সাইকেল চালিয়ে খারদুংলা জয়

খারদুংলার পথে তাবাসসুম ও সহযাত্রী এরুইন। ছবি: সংগৃহীত
খারদুংলার পথে তাবাসসুম ও সহযাত্রী এরুইন। ছবি: সংগৃহীত

আঁকাবাঁকা রাস্তাটা পাহাড়ের গা বেয়ে আসমানের দিকে উঠে গেছে। শরীরের সমস্ত শক্তি দিয়ে সাইকেলের প্যাডেল ঘোরাতে হচ্ছে। তাতে কাজ হচ্ছে অল্পই। গতি মোটে চার-পাঁচ কিলোমিটার। সর্দি লেগে নাক-কান বন্ধ। মুখ হাঁ করে শ্বাস নিতে হচ্ছে। কাশির দমকে পিঠটা ধনুকের মতো বাঁকা হয়ে যাচ্ছে। জ্বরে গা পুড়ে যাচ্ছে। তবু থামেননি তিনি। ওপরের দিকে উঠছেন তো উঠছেনই। রাস্তাটার শেষ দেখতে চান তাবাসসুম। পুরো নাম জিনিয়া তাবাসসুম। খুলনার দৌলতপুরে বাড়ি, এখন থাকেন ঢাকার আজিমপুরে। এশিয়া প্যাসিফিক ইউনিভার্সিটিতে মাস্টার্সে পড়েন। খণ্ডকালীন একটা চাকরিও করেন। তবে নেশা ও শখের নাম সাইকেল চালানো।

যা-ই হোক, সেবার ঢাকা থেকে সাইকেল সঙ্গে করে দিল্লি অবধি উড়ে গিয়েছেন তাবাসসুম। সেখান থেকে বাসে করে মানালি। মানালি থেকে সাইকেল চালিয়ে ১৮ হাজার ৩৮০ ফুট ওপরে খারদুংলা পাসে যাবেন। পৃথিবীর উচ্চতম মোটরযান চলাচলের রাস্তা এটি। বাংলাদেশ থেকে আসা প্রথম নারী হিসেবে তাবাসসুম সাইকেল নিয়ে খারদুংলা পাস জয় করতে যাচ্ছেন। পাহাড়ের চড়াই-উতরাই বাইতে বুকভরা সাহস আর ভি-ব্রেকের মামুলি একটা সাইকেল সঙ্গে করে এনেছেন।

এই অভিযানে সঙ্গী হেদায়েতুল হাসান ফিলিপ আর সুইস নাগরিক এরুইন।  তাবাসসুম বললেন, ‘ফিলিপ ঢাকা থেকে একসঙ্গেই গেছেন। কিন্তু এরুইনের সঙ্গে পথে পরিচয়। ৬৫ বছরের বৃদ্ধ। তুখোড় সাইকেলচালক।  একা ছিলেন। খুব অনুনয়-বিনয় করছিলেন যেন তাঁকে সঙ্গে নিই। তাঁর অনুরোধ রাখলাম আমরা।’

প্রায় সাড়ে ৬ হাজার ফুট ওপরে মানালি ছোট্ট এক পাহাড়ি শহর। অবকাশ যাপন, প্যারাগ্লাইডিং, রাফটিংয়ের জন্য বিখ্যাত। গত ১০ আগস্ট সেই মানালি থেকে সাইকেল চালানো শুরু করল তিনজনের দলটা। শহরটা সবুজে ছাওয়া।

‘যতই ওপরের দিকে উঠতে লাগলাম, ততই পথের আশপাশের পরিবেশ রুক্ষ হতে শুরু করল’, বলে চললেন তাবাসসুম। তাঁর ভাষায়, মানালি থেকে এক-দেড় শ কিলোমিটার পর সবুজ উধাও। দুই দিকে পাহাড়ের সারি। ছোট-বড় পাথরে ভরা ঊষর ভূমি। নিথর সেই পাথররাজ্যেরও আলাদা একটা সৌন্দর্য আছে। সব যেন ছবির মতো।

মানালির পর প্রথম পাসে আসতেই হঠাৎ মেঘ আর ঠান্ডা এসে হানা দিল। সঙ্গে বৃষ্টিও ছিল। সেটাই কাল হলো তাবাসসুমের জন্য। সর্দি-জ্বর বেধে গেল। ‘হাঁচি-কাশি-জ্বর এসব নিয়েই সাইকেল চালাচ্ছে মেয়েটা। পেছন থেকে কাশির শব্দ হলে নিশ্চিত হই, ও আছে, ’ বলছিলেন তাবাসসুমের সহযাত্রী হেদায়েতুল হাসান।

কেলং এসে সরকারি হাসপাতালে গেলে ডাক্তার অ্যান্টিবায়োটিক দিলেন তাবাসসুমকে। তিন দিন পর আবার জ্বর। পাংয়ে গিয়ে আবার ডাক্তারের কাছে যান। উচ্চতাজনিত সমস্যাগুলো আরও দুর্বল করে তুলছিল। দুই দিন নাক দিয়ে হালকা রক্ত ঝরেছিল। সেটা অবশ্য অক্সিজেনস্বল্পতার কারণে। টানা ১০ দিন ৪৫০ কিলোমিটার সাইকেল চালিয়ে লে-তে এসে পৌঁছালেন তাঁরা। সেখান থেকে খারদুংলা পাস মাত্র ৩৮ কিলোমিটারের পথ। কিন্তু সেখানে যেতে বিশেষ অনুমতি লাগে। সেই অনুমতি নিতে একটা দিন চলে গেল। ২২ আগস্ট ভোরে খারদুংলা অভিমুখে রওনা দিলেন তাবাসসুম ও তাঁর দুই সঙ্গী। বেলা সাড়ে তিনটার দিকে সামিট করে সন্ধ্যার মধ্যেই ফিরে এলেন। তারপর লে থেকে বিমানে দিল্লি-কলকাতা হয়ে ঢাকা।

থাকা-খাওয়া নিয়ে খুব একটা ভাবতে হয়নি। দিনে গরমের মধ্যে সাইকেল চালিয়ে রাতে ঠান্ডায় জবুথবু হয়ে ভাড়া করা তাঁবুতে ঘুমাতে যেতেন। খাবারদাবার বলতে ভাত-ডাল-সবজি-সবই পাওয়া যেত।

বিদেশে পাহাড়ি রাস্তায় সাইকেল চালাতে ভয় করেনি-এমন প্রশ্নে স্মিত হেসে তাবাসসুম বললেন, দেশে এর আগে তিনি টেকনাফ থেকে তেঁতুলিয়া সাইকেল চালিয়েছেন। ১১ দিনে ১ হাজার ১০০ কিলোমিটার পথ পাড়ি দিয়েছেন। সেবার আরেকটি মেয়ে তাঁর সঙ্গী ছিলেন। সাইকেল নিয়ে তিনি পার্বত্য এলাকা চষে বেড়িয়েছেন। আরও তিনটি ক্রস কান্ট্রির রেকর্ড আছে ঝুলিতে।

নিজের ইচ্ছাশক্তি ও মায়ের উৎসাহে এত দূর আসতে পেরেছেন তাবাসসুম। তিনি বলেন, ইচ্ছা থাকলে অসাধ্য সাধন করা যায়।