানো হয়। এ বৈঠকের সমস্ত খবরাখবর জাপানে শাহরিয়ারকে জানানো হয়। আশ্চর্যজনক যে এসব খবরাখবর যথারীতি দূতাবাসের ডিপ্লোমেটিক ব্যাগের মাধ্যমেই রাষ্ট্রদূতদের নাকের ডগার ওপর দিয়েই আদান-প্রদান চলতে থাকে। কখনো কখনো সাংকেতিক মাধ্যমেও ব্যবহার করা হতো বলে বিশেষ বিশেষ সংবাদ গোপন থাকে। এর মধ্যে আঙ্কারায় বাংলাদেশ দূতাবাসে রাষ্ট্রদূত মেজর জেনারেল (অব.) এফ আর এল মামুন এ ষড়যন্ত্রের কিছুটা অনুমান করতে পেরে ঢাকায় জানালে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় তাকে এসব ঘটনার ওপর বিশেষ দৃষ্টি রাখার জন্য গোপনে নির্দেশ দিলেও পাশা তা জানতে পারে। এ নিয়ে পাশা আর রাষ্ট্রদূতের মধ্যে প্রচণ্ড বাগবিতণ্ডা এবং একপর্যায়ে হাতাহাতিও হয়, যদিও পাশা তার জবানবন্দিতে এ কথা অস্বীকার করে।

১৯৮০ সনের মে মাসে আর একটি মিটিং অনুষ্ঠিত হয়, যেখানে ডালিম, পাশা, হুদা, নূর আর সদ্য জেল থেকে মুক্তিপ্রাপ্ত ফারুক রহমান উপস্থিত ছিলেন। এ মিটিংয়ে সাংগঠনিক অগ্রগতি নিয়ে আলোচনা হয়। যেহেতু এ মিটিং ঢাকায় হয়, কাজেই সেখানে দিদারও উপস্থিত ছিল। অর্থাভাব, সাংগঠনিক তৎপরতার সমস্যা, বিশেষ করে সৈনিক সদস্যদের ক্রমাগত অসন্তোষ ইত্যাদির জন্য দিদার যথেষ্ট হতাশাগ্রস্ত হয়ে ওঠে এবং জুনের মধ্যে একটি অভ্যুত্থানে যাওয়ার জন্য মতামত দেয়। দিদারের উদ্বেগের আরও একটি কারণ ছিল, তা হলো সেনা গোয়েন্দা সংস্থার তৎপরতা। তবে তখন সে জানত না যে তার নির্বাচিত সৈনিক সংস্থার মধ্যে গোয়েন্দা সংস্থার একজন সদস্যও যোগ দিয়ে প্রতিদিনের খবরাখবর ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের গোচরে আনতে থাকে। সেনা সদরে ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষও ধৈর্যের সাথে অপেক্ষা করতে থাকে সঠিক দিন ও সময়ের জন্য। স্বীকার করতেই হবে যে এই প্রথম সেনা গোয়েন্দাদের তৎপরতা অত্যন্ত প্রশংসনীয় পর্যায়ে পৌঁছে। যখন একদিকে অভ্যুত্থানের ক্ষেত্র তৈরিতে সংশ্লিষ্ট অফিসাররা পরিকল্পনায় ব্যস্ত ছিল, ঠিক তেমনি অন্যদিকে সেনা কর্তৃপক্ষও তৈরি হচ্ছিল প্রমাণসহ সবাইকে গ্রেপ্তার করার জন্য। দিদারের সাথে বৈঠকের পরে বিদেশ থেকে আগত অফিসাররা পর্যায়ক্রমে জেএসডির একাধিক নেতার সাথে বৈঠক করে। এসব বৈঠকে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেওয়া হয় যে ‘সিপাহি বিপ্লব’ ঘটিয়ে জিয়াউর রহমান এবং সেনাপ্রধান এরশাদকে হত্যার মাধ্যমে বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি করে রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা দখল করা হবে।

