গিনেসে আশরাফুলের ফুটবল কসরত

>ফুটবল নিয়েই কাটে তাঁর দিন। ফুটবল নিয়েই দেখান বিস্ময়কর সব কসরত। আশরাফুল ইসলামের সেসব কসরতে বিমোহিত হন দর্শক। এই ফুটবল কসরত দেখিয়েই গড়েছিলেন গিনেস ওয়ার্ল্ড রেকর্ডস। স্বীকৃতি সনদ হাতে পেলেন ৯ সেপ্টেম্বর। যদিও ইতিমধ্যে আরেকজন আশরাফুলের রেকর্ডটি ভেঙে ফেলেছেন। তবে আশরাফুল থেমে থাকার ছেলে নন, ফুটবল কসরতে তাঁর স্বপ্নের ডানা তিনি মেলেই চলেছেন।
গিনেস ওয়ার্ল্ড রেকর্ডসের সনদ হাতে আশরাফুল ইসলাম। ছবি: সংগৃহীত
গিনেস ওয়ার্ল্ড রেকর্ডসের সনদ হাতে আশরাফুল ইসলাম। ছবি: সংগৃহীত

সাদা দেয়ালে স্প্রে করে ইংরেজিতে লেখা ‘কিং’। তারই গা ঘেঁষে গাঢ় কালো রঙে লেখা ‘আই অ্যাম ফ্রিস্টাইলার’। আশরাফুল ইসলাম সম্পর্কে যাঁরা জানেন, তাঁরা খোঁজেন এর অর্থ—আশরাফুল কি তবে ফ্রিস্টাইলারদের রাজা হতে যাচ্ছেন! ভিডিওতে দেয়ালের এই লেখাগুলো দেখে আশরাফুলকে প৶শ্নটা করেছিলাম। হাসতে হাসতে বললেন, ‘ব্যাপারটা কাকতালীয়। ভেবে করিনি। কিং লেখাটা আগে থেকেই ছিল, পরে ওই বাক্যটা লিখেছি’।

ফুটবল পুরোই বশ মেনেছে আশরাফুলের কাছে
ফুটবল পুরোই বশ মেনেছে আশরাফুলের কাছে

এই সাদা দেয়ালটা চট্টগ্রামের বহদ্দারহাট চাঁদগাঁও আবাসিক এলাকায় আশরাফুলদের বাড়ির ছাদের এক কোণে। ছাদের দেয়াল ঘেঁষেই প্রমাণ আকারের মাদুর বিছানো। এই ছোট মাদুরটিই আশরাফুলের অনুশীলন মাঠ। ফুটবল নিয়ে রোজ দু-তিন ঘণ্টা ঘাম ঝরান তিনি।

মাদুরে ফুটবল অনুশীলন, চোখ কপালে উঠল বুঝি! আশরাফুল পেশাদার ফুটবলার নন, তিনি ফুটবল ফ্রিস্টাইলার। চট্টগ্রাম ক্যান্টনমেন্ট পাবলিক কলেজ থেকে এ বছরই উচ্চমাধ্যমিক পাস করেছেন। এখন বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির প্রস্তুতি নিচ্ছেন। এই বয়সেই আপন মনে ফুটবলের নানা কসরত রপ্ত করেছেন তিনি। পেয়েছেন বিশ্ব রেকর্ডের স্বীকৃতি।

