রক্তসাগরে ১৮টি লাশ

মেজর আলাউদ্দিন আহমেদ পিএসসি (অব.) ১৯৭৫ সালের আগস্টে ছিলেন ঢাকা সেনানিবাসের স্টেশন হেডকোয়ার্টারে কর্মরত স্টেশন স্টাফ অফিসার। বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ডের পর তৎকালীন স্টেশন কমান্ডার লে. কর্নেল এম এ হামিদ কর্তৃক আদিষ্ট হয়ে তিনি বঙ্গবন্ধু পরিবারের সদস্যসহ সেদিনের মর্মান্তিক ঘটনায় নিহত ১৮ জনের লাশ সংগ্রহ ও দাফনের ব্যবস্থা করেছিলেন। এই স্মৃতিচারণায় মেজর আলাউদ্দিন তুলে ধরেছেন স্বচক্ষে দেখা সেদিনের সেই হত্যাকাণ্ডের নীরব সাক্ষী তিনটি বাড়ির মৃত্যুশীতল পরিবেশ, লাশগুলোর অবস্থার বিবরণ এবং সেগুলো সমাহিত করার গুরুভার দায়িত্বটি পালনের স্মৃতি।

১৫ আগস্ট ভোরবেলা। শুয়ে শুয়ে রেডিওর নব ঘোরাচ্ছি। এটা ছিল আমার অভ্যাস। সকালে নিয়মিত খবর শুনতাম। হঠাৎ করেই শুনলাম খবরটা। বঙ্গবন্ধু নিহত! হত্যাকারীদের অন্যতম মেজর শরীফুল হক ডালিম ভাষণ দিচ্ছে।

সঙ্গে সঙ্গে স্টেশন কমান্ডার লে. কর্নেল হামিদকে ফোন করলাম। রুদ্ধশ্বাসে খবরটা দিয়ে বললাম, ‘স্যার রেডিও শোনেন।’ উনি আমাকে বললেন দ্রুত তৈরি হয়ে অফিসে যেতে।

বাসার কাছে বলে হেঁটেই অফিসে চলে গেলাম। তখন সকাল সাতটার মতো বাজে। দেখলাম, অফিসাররা বিভিন্ন গ্রুপে আলাপ করছেন। জওয়ানসহ অন্য সেনাসদস্যরাও কানাকানি করছেন। সবার কথাবার্তার বিষয়বস্তুই এক—শেখ সাহেবের সদ্য ঘটে যাওয়া আকস্মিক হত্যাকাণ্ড।

অফিসে যাওয়ার পর একপর্যায়ে শুনলাম, বেশ কয়েকজন সিনিয়র অফিসার ৩২ নম্বরে গিয়েছেন। আমি নিজেও অফিসারদের বেশ কয়েকটি জিপ বেরিয়ে যেতে দেখেছি ক্যান্টনমেন্ট এলাকা থেকে। এর মধ্যে ছিল চিফ অব আর্মি স্টাফ ও ডেপুটি চিফের গাড়ি। যা হোক, ১৫ তারিখে বেলা দুইটা পর্যন্ত অফিসে থাকলাম। এর মধ্যে একবার বাসায় খেতে গিয়েছিলাম। স্টেশন কমান্ডার কর্নেল হামিদ বাইরেই বিভিন্ন দায়িত্বে ব্যস্ত ছিলেন। বিকেলের দিকে বাসায় চলে গেলাম। একসময় কর্নেল হামিদ ফোন করে আমাকে ‘স্ট্যান্ড টু’ করলেন। বললেন, আমি যেন মনোযোগ দিয়ে ফোনের পাশে থাকি। আমি সিদ্ধান্ত নিলাম, কাজের সুবিধার্থে অফিসে থাকাই ভালো এবং সে মতো অফিসে চলে গেলাম।

সন্ধ্যার পর থেকে আমি আমার অফিসেই আছি। রাত দুইটা নাগাদ কর্নেল হামিদের ফোন পেলাম। উনি বললেন, আমি যেন দুটি ট্রাক নিয়ে তিনটার মধ্যে ৩২ নম্বরে যাই। এ ব্যাপারে কর্নেল হামিদের নিজের লেখা একটি নোটও ড্রাইভার বা অন্য কেউ একজন আমার হাতে দিয়েছিল। আমাদের ট্রাক ছিল না। সাপ্লাই থেকে দুটি ট্রাক নিয়ে আমি আমার জিপে করে রওনা হলাম। ট্রাকে ১৫-২০ জন জওয়ানকে নিলাম আমি।

