বিদায় কফি আনান

কফি আনান (৮ এপ্রিল ১৯৩৮—১৮ আগস্ট ২০১৮)। ছবি: সংগৃহীত
কফি আনান (৮ এপ্রিল ১৯৩৮—১৮ আগস্ট ২০১৮)। ছবি: সংগৃহীত

জাতিসংঘের মহাসচিব হিসেবে দুই মেয়াদে দায়িত্ব পালনকারী কফি আনান ১৮ আগস্ট মারা যান। ২০০১ সালে তিনি বাংলাদেশ সফরে এসেছিলেন। বাংলাদেশের প্রতি তাঁর ছিল বিশেষ দৃষ্টি। বাংলাদেশে এসে তিনি পরিবেশ ও উন্নয়ন নিয়ে জনবক্তৃতা দিয়েছিলেন। কফি আনানের বাংলাদেশ সফরের সময় এবং নিউইয়র্কে জাতিসংঘের সদর দপ্তরে তাঁকে কাছ থেকে দেখেছেন বেশ কজন বাংলাদেশি কূটনীতিক। তাঁদের স্মৃতিতে উঠে এসেছে বাংলাদেশের প্রতি কফি আনানের আগ্রহ এবং তাঁর সহজ-সরল জীবনযাপনের কথা।

যুক্তরাষ্ট্রের নিউইয়র্ক। জাতিসংঘের সদর দপ্তর। বহুতল এই ভবনের ৩৮ তলায় জাতিসংঘ মহাসচিবের কার্যালয়। একটু দেরিতে যাঁরা অফিস থেকে বের হতেন, মাঝেমধ্যেই তাঁরা একটা দৃশ্য দেখে মজা পেতেন। সন্ধ্যা ছয়টার দিকে ৩৮ তলা থেকে নামতেন সেই সময়ের মহাসচিব কফি আনান। নেমে তিনি গাড়িতে উঠতেন না। দ্রুত পায়ে ম্যানহাটানের দিকে হাঁটা শুরু করতেন। কেতাদুরস্ত নিরাপত্তাকর্মীরা কোনো কিছু বোঝার আগেই অনেকটা এগিয়ে যেতেন তিনি। রাস্তার মানুষজন কৌতূহল নিয়ে দেখতেন ধীরস্থির কফি আনান দ্রুত হাঁটছেন, আর তাঁর নাগাল পাওয়ার আশায় পেছন পেছন ছুটছেন নিরাপত্তাকর্মীরা।

আপাত–ধীরস্থির কফি আনানের এমন দ্রুত হন্টন দেখে মজা পেতেন তাঁর সহকর্মীরা। সে সময়ে জাতিসংঘ সদর দপ্তরে কর্মরত বাংলাদেশি কূটনীতিক যাঁরা তাঁকে কাছ থেকে দেখেছেন, তাঁদের মুখেই শোনা গেল এমন গল্প। বরাবর শান্ত, ধীরস্থির কফি আনানের মুখের হাসি অনেকেরই পরিচিত। তবে সে হাসিটাও ছিল পরিমিত। কিন্তু মাঝেমধ্যেই তাঁর অট্টহাসি অনেককে চমকে দিত। খুব সাধারণ আর মজার ঘটনাতেও অট্টহাসিতে ফেটে পড়তেন কফি আনান। সহকর্মীদের ভাষায়, সারল্য ছিল ব্যক্তি কফি আনানের অন্যতম বৈশিষ্ট্য।

বাংলাদেশের ওপর কফি আনানের নজর ছিল বেশ আগে থেকেই। একাত্তরের মহান মুক্তিযুদ্ধ, স্বল্পোন্নত দেশ হিসেবে এগিয়ে চলা, জাতিসংঘের শান্তিরক্ষী বাহিনীতে অবদান—এসবই তাঁকে আগ্রহী করে তোলে বাংলাদেশের প্রতি। তাই তো ২০০১ সালের মার্চে ঢাকার সফর নিয়ে খানিকটা উন্মুখ ছিলেন তিনি। যুক্তরাষ্ট্রের নিউইয়র্কে জাতিসংঘের স্থায়ী মিশনে বাংলাদেশের তখনকার স্থায়ী প্রতিনিধি আনোয়ারুল করিম চৌধুরীর কাছে ওই সফরের আগ্রহের কথাও জানিয়েছিলেন তিনি। ঢাকায় পরিবেশ আর উন্নয়ন নিয়ে একটি বিশ্বজনীন বার্তা দেওয়ার ইচ্ছা ছিল তাঁর।

