কম্পিউটার বিজ্ঞানের ধারণা কেন জরুরি?

বিল গেটস
বিল গেটস

মাইক্রোসফটের সহপ্রতিষ্ঠাতা—এই পরিচয় এখন আর বিল গেটসের জন্য যথেষ্ট নয়। বিল অ্যান্ড মেলিন্ডা গেটস ফাউন্ডেশনের মাধ্যমে নানা ধরনের সমাজসেবামূলক কার্যক্রমের সঙ্গে যুক্ত বিশ্বের অন্যতম শীর্ষ ধনী এই মানুষ। আরও সুন্দর একটি পৃথিবী গড়ার চেষ্টায় তাঁর ভাবনা সব সময় তরুণদের অনুপ্রাণিত করে। ৫ সেপ্টেম্বর বিল গেটস তাঁর অফিশিয়াল ব্লগে একটি স্কুল ভ্রমণের অভিজ্ঞতা লিখেছেন। বলেছেন কীভাবে কম্পিউটার বিজ্ঞান মানুষের জীবন বদলে দিতে পারে।

আমি যখন প্রোগ্রামিংয়ের প্রেমে পড়ি, তখন আমার বয়স ১৩। দেশের যে অল্প কয়েকটা স্কুলে শুরুর দিকে ‘কম্পিউটার টার্মিনাল’ চালু হয়েছিল, তার মধ্যে আমার স্কুল অন্যতম। বিশাল বড় একটা যন্ত্র। খুবই ধীরগতির। এমনকি সেই যন্ত্রের কোনো পর্দাও (স্ক্রিন) ছিল না। তবু আমি ওটার ওপর থেকে চোখ সরাতে পারতাম না। নতুন প্রোগ্রাম তৈরি করার পেছনে আমি আর আমার বন্ধুরা ঘণ্টার পর ঘণ্টা সময় ব্যয় করেছি।

কম্পিউটার বিজ্ঞানের সঙ্গে পরিচিত হওয়ার পর আমার জীবনের গতিপথটাই বদলে গিয়েছিল। সম্প্রতি নিউইয়র্কের একটা স্কুলে গিয়েছি। এই স্কুলও একই রকমভাবে তাদের ছাত্রছাত্রীদের জীবন বদলে দেওয়ার স্বপ্ন দেখে।

দ্য একাডেমি অব সফটওয়্যার ইঞ্জিনিয়ারিং—সংক্ষেপে এএফএসই। ম্যানহাটনে অবস্থিত একটা পাবলিক স্কুল। ২০১২ সালে চালু হওয়ার পর থেকে স্কুলটা তাদের পাঠ্যক্রম দারুণভাবে সাজিয়েছে। এখানে কম্পিউটার বিজ্ঞানের নানা ধারণার মধ্য দিয়ে ছাত্রছাত্রীদের কলেজের জন্য প্রস্তুত করা হয়। প্রথম দুই বছরে শিক্ষার্থীরা কম্পিউটার বিজ্ঞানের মৌলিক ধারণাগুলো পেয়ে যায়। একটু বড় হওয়ার পর তারা প্রোগ্রামিং অথবা ডিজাইন, দুটোর যেকোনো একটি বেছে নেওয়ার সুযোগ পায়। এএফএসই থেকে যত শিক্ষার্থী বেরোয়, সবাই যে প্রোগ্রামার বা সফটওয়্যার প্রকৌশলী হবে, তা নয়। অতএব অন্যান্য বিষয় যেমন ইংরেজি, সমাজবিদ্যার মতো বিষয়গুলোও তাদের পড়তে হয়।

কিছু কিছু বিশেষ বিষয় ছাড়া এই স্কুলে ভর্তি হওয়ার কোনো মানদণ্ড নেই। লটারি পদ্ধতির মাধ্যমে নিউইয়র্ক শহরের ছেলেমেয়েরা পাবলিক স্কুলে পড়ার সুযোগ পায়। যেকোনো ছাত্রছাত্রী এএফএসইতে পড়ার জন্য আবেদন করতে পারে। আগের স্কুলে তাদের ফলাফল কিংবা উপস্থিতির হার ভর্তিপ্রক্রিয়ার মধ্যে কোনো প্রভাব ফেলে না। অতএব ছাত্রছাত্রীদের মধ্যে বেশ বৈচিত্র্য থাকে। যদিও তারা মেয়েদের আবেদন করার ব্যাপারে উৎসাহ দেয়।

একটু বড় ক্লাসের শিক্ষার্থীদের সঙ্গে একটা ডিজাইন ক্লাসে বসার সৌভাগ্য আমার হয়েছিল। শিক্ষক প্রথমেই তাঁর ছাত্রছাত্রীদের ছোট ছোট দলে ভাগ করলেন। তারপর এমন একটা বস্তু বানাতে বললেন, যেখানে হেডফোন রাখা যাবে। কর্মক্ষমতা, স্থায়িত্ব ও সহজ ব্যবহারযোগ্যতার কথা মাথায় রেখে মডেলিং সফটওয়্যার ও থ্রিডি প্রিন্টার ব্যবহার করে ছাত্রছাত্রীরা এই কাজ করল।