কর্নেল হামিদ ইতিমধ্যেই ৩২ নম্বরে অবস্থান করছিলেন। ক্যাপ্টেন বজলুল হুদা সেখানে ছিল তখন। হুদাকে আমি বোধ হয় এর আগে দেখেছি একবার, তবে না-ও দেখতে পারি। সে আমাকে চিনত না। সে জন্য সে প্রথমে আমাকে বাধা দেয়। পরে কর্নেল হামিদ এগিয়ে এসে তাকে আমার পরিচয় বলায় হুদা আমাকে ঢুকতে দেয়।

সেখানে জেসিও এনসিও যারা ছিল, তাদের কাছে ঘটনার পূর্বাপর জানার চেষ্টা করলাম। কিন্তু তাদের এলোমেলো কথাবার্তায় তেমন কিছুই পরিষ্কার হলো না। আমি নিজের দায়িত্বটা শেষ করতেই ব্যস্ত হলাম।

মৃতদেহগুলো তখন নিচে নামানো হয়েছিল। নিচতলা থেকে সিঁড়ি বেয়ে ওপরে গেলাম। একজন জেসিও কে কোথায় নিহত হয়েছেন আমাকে দেখাল। লাশগুলো কোথায় পড়ে ছিল, তা বোঝা যাচ্ছিল রক্তের দাগ থেকে। দেখলাম, শেখ সাহেবের পাইপ এবং ভাঙা চশমা তখনো মাঝ সিঁড়িতে পড়ে। কর্নেল হামিদ বলেছিলেন, যেখানে যা আছে, সেখানেই রেখে দিতে। দোতলার দেয়াল, জানালার শার্সি, মেঝে আর সিলিংজুড়ে রক্তের দাগ। ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে মগজ। দেয়ালে বেশ কিছু বিক্ষিপ্ত বুলেটের দাগ। কিছু গুলির খোসা পড়ে আছে মেঝেতে। কয়েকটি জানালার শার্সি চুরমার হয়ে গেছে গুলির আঘাতে।

বরফ আনা হয়েছিল। বরফের ব্লকগুলো কফিনের পাশে রাখা। কয়েকটি লাশ সাদা কাপড়ে ঢাকা ছিল। অধিকাংশ ছিল খোলা, যে কাপড় পরা ছিল, তাতেই প্যাঁচানো। লাশগুলো কফিনের মধ্যে ছিল। বঙ্গবন্ধুর লাশটি দেখলাম। পাঞ্জাবিটা রক্তে কালো হয়ে গেছে। বুকে ও পেটে অনেক গুলি লেগেছিল বোঝা যায়। ডান হাতের তর্জনীটা গোড়া থেকে প্রায় বিচ্ছিন্ন।

শুনলাম, বঙ্গবন্ধুর লাশ পড়ে ছিল দোতলায় ওঠার সিঁড়িতে। সিঁড়ির মাঝামাঝি থেকে তিন-চার ধাপ ওপরে। সিঁড়িতে পড়ে থাকা তাঁর চশমাটার একটি কাচ ভেঙে গিয়েছিল। বঙ্গবন্ধুসহ বাড়ির সবাইকে খুব কাছে থেকে গুলি করা হয়। আর প্রত্যেকেই যে তাৎক্ষণিকভাবে মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়েছিলেন, সেটাও ছিল পরিষ্কার। শেখ কামালের বুক ও পেটে স্টেনগানের তিন-চারটি বুলেট বিদ্ধ হয়েছিল। পরনে ছিল ট্রাউজার। তাঁকে হত্যা করা হয় একতলায়।

শেখ নাসের নিহত হন টয়লেটের কাছে। গুলির প্রচণ্ড আঘাতে একটি হাত উড়ে গিয়েছিল তার। শরীরে বেশ কয়েকটি বুলেটের আঘাত ছিল শেখ নাসেরের।

বেগম মুজিবের বুক ও মুখমণ্ডলে গুলি করা হয়। তার পরনে ছিল একটা সুতি শাড়ি ও কালো ব্লাউজ। গলায় সোনার চেইনের সঙ্গে একটি তাবিজ ছিল তার। কড়ে আঙুলে একটি ছোট আংটি। পরনে তখনো একটা বাথরুম স্লিপার! সুলতানা কামালেরও আঘাত ছিল বুক আর পেটে। পরনে ছিল তার শাড়ি-ব্লাউজ।

শেখ জামালের মাথাটা উড়ে গিয়েছিল বুলেটের তোড়ে। তার পরনে ছিল ট্রাউজার। জামালের ডান হাতের অনামিকায় ছিল একটি আংটি। আমার হঠাৎ করে মনে হলো, এটাই তার বিয়ের আংটি ছিল কি!

