ভুল স্বীকার করা সহজ নয়

>

শেরিল স্যান্ডবার্গ
শেরিল স্যান্ডবার্গ

ফেসবুকের প্রধান পরিচলন কর্মকর্তা শেরিল স্যান্ডবার্গ। ২০১২ সালে টাইম সাময়িকী তাঁকে বিশ্বের ১০০ প্রভাবশালী ব্যক্তির একজন হিসেবে স্বীকৃতি দিয়েছে। নানা সমালোচনায় ফেসবুক এখন কঠিন সময় পার করছে। এই কঠিন সময় থেকে কী শিখেছেন, সে কথাই শেরিল স্যান্ডবার্গ বলেছেন গত ৮ জুন, যুক্তরাষ্ট্রের ম্যাসাচুসেটস ইনস্টিটিউট অব টেকনোলজিতে দেওয়া সমাবর্তন বক্তৃতায়

আজ বিশ্বের অন্যতম সম্মানজনক একটি প্রতিষ্ঠান থেকে তোমরা স্নাতক হচ্ছ। আমার যেদিন স্নাতক শেষ হলো, মনে আছি সেদিন খুব দিশেহারা বোধ করছিলাম। সামনে কী আসছে, কিছুই জানতাম না। যেই আমি সেমিস্টারের প্রথম দিনই ফাইনালের জন্য পড়া শুরু করতাম, হ্যাঁ, সেই আমিও অনিশ্চয়তায় ভুগছিলাম। গ্র্যাজুয়েশন অনুষ্ঠানে এসেই প্রথমবারের মতো আমি জীবনের সামনের ধাপগুলো দেখতে পাচ্ছিলাম না। রোমাঞ্চ, সম্ভাবনার পাশাপাশি অনিশ্চয়তার অনুভূতিও আমাকে ঘিরে ধরেছিল। তোমরা যারা নিশ্চিতভাবেই জানো, ক্যারিয়ারে সামনের দিনগুলোতে তুমি কী করতে যাচ্ছ, হাত তোলো তো দেখি। বাহ্, অনেকেই জানো দেখছি। যা হোক, আমি জানতাম না। জানতাম, কোথায় আমাকে সবচেয়ে মানাবে। কোথায় নিজের সর্বোচ্চটা ঢেলে দিতে পারব। এখন কোনো পরামর্শের প্রয়োজন হলে আমি মার্ক জাকারবার্গের কাছে যাই। কিন্তু আমি যেই সময়ের কথা বলছি, তখন সে প্রাথমিক বিদ্যালয়ে পড়ত!

একটা ব্যাপারে নিশ্চিত ছিলাম: আর যা-ই হোক আমি ব্যবসা করব না। এমনকি প্রযুক্তি নিয়ে কাজ করার কোনো ইচ্ছেও আমার ছিল না। তোমরা যারা একটু আগে হাত তুলেছ, তাদের সতর্ক করে দিতে চাই। তুমি যেমনটা ভাবছ, সব সময় তা হবে না। কিন্তু অনিশ্চয়তার পথ ধরে হেঁটেই তুমি অনেক কিছু শিখবে। আজ আমার প্রথম চাকরির অভিজ্ঞতা তোমাদের বলব। কলেজ জীবনের শেষে আমি ভারতের একটা কুষ্ঠ নিরাময় প্রকল্পে কাজ করেছিলাম।

বহু বছর আগে থেকেই একটা প্রচলন ছিল। কুষ্ঠ রোগে আক্রান্ত মানুষদের তাদের সমাজে একঘরে করে দেওয়া হতো। আমি যখন কলেজ থেকে বেরিয়েছি, তত দিনে প্রযুক্তিগত চ্যালেঞ্জগুলোর সমাধান হয়েছে। চিকিৎসকেরা খুব সহজেই কুষ্ঠ রোগ শনাক্ত করতে পারতেন। চামড়ার ওপর এর লক্ষণ দেখা যেত। ওষুধের সাহায্যে সহজেই এর নিরাময় সম্ভব। কিন্তু কুসংস্কারটা তখনো ছিল। অতএব এই অসুখ হলে লোকে চিকিৎসকের শরণাপন্ন হওয়ার বদলে অসুখটা লুকিয়ে রাখত। সেই দিনগুলোর কথা আমি কখনো ভুলব না। আমি যখন কুষ্ঠ রোগীদের সঙ্গে দেখা করতাম, তাদের দিকে হাত বাড়িয়ে দিতাম, তারা ছিটকে পেছনে সরে যেত। কারণ, মানুষের হাতের স্পর্শ না পাওয়ার সঙ্গে তারা অভ্যস্ত হয়ে পড়েছিল।