এদিকে দিদারের সংগঠিত সৈনিক সংস্থার সদস্যবৃন্দের মধ্যে অসহিষ্ণুতা বৃদ্ধি পাচ্ছিল। তারা সত্বর অভ্যুত্থান না ঘটালে সমূহ বিপদে পড়তে হবে, তা বুঝতে পেরেই দিদারকে অভ্যুত্থানের জন্য ক্রমাগত চাপ দিচ্ছিল। সৈনিক সংস্থার এসব সদস্য দিদারের সাথে অন্য আরও অফিসার জড়িত আছে, সেটা জানত না বিধায় তারা দিদারের নেতৃত্বই মেনে নেয়। দিদার চাপের মুখে দ্বিধাগ্রস্ত হয়ে পড়ে। প্রায় সময় সে বোঝাতে চেষ্টা করে যে সশস্ত্র অভ্যুত্থানের মাধ্যমে ক্ষমতা দখল করে দেশ চালাবার মতো প্রজ্ঞা তার নেই কিন্তু তাতে সৈনিকরা দমে না, বরং তাদের মতামত দিয়ে তাকে বোঝাতে চেষ্টা করে যে লাইবেরিয়ায় যদি একজন সার্জেন্ট দেশ চালাতে পারে, তবে দিদার একজন মুক্তিযোদ্ধা লে. কর্নেল হয়ে তার পক্ষে বাংলাদেশ চালানো সম্ভব হবে না কেন। এ অকাট্য যুক্তির সামনে তার কোনো কথাই ধোপে টেকে না। দিদার না বুঝে যে আগুনে হাত দিয়েছিল, সেখান থেকে তার ফেরার পথ যে বন্ধ, সেটা সে আগে উপলব্ধি করতে পারেনি। অপর দিকে সামরিক গোয়েন্দা সংস্থার তৎপরতা বাড়ায় বিপ্লবী সংস্থার সৈনিকরা ২৬ মে চেয়ারম্যানবাড়িস্থ কাকলী রেস্টুরেন্টে এক গোপন সভায় মিলিত হয়ে ১৭ জুন বিপ্লবের দিন ধার্য করে। আর এ বিপ্লব ঢাকা সেনানিবাস থেকে শুরু করার সিদ্ধান্তে অটল থাকে। ওদিকে নুরুন্নবী দিদারের সাথে যোগাযোগ রক্ষা করে চলে।

গার্ড অব অনার গ্রহণ করছেন বঙ্গবন্ধু। ছবি: সংগৃহীত
গার্ড অব অনার গ্রহণ করছেন বঙ্গবন্ধু। ছবি: সংগৃহীত

১৭ জুন রাতে বিপ্লবী সৈনিকগণ এক দিকে কোত ভেঙে হাতিয়ার বার করার জন্য যখন তৈরি হচ্ছিল, তখন অপর দিকে সেনাসদরও তৈরি হচ্ছিল অভ্যুত্থানকারীদের হাতেনাতে গ্রেপ্তার করার জন্য। সন্ধ্যার পর যখন বিপ্লবী সৈনিকরা দিদারের সাথে যোগাযোগ করার চেষ্টা করে, তার কয়েক ঘণ্টা আগেই দিদার তার বাড়ি থেকে নিরুদ্দেশ হয়ে যায়। তখন অনেক দেরি হয়ে গেছে। ঢাকা সেনানিবাসে আর সাভারে বিপ্লবের সূচনা হতে চলেছে। সেনাসদরও ঠিক এ সময়ের অপেক্ষায় ছিল। ঝটিকা অভিযানে প্রায় সমস্ত সদস্যকে গ্রেপ্তার করা হয় আর দিদার নিরুদ্দেশ হওয়াতে তাকে গ্রেপ্তার করা সম্ভব হয়নি। সেনাসদরের সময়মতো হস্তক্ষেপে এ অভ্যুত্থানের প্রচেষ্টা অঙ্কুরেই বিনষ্ট হয়। লে. কর্নেল দিদার অভ্যুত্থানে নেতৃত্ব দিতে ব্যর্থ হয়ে ভারতে পালিয়ে গিয়ে নভেম্বরে গোপনে দেশে ফেরার পথে যশোরে গ্রেপ্তার হয়। লক্ষণীয় যে তার দুদিন আগেই রাষ্ট্রপতি জিয়া দেশের বাইরে আলকুদ কমিটিতে যোগদানের উদ্দেশ্যে বাংলাদেশ ত্যাগ করেন।