রোজী জামালের শরীরটা একেবারেই ফ্যাকাসে দেখাচ্ছিল। তার মাথার খানিকটা ছিল না। গুলি লেগেছিল পেট, বুক আর মাথায় তো বটেই। তার পরনেও ছিল শাড়ি-ব্লাউজ।

রাসেলের লাশটাও দেখা হলো। দেখলাম ছোট একটি বাচ্চা। মাথা একেবারেই নেই। হাফপ্যান্ট পরা। তার পায়ে মনে হলো ছোটবেলার একটি পোড়ার দাগ, তখন সেরে গিয়েছিল। একটি লুঙ্গি দিয়ে পেঁচিয়ে রাখা হয়েছিল রাসেলের লাশ।

বঙ্গবন্ধুর বাসভবনে আগে থেকে অবস্থানরত এনসিও ও জওয়ানদের কাছ থেকে জানতে পারি, শেখ কামাল ও টেলিফোন অপারেটর নিহত হন অভ্যর্থনাকক্ষে। শেখ নাসের একতলার সিঁড়ির কাছে বাথরুমের বাইরে। বেগম মুজিব নিহত হন মূল বেডরুমের সামনে। কামাল, শেখ জামাল ও সুলতানা, রোজী জামাল নিহত হন বেডরুমের ভেতর।

৩২ নম্বর থেকে আমি চলে গেলাম শেখ মনির বাসায়। ওখানে গিয়ে দেখি কোনো লোকজন নেই। একদম খালি। শেখ মনির বাড়ির মধ্যে জিনিসপত্র সব অগোছালো। শেখ সাহেবের বাড়িতেও দেখেছি সব জিনিসপত্র ছড়ানো ছিটানো। তার অর্থ ওখান থেকে বেশ কিছু জিনিসপত্র চলে গেছে। বাড়ির সবাইকে মারার পর মালপত্রগুলো তো কোনো লোকেই খুলেছে! ওই সিপাই এবং কাজের মেয়ে গোছের দু-তিনজন মহিলা আমাকে বলল, আর্মি আসছে দেখে আমরা ভয় পেয়ে চলে যাই।

বাড়ির কারও হয়তো পেটের অসুখ ছিল। নাকি সকালে শেখ মনি চিড়া খেতেন! একটা বোলের মধ্যে দেখলাম ভেজানো চিড়া তেমনিই আছে। পাশেই রক্তের চিহ্ন। বাড়ির দোতলাতেও তারা উঠেছে, এটার প্রমাণ মিলল জিনিসপত্রের অবস্থা দেখে। দেখলাম সেখানে লাশ নেই। দু-তিনজন যারা এসেছিল, তাদের আমি জিজ্ঞেস করলাম কয়জন মারা গেছে এখানে। মহিলাদের একজন বলল, ‘লাশ তো স্যার দুইজন না, লাশ তিনজন। বেগম সাহেবের বাচ্চা হতো!’

ওখান থেকে সেরনিয়াবাত সাহেবের বাড়িতে গেলাম আমি। দেখলাম, সেখানেও কোনো লাশ নেই। বাড়িতে কাজের লোকজন যারা ছিল, সার্ভেন্টস কোয়ার্টার ও ওপাশের অফিসার্স ক্লাব থেকে বেরিয়ে এল। ওরা বলল, লাশ সৈন্যরা নিয়ে গেছে। ও বাড়িতে সবাইকে মারা হয়েছে নিচতলায়। আমি যখন গিয়েছি, তখনো প্রচুর রক্ত ছিল। কালো কালো হয়ে গেছে, কিন্তু শুকিয়ে যায়নি তখনো। সোফাটোফার মধ্যেও রক্ত। আমি তখন চিন্তা করলাম, হয়তো নিশ্চয়ই লাশগুলো মেডিকেল কলেজে আছে। তারপর আমি মেডিকেল কলেজে চলে আসলাম। ভোর হবে হবে এমন অবস্থা। মেডিকেল কলেজে একজন ডিউটি অফিসার আমাকে বললেন, ‘আমাদের এখানে লাশ আছে। তবে কার লাশ কোনটা জানি না। লাশগুলো মর্গে আছে।’