২০০১ সালে সফরে ঢাকায় এলে বিমানবন্দরে এক শিশু তৎকালীন জাতিসংঘ মহাসচিব কফি আনান ও তাঁর স্ত্রী ন্যানে আনানকে স্বাগত জানায়
২০০১ সালে সফরে ঢাকায় এলে বিমানবন্দরে এক শিশু তৎকালীন জাতিসংঘ মহাসচিব কফি আনান ও তাঁর স্ত্রী ন্যানে আনানকে স্বাগত জানায়

ঢাকায় কফি আনান

জাপানে বাংলাদেশের বর্তমান রাষ্ট্রদূত রাবাব ফাতিমা জানালেন, ২০০১ সালের ১৩ থেকে ১৫ মার্চ স্ত্রী ন্যানে ল্যাগারগ্রিনকে নিয়ে বাংলাদেশে আসেন কফি আনান। ঢাকায় পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে জাতিসংঘ অণু বিভাগে তখন পরিচালক হিসেবে কাজ করতেন রাবাব ফাতিমাঢাকায় এসে কফি আনান সাভারে যান জাতীয় স্মৃতিসৌধে একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধের শহীদদের প্রতি শ্রদ্ধা জানাতে। এরপর সাভারের রাজেন্দ্রপুরে শান্তিরক্ষী বাহিনীর প্রশিক্ষণ প্রতিষ্ঠান বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট ফর পিস সাপোর্ট অপারেশনস—বিপসটে যান। ঢাকায় ফিরে স্ত্রী ন্যানেকে নিয়ে ধানমন্ডির ৩২ নম্বরে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান স্মৃতি জাদুঘর পরিদর্শন করেন কফি আনান। এরপর তৎকালীন পররাষ্ট্রমন্ত্রী আবদুস সামাদ আজাদের সঙ্গে বৈঠক করেন। সৌজন্য সাক্ষাৎ করেন সে সময়ের রাষ্ট্রপতি বিচারপতি সাহাবুদ্দীন আহমদের সঙ্গে। পরে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ে গিয়ে টেকসই উন্নয়ন নিয়ে বক্তৃতা দেন।

পরিবেশ নিয়ে কফি আনানের সেটিই ছিল ২০০১ সালে প্রথম জনবক্তৃতা। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে সঙ্গে নিয়ে সেগুনবাগিচায় আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা ইনস্টিটিউটেরও উদ্বোধন করেন কফি আনান।

বাংলাদেশের প্রতি আগ্রহ, সমর্থন

শ্রীলঙ্কায় বাংলাদেশের হাইকমিশনার মো. রিয়াজ হামিদুল্লাহ নিউইয়র্কে দায়িত্ব পালন করেছেন। সেই সুবাদে সুযোগ হয়েছিল কফি আনানকে কাছ থেকে দেখার। তিনি জানলেন কফি আনানই প্রথম বাংলাদেশকে উন্নয়নের ‘রোল মডেল’ হিসেবে অভিহিত করেন।

জাতিসংঘে বাংলাদেশের যোগদানের রজতজয়ন্তী উদ্‌যাপিত হয়েছিল ১৯৯৯ সালের ১৭ সেপ্টেম্বর। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার উপস্থিতিতে ওই অনুষ্ঠানে কফি আনান জাতিসংঘের তখনকার মানবিক ও জরুরি সহায়তা-বিষয়ক আন্ডার সেক্রেটারি জেনারেল সার্জিও ভিয়েইরা ডি মেলোকে ডেকে আনেন। আমাদের মুক্তিযুদ্ধের সময় ডি মেলো জাতিসংঘের শরণার্থী সংস্থার পক্ষ থেকে বাংলাদেশের আনাচে-কানাচে ঘুরে কাজ করেছেন। কথা বলতে গিয়ে একাত্তরে ফিরে গিয়েছিলেন ডি মেলো। তাঁর মুখে যুদ্ধদিনের দুর্বিষহ দিনগুলোর বর্ণনা শুনছিলেন শেখ হাসিনা আর কফি আনান।

