একটুখানি শান্তি

আর কদিন পরই ঈদুল আজহা। গত বছর ঈদুল আজহা হয়েছিল ২ সেপ্টেম্বর। তখন রোহিঙ্গা নারী-পুরুষ, শিশু-কিশোররা মিয়ানমার থেকে শুধু প্রাণটুকু হাতে নিয়ে বাংলাদেশে এসেছিল। একটু আশ্রয় পাওয়া, একটু খাবার সংস্থানেই ব্যস্ত ছিল। তাই গত বছর ঈদ বলে কিছু ছিল না তাদের কাছে। গত এক বছরে কিছুটা থিতু হয়েছে তারা, এবারের ঈদের চিত্রও ভিন্ন।

৯ সন্তানের মা জায়েদা জানালেন, রাখাইনে থাকা অবস্থায় তাঁর স্বামী গুলিবিদ্ধ হন। কোনোভাবে ক্যাম্প পর্যন্ত আনতে পারলেও তাঁকে বাঁচানো যায়নি। রাখাইনে নিজেদের আবাদি জমি ফেলে এসেছেন। হালচাষের জন্য নিজেরই গরু ছিল বেশ কয়েকটা। ঈদে কোরবানিও দিতেন ঘটা করে। এবার শরণার্থী ক্যাম্পে থিতু হলেও পশু কোরবানির কথা ভাবতে পারেন না। এমন গল্প শুধু জায়েদার নয়, মিয়ানমার থেকে আসা শরণার্থী অনেকেরই গল্প এক।

কক্সবাজারের উখিয়ার বালুখালী-২-এর ময়নারঘোনা রোহিঙ্গা ক্যাম্প। ঢুকে দেখা গেল একজন নারী আপনমনেই খেলনা এক ট্রেন নিজের কাছে টেনে আনছেন আবার ছেড়ে দিচ্ছেন। তাই দেখে অন্য নারীরা খিলখিল করে হাসছেন। পা ছড়িয়ে বসে কয়েকজন গল্পে মশগুল। পাশের ঘরেই ১৬ বছরের রাবেয়া বসরী সেলাই মেশিনে খুটখুট শব্দ করে একটি বাজু (ব্লাউজ) বানাচ্ছে। রাখাইনে যখন ছিল তখন পঞ্চম শ্রেণি পর্যন্ত পড়েছিল। এই কিশোরীর দুই হাতে মেহেদির আলপনা আঁকা। দুই কিশোরী লুডুর ছক্কা, কানা মারছে, দুজনের মুখেই জেতার জন্য তুমুল উত্তেজনা। ময়নারঘোনা রোহিঙ্গা ক্যাম্পের নারীবান্ধব স্থানের (উইমেন ফ্রেন্ডলি স্পেস) দৃশ্য এটা। রোহিঙ্গা নারী ও শিশুরা নিজেরা আবার জায়গাটার নাম দিয়েছে শান্তিখানা। এমন নাম কেন? জিজ্ঞেস করলে তাদের জবাব-এখানে এলে শান্তি লাগে, তাই এর নাম ‘শান্তিখানা’।

ময়নারঘোনা ক্যাম্পে মোট ৩৫টি বেসরকারি সংস্থা ও এনজিও কাজ করছে দেড় লাখ মানুষের জীবনমান উন্নয়নে। আন্তর্জাতিক সংস্থা অ্যাকশন এইড ‘সাইট ম্যানেজমেন্ট’ কার্যক্রমের মাধ্যমে এখানে সমন্বয়ের কাজ করছে। এ সংস্থার হিসাব বলছে, এই দেড় লাখ মানুষের মধ্যে ৬৫ শতাংশই নারী ও কিশোরী। এই নারী ও কিশোরীদের প্রায় সবারই চোখের সামনে কিছু না কিছু ঘটনা ঘটে গেছে, যা তাদের সব সময় তাড়িয়ে বেড়ায়। এই তাড়িয়ে বেড়ানো কষ্ট খানিকটা কমাতে ময়নারঘোনা ক্যাম্পে অ্যাকশন এইড সাতটি উইমেন ফ্রেন্ডলি স্পেস এবং বন্যা, ভূমিধসসহ বিভিন্ন দুর্যোগে নারীদের আশ্রয় দেওয়ার জন্য আরও দুটি কেন্দ্র চালু করেছে।

এ ধরনের একটি শান্তিখানায় বসে নারীদের সঙ্গে কথা হয় ১২ আগস্ট দুপুরবেলা। বাঁশের বেড়া দিয়ে তৈরি শান্তিখানার ভেতরে আলো-আঁধারি পরিবেশ। বেড়ার গায়ে কাগজ কেটে কেটে নানান নকশা করা হয়েছে।

এই কেন্দ্রে পুরুষদের প্রবেশ সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ। নিয়ম অনুযায়ী, নারীদের জীবনে ঘটে যাওয়া এমন কোনো বিষয় নিয়ে প্রশ্ন করা যাবে না যাতে করে তাঁরা মনে কষ্ট পান। তাই বাংলাদেশে তাঁরা কেমন আছেন, সমস্যা কী কী-এসব নিয়েই দোভাষীর সহায়তায় চলতে থাকে আলাপচারিতা।

ময়নারঘোনা রোহিঙ্গা ক্যাম্পের শান্তিখানায় সময় কাটাচ্ছেন কয়েকজন কিশোরী ও নারী
ময়নারঘোনা রোহিঙ্গা ক্যাম্পের শান্তিখানায় সময় কাটাচ্ছেন কয়েকজন কিশোরী ও নারী

বাংলাদেশে কেমন আছেন? নারীরা যখন এ প্রশ্নের উত্তর দিচ্ছিলেন তখন পেছনে ফেলে আসা মৃত্যু ভয়। তাই হয়তো তাঁদের চোখ-মুখে অস্থায়ি হলেও খুশির ঝিলিকই বলে দিচ্ছিল কেমন আছেন। প্রথম দিকে তেমন একটা কথা বলতে না চাইলেও একপর্যায়ে এই নারীরাই তাঁদের জীবনের ঝাঁপি খুলে দিতে থাকেন। কয়েকজন এই প্রতিবেদককে তাঁদের ক্যাম্পের ১০ ফুট বাই ১২ ফুট ঘরে নিমন্ত্রণও করেন। শান্তিখানা থেকেই শেখা জন্মনিয়ন্ত্রণ পদ্ধতির ব্যবহার, মাসিকের সময় প্যান্টি পরার অভ্যাস করাসহ বিভিন্ন বিষয় বলতে গিয়ে তাঁরা হেসেই বাঁচেন না।
এই কেন্দ্রে কর্মরত নারী কর্মী এবং বিভিন্ন সহায়তা নিতে আসা রোহিঙ্গা নারীদের জন্য আছে নিরাপদ পানির ব্যবস্থা। আছে টয়লেট, যাতে সাবানসহ অন্য দরকারি সরঞ্জাম রাখা আছে। শুক্রবার ছাড়া প্রতিদিন সকাল ৯টা থেকে বেলা সাড়ে তিনটা পর্যন্ত কেন্দ্রগুলোয় নারীরা যাঁর যখন খুশি তখন আসছেন, যাচ্ছেন। প্রতিদিন ৫০ থেকে ৭০ জন নারী বিভিন্ন সহায়তার জন্য আসেন।

৪৫ বছর বয়সী রংবাহার জানালেন, তাঁর স্বামী আর ২৫ বছরের ছেলেকে রাখাইনে মিয়ানমারের সৈন্যরা গুলি করেছিল। স্বামী ও ছেলে বেঁচে আছেন না মারা গেছেন, সে খবর তাঁর অজানা। এখন তিন ছেলে ও এক মেয়ে নিয়ে ক্যাম্পে আছেন। ক্যাম্পে আশ্রয় নিয়েছেন প্রায় এক বছর হলো, কিন্তু রাখাইনের স্মৃতিগুলো স্বস্তি দেয় না। তিনি বলেন, ‘আর কখনো একটু শান্তি পাব, তা ভাবিনি। এখন এই শান্তিখানায় বসলে একটু হলেও শান্তি পাই।’

অ্যাকশন এইড বাংলাদেশের কান্ট্রি ডিরেক্টর ফারাহ কবীর প্রথম আলোকে বলেন, এখানে কেউ আসেন সেলাই বা অন্য কোনো প্রশিক্ষণের জন্য। আবার অনেকেই ফ্যানের বাতাসে বসে অন্যদের সঙ্গে সুখ-দুঃ‍খের কথা বলেন। কেউ চুপ করে শুধুই বসে থাকেন, তারপর চলে যান। বঞ্চনা এবং চরম নির্যাতনের শিকার নারীরা এই কেন্দ্রকে নিজেদের জন্য নিরাপদ জায়গা ভাবছেন। তাঁরা যে পরিবেশ থেকে এসেছেন সে তুলনায় এটি তাঁদের কাছে শান্তির নীড়। এখানে মানসিক যন্ত্রণা লাঘবে মানসিক স্বাস্থ্যসেবা বা সহায়তা দেওয়া হচ্ছে।

আগের মতো ঈদ কাটানোর কথা ভাবেন না, মিয়ানমার থেকে আসা এই শরণার্থীরা। তবে ঈদুল আজহায় তাঁদের জন্য কিছু না কিছু করার চেষ্টা আছে সরকার ও বিভিন্ন সংস্থার। কক্সবাজারের জেলা প্রশাসক মো. কামাল হোসেন প্রথম আলোকে জানালেন, বিভিন্ন দাতাগোষ্ঠী, এনজিও, দাতা সংস্থা এবং সরকারের পক্ষ থেকে রোহিঙ্গা ক্যাম্পগুলোয় ঈদের দিন মাংস পৌঁছানোর ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে। তাই তাঁরা ঈদের দিন আনন্দে কাটাতে পারবেন।