অভ্যুত্থানে জড়িত থাকার অপরাধে গ্রেপ্তারকৃত পাশার বিরুদ্ধে চার্জশিট তৈরি করা হয়। সে খুবই নরম ও দুর্বলচিত্তের অফিসার। কাজেই তাকে কিছুটা স্নায়ুচাপে রাখার পর সে সমস্ত ঘটনা স্বীকার করে সরকারি সাক্ষী হতে রাজি হলে তার সাথে আমি দেখা করি এবং সম্পূর্ণ ঘটনা লিপিবদ্ধ করি। আর কাজী মুনির হোসেন স্বেচ্ছায় রাজসাক্ষী হিসেবে থাকার ইচ্ছা প্রকাশ করলে তাকেও রাজসাক্ষী হিসেবে গ্রহণ করা হয়। কাজী মুনীর হোসেন বামপন্থী ছাত্রনেতা এবং জেএসডির সদস্য ছিল। মুনিরই রাজনৈতিক দল ও সৈনিক সংস্থার সাথে যোগাযোগ রক্ষা করার দায়িত্ব নিয়েছিল। বিভিন্ন জায়গায় লিফলেট বিলি করার দায়িত্বও তাকে দেওয়া হয়েছিল।

১৯৮১ সনের ১০ মার্চ অফিসারদের কোর্ট মার্শাল শুরু হলে পাঁচজন অভিযুক্তের মধ্যে দুজন রাজসাক্ষী হওয়ায় শুধুমাত্র দিদারুল আলম, নুরুন্নবী খান আর মোশারফ হোসেনকে অভ্যুত্থানে জড়িত থাকার দায়ে চার্জশিট দেওয়া হয়। লে. কর্নেল পাশা এবং মুনির হোসেনকে রাজসাক্ষী হিসেবে কোর্ট গ্রহণ করে। কয়েক মাস কোর্ট চলার পর তিনজনকেই দোষী সাব্যস্ত করে বিভিন্ন মেয়াদে কারাদণ্ড দেয়। এর মধ্যে দিদারুল আলম ১০ বছর, নুরুন্নবী খানকে ১ বছর এবং মোশারফ হোসেনকে ২ বছরের কারাদণ্ড দেওয়া হয়। যদিও আমার তরফ থেকে সেনা আইনের আওতায় প্রথমত সর্বোচ্চ শাস্তি দাবি করা হয়েছিল। রাজসাক্ষী হওয়ায় পাশাকে চাকুরিতে পুনর্বহাল আর মুনির হোসেনকে সসম্মানে মুক্তি দেওয়া হয়। কোর্টের রায়ে বাকি যারা অভ্যুত্থানের সঙ্গে জড়িত অথচ দেশে ফিরেনি, তাদের জন্য সরকারকে কার্যকরী ব্যবস্থার নির্দেশ দেওয়া হয়। কিন্তু আমার জানামতে কোনো অজ্ঞাত কারণে এদের বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থাই নেওয়া হয়নি। স্মরণযোগ্য যে এসব অফিসাররাই ১৫ আগস্টের অভ্যুত্থানের সাথে জড়িত এবং ৩ নভেম্বরের পর দেশ ছাড়ে।