জাতিসংঘ মহাসচিব হওয়ার ঠিক আগেই শান্তিরক্ষা কার্যক্রমের প্রধান ছিলেন কফি আনান। উত্তাল এক সময়ে বিশ্বের সর্বোচ্চ সংস্থার দায়িত্ব নিতে হয়েছিল তাঁকে। বিশ্বে শান্তি প্রতিষ্ঠা আর জাতিসংঘের ভূমিকা পুনর্জাগরণে সচেষ্ট ছিলেন তিনি। কফি আনানের দায়িত্বের সময়ে প্রায় নিয়মিতভাবেই শান্তিরক্ষী মিশনে যোগ দেওয়া দেশের তালিকায় ওপরের দিকে থাকে বাংলাদেশ। তিনি সব সময় বাংলাদেশের শান্তিরক্ষীদের দক্ষতা, অবদান ও ত্যাগের কথা বলতেন।

বাংলাদেশের প্রতিটি উদ্যোগের প্রতি সমর্থন ছিল কফি আনানের। নিউইয়র্কে বাংলাদেশের সাবেক স্থায়ী প্রতিনিধি ও জাতিসংঘের সাবেক আন্ডার সেক্রেটারি আনোয়ারুল করিম চৌধুরী নারীর বিরুদ্ধে সহিংসতারোধ ও শান্তিপ্রক্রিয়ায় নারীর অংশগ্রহণ-সংক্রান্ত নিরাপত্তা পরিষদের ১৩২৫ নম্বর প্রস্তাবনা পাশের প্রসঙ্গ টানেন। মার্কিন বার্তা সংস্থা ইন্টার প্রেস সার্ভিসে (আইপিএস) কফি আনানের প্রতি শ্রদ্ধা জানাতে গিয়ে তিনি এ বিষয়টির অবতারণা করেছিলেন।

প্রস্তাবটি পাসের নেপথ্যে কী ঘটেছিল? তখন নিউইয়র্কে কর্মরত বাংলাদেশের কূটনীতিকেরা বলছেন, সেই প্রস্তাব অনুমোদনের বিরোধিতা করেছিল যুক্তরাজ্য ও কানাডা। নিরাপত্তা পরিষদের প্রায় প্রতিটি বৈঠকেই প্রস্তাবটির বিরোধিতা করত দেশ দুটি। অথচ এটিই ছিল জাতিসংঘের প্রথম জোরালো পদক্ষেপ—যেখানে সংঘাতময় অবস্থায় নারীকে যৌন সহিংসতাসহ সব ধরনের সহিংসতা থেকে মুক্ত রাখার উদ্যোগ নেওয়া হয়। শান্তি আলোচনায় এবং সংঘাত-পরবর্তী পুনর্গঠনের প্রক্রিয়ায় নারীকে যুক্ত করার বিধানও রয়েছে এই প্রস্তাবে। নিরাপত্তা পরিষদের সভাপতি হিসেবে তখন বাংলাদেশের প্রতিনিধিত্ব করছিলেন আনোয়ারুল করিম চৌধুরী। কফি আনান বাংলাদেশের উদ্যোগে প্রস্তাবটি পাস করার জন্য যা যা সহযোগিতা দরকার, তার সবই করেছেন। ২০০০ সালের অক্টোবর মাসে প্রস্তাবটি সর্বসম্মতভাবে পাস হয়।

দক্ষিণ আফ্রিকায় নেলসন ম্যান্ডেলার পঞ্চম বার্ষিক বক্তৃতায় ছিলেন কফি আনান, ২০০৭
দক্ষিণ আফ্রিকায় নেলসন ম্যান্ডেলার পঞ্চম বার্ষিক বক্তৃতায় ছিলেন কফি আনান, ২০০৭

সহজ-সরল জীবনযাপন

তাঁকে কাছে থেকে দেখা বাংলাদেশের কূটনীতিকদের মতে মৃদুভাষী কফি আনানের ব্যক্তিত্বে সারল্য আর কর্তৃত্ব দেখা যেত একই সঙ্গে। সহজ ও সাধারণ জীবনযাপন করতেন কফি আনান। ১৯৬২-তে বাজেট অফিসারের পদে যোগ দেওয়ার সময় ভাবেননি নিউইয়র্কে জাতিসংঘ সদর দপ্তরের ৩৮ তলায় বসবেন। সব সময় নিজের আফ্রিকার উৎস নিয়ে গর্ব করতেন। বলতেন, আমি সাদামাটা জীবন যাপনের পক্ষপাতী। কারণ এতে একজন মানুষ যেকোনো পরিবেশে নিজেকে মানিয়ে নিতে পারে।