মর্গের ইনচার্জের কাছে গেলাম। তিনি আমাকে বললেন, লাশগুলো যদি নিতে চান, নিয়ে যেতে পারেন, আমাদের কাছে কোনো লিস্ট নেই। মর্গে কিছু লাশ গাদা করে রাখা ছিল। দুর্গন্ধ বেরোচ্ছিল তা থেকে। আমি যেগুলো গুলিবিদ্ধ লাশ, সেগুলো খুঁজতে লাগলাম। ওখান থেকে গুলিবিদ্ধ লাশগুলো বের করে ট্রাকে ওঠালাম। আমার সঙ্গে দুটি ট্রাক ছিল। ওখানে শেখ মনি, তার স্ত্রী, সেরনিয়াবাত সাহেবসহ ১১টি লাশ পাই। সেরনিয়াবাত সাহেবের বাড়িতে বেশ কয়েকজন নিহত হয়েছিল। লাশগুলো নিয়ে আমরা ৩২ নম্বরে চলে এলাম। সেখানে আরেকটা ট্রাকে বেগম মুজিব, শেখ নাসের, শেখ কামাল, সুলতানা কামাল, শেখ জামাল, রোজী জামাল, রাসেল—এদের লাশ তোলা হয়। তখন মোটামুটি সকাল। রাস্তাঘাটে প্রাতর্ভ্রমণকারীদের চলাফেরা শুরু হয়ে গেছে।

শেখ সাহেব, শেখ মনি ও জনাব সেরনিয়াবাতের বাড়ি তিনটি তালাবদ্ধ করে দেওয়া হলো এরপর! চাবিগুলো জমা দেওয়া হলো স্টেশন হেডকোয়ার্টারে।

আমি যাদের বনানী পাঠিয়ে দিয়েছিলাম, তারা ইতিমধ্যে বেশ কয়েকটি কবর খুঁড়ে রেখেছিল। চারটি কবর তখনো খোঁড়া হয়নি। সৈনিকদের মধ্যে নিষ্ক্রিয় ছিল অনেকে। লাশের খারাপ অবস্থাও ছিল একটা কারণ। আসলে সেনাবাহিনীতে তখন ডিসিপ্লিন বলতে যা বোঝায় তা ছিল না। বিভিন্ন গ্রুপ ছিল। সিপাহিদের অনেকে লাশগুলো দেখে এমন মন্তব্য করছিল, যা সৈনিকসুলভ না। লাশ তারা ধরতেও রাজি ছিল না। আমি তখন জওয়ানদের বললাম, আমাদের দায়িত্ব এদের দাফন করা। ওদের উৎসাহিত করতে আমি নিজে হাত লাগালাম প্রথমে। পরে অন্যরাও এগিয়ে এল। লাশগুলো একটা একটা করে কবরের পাশে নামিয়ে রাখলাম। বনানী কবরস্থানের ৭ নম্বর রোতে মোট ১৮টা কবর কাটা হয়।

প্রথমে বেগম মুজিবের লাশ নামানো হয়। বেগম মুজিবের লাশ আমি নিজে, আমার ড্রাইভার ও একজন এনসিও কবরে নামাই। বেগম মুজিবের গলায় তাবিজ, কড়ে আঙুলের আংটি তেমনি ছিল। আমি বেগম মুজিবের আংটি, তাবিজ; শেখ জামালের আংটি ইত্যাদি খুলে নিয়ে একটা লিস্ট করলাম জিনিসগুলোর এবং পরে তা স্টেশন কমান্ডারের কাছে জমা দিই। আমাদেরকে বেঁধে দেওয়া সময় ফুরিয়ে গিয়েছিল বলে শেষের চারটি কবর ভালোভাবে খোঁড়া হয়নি। মাত্র ফুট দু-এক গভীর করা গিয়েছিল সেগুলো। শেষ লাশ কটি তড়িঘড়ি করে তাতেই সমাহিত করা হয়।

দাফন শেষ করে অফিসে চলে গেলাম আমি। আমার সেখানে যাওয়ার পরে, ১১টার দিকে বঙ্গবন্ধুর লাশ ক্যান্টনমেন্টে নিয়ে যাওয়া হয়। লাশ টুঙ্গিপাড়ায় নিয়ে যেতে হবে। স্টেশন কমান্ডার তখন ছিলেন না। কোয়ার্টার মাস্টার নূর মোহাম্মদকে কাফনের কাপড় কিনতে বললাম। িসএসডি স্টোর থেকে ১০ গজ সাদা কাপড় কেনা হলো বাকিতে! শেখ সাহেবের লাশ নিয়ে চলে গেলেন মেজর মহিউদ্দিন। 

(দৈনিক ভোরের কাগজে ১৯৯৭ সালের ১৪ আগস্ট প্রকাশিত। সংক্ষেপিত ও পরিমার্জিত)