দেখুন, দেখুন আমাকে দেখুন!!

উদ্ভট পোশাক পরে নয়, বরং নিজের ব্যক্তিত্ব দিয়ে অন্যের দৃষ্টি আকর্ষণ করা স্বাভাবিক আচরণ। মডেল: সুজাত শিমুল, ছবি: সুমন ইউসুফ
উদ্ভট পোশাক পরে নয়, বরং নিজের ব্যক্তিত্ব দিয়ে অন্যের দৃষ্টি আকর্ষণ করা স্বাভাবিক আচরণ। মডেল: সুজাত শিমুল, ছবি: সুমন ইউসুফ

ফেসবুকে লিমনের (ছদ্মনাম) হঠাৎ একটা পোস্ট দেখে তাঁর বন্ধুরা সবাই টেলিফোনে, মেসেঞ্জারে তাঁকে খুঁজতে লাগল। কিন্তু লিমনের পাত্তা নেই তো নেইই! দশ-বারো ঘণ্টা পার হওয়ার পর সবাই যখন একটু ভয় পেয়ে গেল, তখন লিমন জানাল সে ভালোই আছে, এমনিতেই একটু মজা করেছিল।

লিমনের মতো অনেকে আছেন যাঁরা সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে বা বাস্তবজীবনে এমন কিছু বলেন, লেখেন বা আচরণ করেন যার ফলে আশপাশের সবাই একটু নড়েচড়ে বসেন, তাঁর দিকে মনোযোগ দেন। কেউ হয়তো প্রতিষ্ঠিত সত্যকে চ্যালেঞ্জ করেন, কেউ নিজের বিষয়ে কিছু বলেন, কেউবা অন্য কোনো ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠান সম্পর্কে সাড়া জাগানো তথ্য হাজির করেন আর কেউবা উদ্ভট কোনো আচরণ করে সবার মনোযোগের কেন্দ্রবিন্দুতে চলে আসেন।

অপরের মনোযোগ আকর্ষণ করা বা অ্যাটেনশন সিকিং বিহেভিয়র মার্কিন মনোবিদ আব্রাহাম হ্যারল্ড মাসলোর চাহিদার সোপানতত্ত্বে মাঝের পর্যায়ে ব্যাখ্যা করা হয়েছে। মৌলিক চাহিদাগুলো পূরণ হওয়ার পর মানুষ তাঁর মানসিক চাহিদা পূরণ করতে চান। এ পর্যায়ে সামাজিক সম্পর্ক, বন্ধুত্বের পাশাপাশি মানুষ চান অন্যরা তাঁর প্রশংসা করুক, তাঁকে সম্মানিত করুক, স্বীকৃতি দিক। চাহিদার নানা পর্যায়ে মানুষ তাঁর প্রেরণার উৎস খুঁজে পান এবং সে অনুযায়ী আচরণ করেন। কখনো কখনো উদ্ভট পোশাক পরেও অন্যের দৃষ্টি আকর্ষণ করতে চান অনেকে।

অপরের মনোযোগ পাওয়ার জন্য মানুষের যে আচরণ তা তার স্বভাবগত ও শৈশবজাত। শিশুর কান্না, বাবা-মায়ের মনোযোগ আকর্ষণ করার চেষ্টা। অনেক সময় শিশুরা কিছু অনাকাঙ্ক্ষিত আচরণ করে যেমন চিৎকার করে, অপরের গায়ে থুতু দেয়, নিজের মাথা নিজে দেয়ালে ঠুকে, বাজে কথা বলে; মূলত এগুলো সবই মনোযোগ আকর্ষণ করার প্রচেষ্টা! শিশুদের জন্য, বিশেষ করে ৩ থেকে ৭ বছর বয়সী শিশুদের এই মনোযোগ আকর্ষণ করতে চাওয়া সম্পূর্ণ স্বাভাবিক।