এ মামলা পরিচালনাকালে আমাকে সাহায্য করেন ডেপুটি অ্যাটর্নি জেনারেল মোয়াজ্জেম হোসেন এবং প্রতিপক্ষ হিসেবে এ দেশের তিনজন প্রখ্যাত আইনজীবীর সাথে আমার পরিচয় ঘটে। আমি অকপটে বলতে চাই, আইনের ওপরে তাদের জ্ঞান, দক্ষতা, কৌশল আর অভিজ্ঞতা আমাকে ভীষণভাবে মুগ্ধ করেছিল। তাদের এ ধরনের কেসে (সামরিক কোর্টে) কৌঁসুলির কাজ করায় তাদেরও অভিজ্ঞতা হয়েছিল প্রচুর। এ তিনজন কৌঁসুলি হলেন দিদারের ডিফেন্স কাউন্সিল ব্যারিস্টার সিরাজুল ইসলাম (যিনি এরশাদের প্রথম মামলায় কৌঁসুলির দায়িত্ব পালন করেন), নুরুন্নবী খানের ডিফেন্স ছিলেন ব্যারিস্টার আমিনুল হক (পরে বাংলাদেশের অ্যাটর্নি জেনারেল) ও মোশারফ হোসেনের ডিফেন্স ছিলেন ভাষা আন্দোলনের একজন ভাষাসৈনিক অ্যাডভোকেট গাজীউল হক।

এ কোর্ট মার্শাল প্রথমে রুদ্ধদ্বার হলেও পরবর্তীকালে এর সম্পূর্ণ বিবরণ সাপ্তাহিক হলিডেতে ছাপা হতে থাকে।

এ মামলা পরিচালনাকালে এবং পরে এ অভ্যুত্থান সম্বন্ধে আমার মনে হচ্ছিল এ ধরনের অপরিপক্ব কাজ কী করে ফারুক, রশিদ এবং ডালিমের দ্বারা পরিকল্পনা করা হয়। তারা এ ধরনের কাজে দিদারুল আলমের মতো এমন একজন অফিসারকে কীভাবে বেছে নিয়ে অভ্যুত্থানের সম্পূর্ণ দায়িত্ব তার হাতে ছেড়ে দিল, যার (দিদার) সেনাবাহিনীতে কোনো প্রভাবই ছিল না। আর তা ছাড়া ১৯৭৫ সনে তাদের পক্ষে যা সম্ভব হয়েছিল, সে ধরনের কিছু ১৯৮০ সনেও নির্দ্বিধায় ঘটবে, সেটাই বা তারা কীভাবে মনে করতে পেরেছিল। কারণ, ১৯৭৫ সনের সেনাবাহিনী আর ১৯৮০ সনের সেনাবাহিনীর মধ্যে ছিল প্রচুর তফাত।

১৯৮০ সনে সেনাবাহিনী ১৯৭৫ সনের তুলনায় শুধু কলেবরেই বৃদ্ধি পায়নি, সেনাবাহিনী হয়েছিল আরও সুসংগঠিত। যে সমস্ত অফিসার তখন ইউনিট, ব্রিগেড, ডিভিশন এবং সেনাসদরে নিয়োজিত ছিলেন, তারা ১৯৭৫ সনের তুলনায় আরও অভিজ্ঞতাসম্পন্ন ছিলেন। সেনাবাহিনীর গোয়েন্দা সংস্থাগুলোও ছিল আরও সুসংগঠিত ও কর্মতত্পর।

(লেখাটি ব্রিগেডিয়ার জেনারেল এম সাখাওয়াত হোসেনের (অব.) বাংলাদেশ: রক্তাক্ত অধ্যায় ১৯৭৫-৮১ বই থেকে সংগৃহীত। বইটির প্রকাশক পালক পাবলিশার্স। লেখাটির বানানরীতি অপরিবর্তিত রাখা হয়েছে।)