দেখলাম, প্রতিটি দলই কাজের জন্য ভিন্ন ভিন্ন পন্থা অবলম্বন করল। এক দল তৈরি করল একটা ধরুনি, যেটা টেবিলের কোনায় লাগানো থাকবে। ওটার সঙ্গে হেডফোনটা ঝুলিয়ে রাখা যাবে। আরেক দল তৈরি করল একটা স্ট্যান্ড, যেন ডেস্কের ওপরেই হেডফোন রাখা যায়। প্রতিটি নকশা দেখে আমি অভিভূত হয়ে গেলাম।

স্কুলের বিশেষায়িত পাঠ্যক্রম এমনভাবে সাজানো হয়েছে, যেন যেসব ছেলেমেয়ে মিডল স্কুলে দুর্বল ছিল, তাদের জন্য ক্লাসগুলো খুব উপকারী হবে। যেসব ছাত্রছাত্রী ভালো ইংরেজি জানে না বা যাদের কোনো না কোনো প্রতিবন্ধকতা আছে, তারাও নিশ্চয়ই এএফএসইতে খুব দ্রুত উন্নতি করতে পারবে। কারণ, কম্পিউটার বিজ্ঞানে ভাষার দক্ষতার চাইতে সংখ্যার গুরুত্ব বেশি। কম্পিউটার বিজ্ঞানের ধারণার ওপর নির্ভর করেই এখানে অন্য বিষয়গুলো পড়ানো হয়। যেমন একজন ইতিহাসের শিক্ষক হয়তো বলবেন না, তুমি ১৮১২ সালের যুদ্ধ সম্পর্কে একটা মৌখিক প্রেজেন্টেশন দাও। বরং বলবেন, তুমি এই যুদ্ধ নিয়ে একটা ওয়েব পেজ বানাও।

স্কুলে ছেলেমেয়েদের সংখ্যা পাঁচ শর কম। ক্লাসগুলো খুব বড় নয়। অতএব প্রত্যেক ছাত্রছাত্রীই শিক্ষকদের কাছ থেকে বিশেষ মনোযোগ পায়। প্রত্যেকের জন্যই আলাদা করে গ্র্যাজুয়েশন পরিকল্পনা তৈরি করা হয়। একজন ছাত্রের কতটুকু উন্নতি হলো, একটি তথ্য বাতায়নে সব সময় তা তুলে রাখা হয়। লগ ইন করে যেকোনো শিক্ষক ছাত্রের অবস্থা দেখে নিতে পারেন। ছাত্র যখন বড় হয়, তথ্য বাতায়ন দেখেই শিক্ষকেরা বুঝতে পারেন কোথায় কোথায় তার দুর্বলতা আছে। সেই অনুযায়ী দুর্বলতাগুলো কাটানোর ব্যবস্থা করা হয়। এই তথ্য বাতায়ন শুধু এএফএসইতে নয়, পুরো নিউইয়র্কের পাবলিক স্কুলগুলোর মধ্যেই চালু আছে। ‘নিউ ভিশন ফর পাবলিক স্কুলস’ নামে একটা নেটওয়ার্কের মাধ্যমে যেকোনো ছাত্রের অগ্রগতি সম্পর্কে জানা যায়। আমাদের ফাউন্ডেশন সম্প্রতি এই তথ্য বাতায়নকে আরও সম্প্রসারিত করার উদ্যোগ হাতে নিয়েছে। আমরা নিউ ভিশনের অগ্রগতির জন্য আর্থিক সহায়তা দেব।

নবীন শিক্ষার্থী হিসেবে প্রত্যেক শিক্ষার্থীর জন্য একজন করে উপদেষ্টা নিয়োগ করা হয়। তিনি শিক্ষার্থীর হাইস্কুল কিংবা পরবর্তী শিক্ষাক্রমের পরিকল্পনা সাজিয়ে দেন। মা-বাবার সঙ্গে যোগাযোগের ক্ষেত্রে উপদেষ্টারা মাধ্যম হিসেবে কাজ করেন। স্কুলও উপদেষ্টার মাধ্যমে শিক্ষার্থী সম্পর্কে জানতে পারে। কেউ ঝরে পড়ছে কি না, সে ব্যাপারে লক্ষ রাখার জন্য এই পদ্ধতি খুবই কার্যকর। প্রত্যেকেই আলাদা যত্ন পায়, যেটা এই বয়সে তাদের পাওয়া উচিত।

আমার মনে হয়, কম্পিউটার বিজ্ঞানের মৌলিক ধারণা থেকে সব মানুষই লাভবান হতে পারে। কম্পিউটার বিজ্ঞান আমাকে প্রশ্ন করতে শেখায় কীভাবে আমি একটা কাজ সমাধা করতে পারি। এই কাজের জন্য আমার কী কী তথ্য দরকার। এই শিক্ষা জীবনের সব ক্ষেত্রে কাজে লাগে। পৃথিবীটাকে আমি কীভাবে দেখব, এই প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে আমাকে সাহায্য করেছিল কম্পিউটার বিজ্ঞান। আমি আশা করি, একাডেমি অব সফটওয়্যার ইঞ্জিনিয়ারিংয়ের ছেলেমেয়েরাও একইভাবে উপকৃত হবে।

সূত্র: গেটস নোটস

ইংরেজি থেকে অনুবাদ মো. সাইফুল্লাহ