শৈশবে তারা যখন নিজের চাওয়াটাকে সুসংগঠিতভাবে প্রকাশ করতে পারে না, তখন তারা এ ধরনের আচরণ করে অন্যের বিশেষত বাবা-মায়ের মনোযোগ চায়। মজার বিষয় হচ্ছে, ভালো বা প্রশংসনীয় আচরণ করে মনোযোগ চাওয়ার পাশাপাশি কখনো তারা নিন্দনীয় ও গর্হিত আচরণ করে মনোযোগ চায়। কারণটা হচ্ছে, বাবা-মায়েরা শিশুর গর্হিত আচরণ কমানোর জন্য অতি উদ্‌গ্রীব থাকেন। ওই আচরণ করার সময় বেশি বেশি তার দিকে মনোযোগ দেন, ফলে শিশুর মধ্যে একটা শর্তাধীন (কন্ডিশনিং) অবস্থা তৈরি হয়। তখন সে বাবা-মায়ের মনোযোগ পেতে গর্হিত আচরণটিই বারবার করতে থাকে। যেমন একটি শিশু অপরকে থুতু দিচ্ছে, এতে করে তার বাবা-মা উদ্বিগ্ন হয়ে যতবার সে থুতু দেয় ততবার তাকে নিষেধ করেন বা বুঝিয়ে বলেন বা ধমক দেন, কখনো বা রেগে গিয়ে দু-এক ঘা লাগিয়েও দেন। এই নিষেধ করা, বুঝিয়ে বলা, ধমক দেওয়া বা পিটুনি দেওয়া 

মানেই হচ্ছে শিশুর প্রতি মনোযোগ দেওয়া। আশ্চর্য মনে হলেও এ কথা সত্যি যে শিশু ধমক বা পিটুনি খাওয়ার মধ্য দিয়েও বাবা-মায়ের মনোযোগ কামনা করে।

শিশুতোষ মনোযোগ আকর্ষণ করার আচরণগুলো পরিণত বয়সেও কারও কারও মধ্যে বিদ্যমান থাকে। দেখা যায়, বন্ধুমহলে এমন ধরনের কথা বলছে, বা এমন একটা ঠাট্টা সে করছে যে সবাই তার দিকে নজর দিচ্ছে। নেতিবাচক, অগ্রহণযোগ্য কথা বললে বা আচরণ করলে সহজেই মনোযোগ পায়। বিতর্কিত বিষয়ে কথা বলা, সামাজিক রীতিনীতির পরিপন্থী আচরণ করা, নিজেকে আঘাত করা, যেকোনো ধরনের হুমকি দেওয়া বা একজন গুণীজনের বিরুদ্ধে হঠকারী কথা বলা—সবই মনোযোগ আকর্ষণ করার চেষ্টা। প্রতিনিয়ত অপরের মনোযোগ আকর্ষণ করার চেষ্টা কখনো প্রাপ্তবয়স্ক মানুষের চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য আবার কখনো সেগুলো কিছু মানসিক রোগের লক্ষণ হিসেবে বিবেচিত হয়।

‘আমাকে দেখুন’ এই প্রবণতা মানুষকে কখনো কখনো খেলো করে ফেলে। মনোযোগ পাওয়ার বদলে অন্যের কাছে নিজেকে ছোট করে। তাই অহেতুক মনোযোগ পাওয়ার চেষ্টা না করে, আত্মপ্রচারে মগ্ন না হয়ে সত্যিকারের অর্জনের জন্য সচেষ্ট হতে হবে। অর্জন যদি উল্লেখযোগ্য হয়, মনোযোগপ্রাপ্তি তখন অবশ্যম্ভাবী।

কী করা উচিত?

● শৈশব থেকেই একজন শিশুর গ্রহণযোগ্য ভালো আচরণগুলোর প্রতি মনোযোগী হন আর অগ্রহণযোগ্য, নিন্দনীয় আচরণকে উপেক্ষা করুন। তবে কখনোই শিশুকে অবহেলা করবেন না।

● সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে যাঁরা আত্মপ্রচারপ্রিয় তাঁদের অহেতুক মনোযোগ আকর্ষণ করার মতো লেখা, মন্তব্য বা পোস্টকে উপেক্ষা করতে হবে। তাঁদের সেই মনোযোগ আকর্ষণ করতে চাওয়ার প্রেরণা থেকে সৃষ্ট লেখা, মন্তব্য বা পোস্টকে যত বেশি গুরুত্ব দেবেন, তত তাঁর মধ্যে এই ধরনের আচরণ আরও বাড়তে থাকবে। আর তাঁর এই আচরণগুলোকে উপেক্ষা করতে থাকলে একসময় সে আর এ ধরনের আচরণ করবে না।

● পরিকল্পিত উপেক্ষা (প্ল্যানড ইগনোরিং) পদ্ধতি অবলম্বন করা যেতে পারে—যেখানে অহেতুক মনোযোগ আকর্ষণ করার চেষ্টায় লিপ্ত ব্যক্তির চোখে চোখ রেখে না তাকানো, তাঁর কথার জবাব না দেওয়া এবং ইশারা-ইঙ্গিতেও তাঁর সঙ্গে যোগাযোগ না করা।

● মনোযোগ আকর্ষণ করতে পারে এমন আচরণ পরিহার করতে হলে একটি শৃঙ্খলাবদ্ধ জীবনযাপন করার অভ্যাস করতে হবে।

● আত্মবিশ্বাস বাড়ে এমন উদ্যোগ গ্রহণ করতে হবে। জীবনের লক্ষ্য উদ্দেশ্য সম্পর্কে স্থির থাকা প্রয়োজন।

● সামাজিক দক্ষতা বাড়াতে হবে। সমাজের সব স্তরের সঙ্গে নিজেকে খাপ খাইয়ে নেওয়ার মতো দক্ষতা অর্জন করার পাশাপাশি সামাজিক সম্পৃক্ততা বাড়াতে হবে।

● যদি মনে হয় কারও মধ্যে ব্যক্তিত্বের বিকার (পারসোনালিটি ডিজ-অর্ডার) বা মানচুসেন সিনড্রোমের মতো মানসিক রোগ রয়েছে, তখন প্রয়োজনে মানসিক রোগ বিশেষজ্ঞের পরামর্শ গ্রহণ করতে হবে।

মানুষ কেন মনোযোগ আকর্ষণকারী আচরণ করে

● যখন কেউ নিরাপত্তাহীনতায় ভুগতে থাকেন, নিজের অস্তিত্ব বিপন্ন এমনটা বোধ করেন, তখন তিনি মনোযোগ আকর্ষণকারী আচরণগুলো করে থাকেন।

● যদি কেউ মনে করেন যে তাঁর কাজগুলো সঠিক প্রতিষ্ঠান বা ব্যক্তির কাছ থেকে যথাযথভাবে মূল্যায়িত হচ্ছেন না, তখন তিনি এমন কিছু আচরণ করেন যাতে তাঁর দিকে সকলের নজর পড়ে

● যাঁদের মধ্যে সামাজিক দক্ষতা কম—যেমন কার্যকর সিদ্ধান্ত নেওয়ার ক্ষমতা নেই, দৈনন্দিন সমস্যা সমাধানের কৌশল রপ্ত করতে পারেননি, তাঁদের মধ্যেও মনোযোগ আকর্ষণকারী আচরণ থাকে।

● পেশা বা ব্যক্তিজীবনে আপাত সফল অথচ যিনি জানেন যে তাঁর মধ্যে দক্ষতা আর যোগ্যতার ঘাটতি আছে, তিনি নিজের সঙ্গে প্রতারণা করে দিনাতিপাত করেন। তিনিও মনোযোগ আকর্ষণকারী আচরণ করে থাকেন।

● শৈশবে যদি কেউ তাচ্ছিল্য, অবহেলা বা নিপীড়নের শিকার হন, তখন তাঁর মনো-সামাজিক বিকাশ বাধাগ্রস্ত হয় এবং পরিণত বয়সে তাঁর মধ্যে অপরের মনোযোগ আকর্ষণ করার আচরণগুলো দেখা যায়।

● ব্যক্তিত্বের বিকার (পারসোনালিটি ডিজ-অর্ডার) বিশেষ করে হিস্ট্রিয়োনিক, বর্ডার লাইন ও নার্সিসিস্টিক পারসোনালিটি সমস্যায় মনোযোগ আকর্ষণকারী আচরণ থাকে। হিস্ট্রিয়োনিকের ক্ষেত্রে কণ্ঠস্বর থেকে শুরু করে শারীরিক ভঙ্গি সর্বত্র লাস্যময়তা বা আবেদন সৃষ্টিকারী নাটুকে আচরণ দেখা যায়। বর্ডার লাইনের ক্ষেত্রে আত্মপরিচয়ের সংকট থেকে নিজের ক্ষতি করে (হাত, পা কেটে, পুড়িয়ে, ঘুমের ওষুধ খেয়ে) অপরের মনোযোগ পাওয়ার চেষ্টা থাকে।

● মানচুসেন সিনড্রোম বলে একটি মানসিক রোগ আছে, যেখানে আক্রান্ত ব্যক্তি বারবার এমন আচরণ করে যেন তাঁর কোনো বড় ধরনের রোগ আছে, অথচ প্রকৃতপক্ষে তাঁর কোনো শারীরিক রোগ নেই। মূলত অপরের মনোযোগ পাওয়ার জন্য তাঁরা নিজের মধ্যে রোগের লক্ষণ আছে এমনটা দেখাতে চান।

সহযোগী অধ্যাপক, জাতীয় মানসিক স্বাস্থ্য ইনস্টিটিউট, ঢাকা।