ফুটবল পুরোই বশ মেনেছে আশরাফুলের কাছে
ফুটবল পুরোই বশ মেনেছে আশরাফুলের কাছে

ফ্রিস্টাইলাররা মাথা, কাঁধসহ শরীরের বিভিন্ন অঙ্গের মাধ্যমে ফুটবলকে বশ করেন; কখনো বসে, কখনো আধশোয়া হয়েও পায়ের সাহায্যে ফুটবল দিয়ে বিভিন্ন কলাকৌশল প্রদর্শন করেন। মোহগ্রস্ত করেন দর্শকদের। ফুটবল ফ্রিস্টাইলার হিসেবে অনেক বিখ্যাত ফুটবলারের নাম চলে আসে। ব্রাজিলের তারকা ফুটবলার রোনালদিনহো ও নেইমার, আর্জেন্টিনার লিওনেল মেসি, পর্তুগালের ক্রিস্টিয়ানো রোনালদোর মতো তারকা ফুটবলাররাও পেশাদার খেলার বাইরে ফুটবল নিয়ে নানা কসরত করেন, সেসব আমরা ইউটিউবে বিভিন্ন ভিডিওতে দেখি। এই বিশেষ প্রতিভা কঠোর অনুশীলনেই অর্জন করা যায়। কঠিন তপস্যারও বিষয়। সেই কঠিনেরেই ভালোবেসেছেন আশরাফুল ইসলাম।

ফুটবল পুরোই বশ মেনেছে আশরাফুলের কাছে
ফুটবল পুরোই বশ মেনেছে আশরাফুলের কাছে

 স্বপ্ন দেখালেন সৈয়দ মুক্তাসিদ

ফুটবল কসরতে আশরাফুল আদর্শ মানেন ব্রিটিশ ফুটবল ফ্রিস্টাইলার টম ফলানকে। তবে আরও একজন আছেন তাঁর আদর্শের তালিকায়; তিনি সৈয়দ মুক্তাসিদ। আশরাফুলের ভাষায়, ‘বড় ভাই’। বাংলাদেশি বংশোদ্ভূত দক্ষিণ আফ্রিকার নাগরিক মুক্তাসিদ সে দেশে একজন ফুটবল ফ্রিস্টাইলার। ২০১৫ সালে এসেছিলেন চট্টগ্রামে। আশরাফুলের নৈপুণ্য দেখে তিনি নাকি মুগ্ধ। মুঠোফোনে আশরাফুল বলছিলেন, ‘তখনো জানতাম না, বাংলাদেশ থেকেও ফুটবলের কারিকুরি দেখিয়ে বিশ্বসেরা হওয়া সম্ভব। মুক্তাসিদ ভাই আমাকে অনুপ্রাণিত করলেন। পরামর্শ দিলেন।’

ফুটবল পায়ে আশরাফুল সবসময় মেতে ওঠেন কসরতে
ফুটবল পায়ে আশরাফুল সবসময় মেতে ওঠেন কসরতে

তারপর শুরু হলো কঠিন পরিশ্রম। ইউটিউব ঘেঁটে দেখলেন বিশ্বসেরাদের কসরত। পরিচিত হতে থাকলেন ভার্চ্যুয়াল মাধ্যমে। জানলেন ফুটবল কারিকুরির নানা আয়োজন আর প্রতিযোগিতার কথাও। স্বপ্ন ডালপালা মেলতে থাকল। একসময় বন্ধু-আত্মীয়-পরিজনকে যে মুগ্ধ করতেন, তা-ই তিনি ছড়াতে থাকলেন ফেসবুকে-ইউটিউবে। জুটল বাহবা। দিনে দিনে জানলেন বিশ্ব রেকর্ড করার মতো বিভিন্ন প্রতিযোগিতার কথা। একসময় ভাবলেন, তিনি নিজেই গড়তে পারেন বিশ্ব রেকর্ড। নামও লেখালেন রেকর্ডের খাতায়।

ফুটবলের কসরত দেখিয়ে দর্শকদের মোহগ্রস্ত করে রাখেন আশরাফুল ইসলাম। ছবি: সংগৃহীত
ফুটবলের কসরত দেখিয়ে দর্শকদের মোহগ্রস্ত করে রাখেন আশরাফুল ইসলাম। ছবি: সংগৃহীত

 ভাঙা-গড়ার রেকর্ড

গিনেস ওয়ার্ল্ড রেকর্ডস অনলাইনে ফুটবল কসরতের এই বিভাগের নাম ‘মোস্ট সাইড হেড স্টাল বল কন্ট্রোল ট্রিকস ইন ওয়ান মিনিট’। অর্থাৎ এক মিনিটে মাথার এপাশ থেকে ওপাশে কতবার ফুটবল নিতে পারবে তারই হিসাব করা হয়। দৃষ্টিনন্দন কাজটি ১০১ বার করে রেকর্ডের মালিক ছিলেন ভারতের আর্কিস প্যাটেল। আশরাফুল বলছিলেন, ‘এমন ট্রিক (কসরত) আমি ছোটবেলা থেকেই করি। দৃঢ়বিশ্বাস ছিল, আমি আর্কিস প্যাটেলের চেয়ে বেশিবার এমনটি করতে পারব। করলামও।’

মা–বাবা ও ছোট বোনের সঙ্গে আশরাফুল ইসলাম
মা–বাবা ও ছোট বোনের সঙ্গে আশরাফুল ইসলাম

কিন্তু সে কথা জানল না কেউ। বিচিত্র বিষয়ে রেকর্ড সংরক্ষণ করার আন্তর্জাতিক প্রতিষ্ঠান গিনেস ওয়ার্ল্ড রেকর্ডসকে যখন আশরাফুল নিজের কৃতিত্বের কথা জানাল, তারা যথাযথ প্রমাণ চাইল। প্রমাণ দিলেন আশরাফুল। কিন্তু যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক প্রতিষ্ঠানটি যেভাবে বিচার করে বিশ্বসেরা নির্ধারণ করে, ঠিক সেভাবে প্রমাণ দিতে পারেননি আশরাফুল। আবার চেষ্টা করলেন।

ফুটবল পায়ে আশরাফুল সবসময় মেতে ওঠেন কসরতে
ফুটবল পায়ে আশরাফুল সবসময় মেতে ওঠেন কসরতে

এবার প্রমাণ পাঠালেন নিয়মনীতি মেনেই। কিছুদিন পর আনুষ্ঠানিক ই-মেইল পেলেন তিনি—জানানো হলো, ১ মিনিটে ১০৪ বার কসরত দেখিয়ে আর্কিস প্যাটেলের রেকর্ড ভেঙেছেন আশরাফুল। এটা এ বছরেরই মে মাসের কথা। কিন্তু মাস গড়াতেই ১০৫ বার কসরত দেখিয়ে তা আবার দখলে নিলেন আরেক ভারতীয় তরুণ সতীশ কে। এ যেন রীতিমতো ভাঙা-গড়ার মহোৎসব ভাঙলেন, গড়লেন, হারালেন!

ফুটবল পায়ে আশরাফুল সবসময় মেতে ওঠেন কসরতে
ফুটবল পায়ে আশরাফুল সবসময় মেতে ওঠেন কসরতে

প্রথম প্রচেষ্টাই যখন বিশ্ব রেকর্ডের খাতায় নাম লেখাতে পেরেছেন, তাতেই আনন্দিত আশরাফুল। তিনি বলছিলেন, ‘আমি মনের আনন্দে ফ্রিস্টাইল চর্চা করি। রেকর্ডের জন্য নয়। আনন্দ থাকলে নিশ্চয় কোনো একদিন আরও কঠিন কোনো বিভাগে বিশ্বসেরার রেকর্ড গড়তে পারব।’

সেই প্রত্যাশা নিয়েই স্বপ্ন দেখছেন ফ্রিস্টাইল চ্যাম্পিয়নশিপের বিশ্ব আসরে নাম লেখাতে, বাংলাদেশকে প্রতিনিধিত্ব করতে। আশরাফুলের সে স্বপ্ন যে ধরাছোঁয়ার বাইরে নয়, তা তাঁর ধ্যানজ্ঞান আর চর্চাই জানান দেয়। অনুশীলনে আসে অর্জন—আশরাফুল ইসলাম তো সেই অনুশীলনেই অবিচল।