এর দু-একটা উদাহরণও শোনা গেল কূটনীতিকদের মুখে। অবলীলায় জাতিসংঘের লিফটম্যান বা অফিস সহকারীদের সঙ্গে কফির টেবিলে বসে পড়তেন কফি আনান। তাঁদের সঙ্গে গল্পগুজব করতেন। আবার একটু পরেই হয়তো আন্ডার সেক্রেটারির মতো গুরুত্বপূর্ণ পদের মানুষের সঙ্গে আলাপে মেতে যেতেন। মজার ব্যাপার হলো অসংখ্য সহকর্মীর নাম মুখস্থ ছিল কফি আনানের। মানুষের মধ্যে ভেদাভেদ একেবারেই অপছন্দ ছিল কফি আনানের। ম‍্যানহাটনের বিখ‍্যাত কফি হাউসে হয়তো গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিদের সঙ্গে আলোচনা করছেন, তার মধ্যেই হঠাৎ দেখা গেল সেখানকার পরিচিত কোনো কর্মীর সঙ্গে কুশল বিনিময় করে তাঁর ভালো-মন্দ জানতে চাইলেন। এরপর সে আলোচনায় যুক্ত করেন অন‍্যদের।

বিশ্ব শান্তির দূত

১৯৯৭ সালে জাতিসংঘের মহাসচিবের চেয়ারে পাঁচ বছরের জন্য কফি আনান যখন বসতে যাচ্ছিলেন, তখন সময়টা ছিল খুব টালমাটাল। এক দশক ধরে চলা টালমাটাল সময় জাতিসংঘকে আবার গুরুত্বপূর্ণ করে তোলার চ্যালেঞ্জ নিয়ে যাত্রা শুরু হয়েছিল আনানের।

কফি আনানের স্মৃতিকথা ইন্টারভেনশনস: এ লাইফ ইন ওয়ার অ্যান্ড পিস নিয়ে ২০১২ সালে দ্য নিউইয়র্ক রিভিউ অব বুকস-এলেখেন কানাডার লেখক ও রাজনীতিবিদ মাইকেল ইগনাটিয়েফ। মাইকেলের ভাষায়, ব্যক্তিগত ক্যারিশমা ছিল তাঁর। বাড়তি বিষয় ছিল তাঁর কর্তৃত্ব। আর এটা এসেছিল অভিজ্ঞতা থেকে। খুব কম মানুষই জীবনের বড় একটা সময় ভয়ংকর খুনি, যুদ্ধবাজ সেনাপতি আর স্বৈরাচারীদের সঙ্গে আলোচনার টেবিলে বসতে পারেন। কফি আনান তা পেরেছেন। অন্ধকারে তিনি নিজেই নিজেকে বিশ্ব শান্তির দূত হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করেছিলেন।

তথ্যবিচিত্রা

কফি কিংবা আততা

  • ঘানার আকান ভাষায় ‘কফি’ শব্দের অর্থ শুক্রবার জন্মগ্রহণকারী ছেলেসন্তান। কফি আনানও শুক্রবারই জন্ম নিয়েছিলেন।
  • কফি আনানের পুরো নাম কফি আততা আনান। আততা শব্দের অর্থ যমজ। কফি আনানের একজন যমজ বোন ছিলেন। তাঁর নাম এফুয়া আততা। ১৯৯১ সালে তিনি মারা যান।
  • কফি আনান আকান, ফরাসি, ইংরেজিসহ আফ্রিকার কয়েকটি ভাষায় অনর্গল কথা বলতে পারতেন।
  • কর্মজীবনের প্রায় পুরো সময় কফি আনান জাতিসংঘে বিভিন্ন পদে দায়িত্ব পালন করেছেন।
  • জাতিসংঘে কর্মরত কোনো ব্যক্তি হিসেবে কফি আনানই প্রথম প্রতিষ্ঠানটির সর্বোচ্চ পদ মহাসচিবের দায়িত্ব পান।

সূত্র: সিএনএন ও ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেস