মনের অসুখ ছোট নয়: দীপিকা

ভারতীয় অভিনেত্রী দীপিকা পাড়ুকোন। বহু পুরস্কার পেয়েছেন। টাইম সাময়িকী তাঁকে এ বছর বিশ্বের সবচেয়ে প্রভাবশালী ১০০ ব্যক্তিত্বের তালিকায় রেখেছে। একসময় ব্যাডমিন্টন খেলোয়াড় ছিলেন বলেই হয়তো জীবনের সাফল্য-ব্যর্থতাকে দীপিকা খেলোয়াড়সুলভ মানসিকতা দিয়ে সামলে নিতে জানেন। মানসিক সমস্যাবিষয়ক সচেতনতা গড়তে একটা সংস্থা চালু করেছেন দীপিকা—দ্য লিভ লাভ লাফ ফাউন্ডেশন। গত ২১ ফেব্রুয়ারি ভারতের হায়দরাবাদে অনুষ্ঠিত একটি তথ্য প্রযুক্তি সম্মেলনে তিনি হতাশাকে মোকাবিলা করার গুরুত্বের কথা বলেছেন।
দীপিকা পাড়ুকোন
দীপিকা পাড়ুকোন


হতাশা একটা খুব গুরুত্বপূর্ণ সমস্যা, যেটা মহামারি আকার ধারণ করছে। আমি খুব ছোট একটা সংস্থা চালাই। আমার এখানে চার-পাঁচজন কর্মী আছেন। কিন্তু আমার ছোট্ট প্রতিষ্ঠানেই আমি একটা নিয়ম বাধ্যতামূলক করেছি। বলে দিয়েছি, যেকোনো মানসিক জটিলতায় তোমাকে একজন কাউন্সেলর বা মনোরোগ বিশেষজ্ঞের কাছে যেতেই হবে।

ক্ষমতায় থাকা মানুষগুলোর বোঝা উচিত, মনের অসুখকে ছোট করে দেখার কোনো সুযোগ নেই। আমাদের সমাজে কেউ যদি বসের কাছে গিয়ে বলে, আমার মন ভালো না, আমি কয়েকটা দিন ছুটি চাই; সে নিশ্চয়ই চাকরি হারাবে। কিন্তু এসব ক্ষেত্রে দরকার সমানুভূতি। একটা প্রতিষ্ঠান তখনই সফল হয়, যখন কর্মীরা তাঁদের শতভাগ দিয়ে কাজ করেন। কর্মীরা প্রতিদিনই আসছেন, ঘড়ি ধরে অফিস করছেন, কিন্তু তাঁদের মন অন্য কোথাও, এভাবে কাজ করার কোনো মানে হয় না।

আমারও খুব খারাপ সময় গেছে। শারীরিক ও মানসিকভাবে ভীষণ ভেঙে পড়েছিলাম, এর মধ্যেই প্রতিদিন কাজ চালিয়ে গেছি। কিন্তু আমার ক্ষেত্রে অন্তত এমন হয়নি যে বস বলে দিলেন, ‘তোমাকে চাকরিচ্যুত করলাম, কারণ তুমি হতাশাগ্রস্ত।’ এ রকম কিছু হলে আমি কীভাবে সামলে নিতাম, জানি না। সে জন্যই বলছিলাম, প্রতিষ্ঠানগুলোর দিক থেকে সহানুভূতি ও সমানুভূতি প্রয়োজন।

প্রতিটি প্রতিষ্ঠানে একজন মনোরোগ বিশেষজ্ঞ দরকার। সবাই হয়তো মন খুলে কথা বলতে চাইবে না। অনুভূতিটা নিজের মধ্যে রাখতে চাইবে। কিন্তু অন্তত এই সেবাটা নেওয়ার একটা সুযোগ তো আমরা রাখতে পারি।

শুধু ওষুধ কিন্তু হতাশার চিকিৎসা নয়। ভালো থাকতে হলে আপনার পুরো লাইফস্টাইলেই পরিবর্তন আনতে হবে। ঠিকমতো ঘুম হচ্ছে কি না, আমি ঠিকমতো খাচ্ছি কি না, কাজের ফাঁকে ঠিকঠাক বিরতি নিচ্ছি কি না—এ সবই গুরুত্বপূর্ণ। আমার সংগঠনের নাম দ্য লিভ লাভ লাফ ফাউন্ডেশন হওয়ার পেছনে এটাও অন্যতম কারণ, হতাশার বাইরের দুনিয়াটা আমরা মানুষকে দেখাতে চাই।

হায়দরাবাদে অনুষ্ঠিত তথ্য প্রযুক্তি সম্মেলনে দীপিকা
হায়দরাবাদে অনুষ্ঠিত তথ্য প্রযুক্তি সম্মেলনে দীপিকা

হতাশা মানুষকে খুব ধীরে ধীরে পেয়ে বসে। এমন নয় যে হুট করে আমি হতাশ হয়ে পড়লাম। আপনি যদি হতাশায় আক্রান্ত হন, হঠাৎ মনে হবে আপনার কাঁধের ওপর কেউ খুব ভারী একটা কিছু চাপিয়ে দিয়েছে। মাথার ভেতরটা ধোঁয়াটে হয়ে যাবে। সোজাসুজি ভাবতে পারবেন না। সবকিছুই অসহ্য মনে হবে। কোনো কাজেই অনুপ্রেরণা পাবেন না। এবং স্পষ্ট বুঝতে পারবেন, আপনি আপনার মধ্যে নেই। আমি জানি আমি কে, আপনি জানেন আপনি কে। কিন্তু হতাশাগ্রস্ত হলে আপনি আর ‘আপনি’ থাকবেন না। একইভাবে যখন হতাশা কেটে যাবে, সেটাও আপনি স্পষ্ট অনুভব করতে পারবেন। অনেক সময় বিমানে চড়লে যেমনটা হয়। ধরুন আপনাকে নিয়ে বিমানটা মেঘের ভেতর দিয়েই যাচ্ছে, হঠাৎ মেঘ সরে গেল, আর আপনি সূর্যটা দেখতে পেলেন, হতাশা কেটে যাওয়ার অনুভূতি অনেকটা তেমন।

মজার ব্যাপার হলো, আমি জীবনের এমন একটা সময় পার করছি, যখন ব্যর্থতাকে আমি আর ভয় পাই না। আমি কেমন বোধ করছি, সেটাও আমি অকপটে বলতে পারি। মানুষ যখন জিজ্ঞেস করে, কেমন আছ? মিথ্যা বলি না। এ ক্ষেত্রে আমি সৎ থাকি। হয়তো বলি, ‘হ্যা, আমরা দিনটা আসলে খুব ভালো যাচ্ছে না।’ আমার মনে হয়, অন্য কারও কাছে নিজের অনুভূতি প্রকাশ করার আগে নিজের কাছে নিজের অনুভূতিটা স্বীকার করে নেওয়া খুব গুরুত্বপূর্ণ। আমি আজ যা, সাফল্য-ব্যর্থতা তার অংশ। চলচ্চিত্রের দুনিয়ায় আমার অভিষেকটা ছিল অসাধারণ। এর চেয়ে ভালো হয়তো আর হয় না। কিন্তু পরে অনেকেই লেখালেখি করেছেন যে আমি অভিনয়টা ঠিকঠাক পারি না। কিন্তু এসব অভিজ্ঞতাই তো আমাকে আমি বানিয়েছে। ব্যক্তিগতভাবে আমি সমালোচনা খুব ভালোভাবে গ্রহণ করি। হয়তো আমার ভেতরেই খেলোয়াড় সত্তাটাই আমাকে সমালোচনা গ্রহণ করতে সাহায্য করে। সমালোচনা আমার কাছে ‘স্প্রিং’য়ের মতো। পড়ে গেলেও স্প্রিংয়ের ধাক্কায় আমি আগের চেয়েও বেশি উচ্চতায় পৌঁছে যাই।

আমরা সবাই জীবনের কোনো না কোনো পর্যায়ে হেরে যাই। আমি বিষয়টাকে এভাবে দেখি, পরাজয়ের এই শিক্ষাটা আমি পরবর্তী সময়ে কীভাবে কাজে লাগালাম? প্রতিটি অভিজ্ঞতাই আমাকে কিছু না কিছু শেখায়। ওই শিক্ষা কাজে লাগিয়ে আপনি কীভাবে সামনে এগোলেন, সেটাই বড় কথা।

ইংরেজি থেকে অনুবাদ: মো. সাইফুল্লাহ
সূত্র: ওয়ার্ল্ড আইটি কংগ্রেস অনুষ্ঠানের ভিডিও