সত্যিকার পরিবর্তনটা কিন্তু চিকিৎসক বা প্রযুক্তির হাত ধরে আসেনি। স্থানীয় সম্প্রদায়ের নেতারাই এ ক্ষেত্রে বড় ভূমিকা রেখেছেন। তাঁরা জানতেন, এই কুসংস্কার দূর করতে না পারলে রোগটাকে কখনোই দূর করা যাবে না। সুতরাং তাঁরা স্থানীয় ভাষায় বিভিন্ন সচেতনতামূলক নাটক রচনা করলেন, গান লিখলেন। নাটক ও গানের মাধ্যমে তাঁরা মানুষের কাছে গিয়েছেন, ভয় দূর করেছেন। তাঁরা বুঝতে পেরেছিলেন, প্রযুক্তি দিয়ে নয়, মানবতা দিয়ে এই লড়াইয়ে জেতা সম্ভব। অন্যভাবে বললে, এই কাজ প্রযুক্তির নয়, মানুষের।

এমআইটিতে এই শিক্ষাটাই তোমাদের দেওয়া হয়। এখানে শুধু প্রযুক্তিগত ডিগ্রিই দেওয়া হয় না। নগর-পরিকল্পনা থেকে শুরু করে ব্যবস্থাপনা—সবই তোমাদের পড়তে হয়। তোমরা জানো, শুধু প্রযুক্তি তৈরি করাই মানুষের কাজ নয়। এটাকে মানুষের কাছে নিয়ে গিয়ে জীবনটাযাত্রাকে উন্নত করাও মানুষের দায়িত্ব।

ইন্টারনেটের দুনিয়ায় আজ স্রেফ এক লাইন লিখে কিংবা একটি ছবির মাধ্যমেই লাখো মানুষকে অনুপ্রাণিত করা যায়। যাঁরা ভালো কাজ করতে চান, এই সুবিধা তাঁদের জন্য অনেক বড় সুযোগ। সমতা প্রতিষ্ঠার জন্য, যৌন হয়রানি প্রতিরোধের জন্য এই যোগাযোগ অনেক বড় শক্তি হিসেবে কাজ করে।

এমআইটির সমাবর্তনে শেরিল স্যান্ডবার্গ
এমআইটির সমাবর্তনে শেরিল স্যান্ডবার্গ

একই সঙ্গে যারা মানবতার ক্ষতি সাধন করতে চায়, ইন্টারনেট তাদের জন্যও শক্তি হিসেবে কাজ করে। কণ্ঠ ছাড়ার সুযোগ যেহেতু সবাই পাচ্ছে, কেউ কেউ তো ঘৃণা ছড়াবেই। বলার অধিকার যখন সবার, কেউ কেউ তো মিথ্যা বলবেই। সবাই যখন জোট তৈরি করতে পারছে, কিছু মানুষ নিশ্চয়ই অসৎ উদ্দেশ্যে একজোট হবে।

নতুন প্রযুক্তির প্রভাব সম্পর্কে লিখেছেন সাংবাদিক আন্নে ও’হেয়ার ম্যাককরমিক। তিনি বলেছেন, আমরা এমন এক গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করেছি, যেখানে যে কেউ যেকোনো কথা বলতে পারে এবং সবাই সে কথা শুনতে পায়। একই সঙ্গে তিনি শঙ্কা প্রকাশ করেছেন, এই প্রযুক্তি কি মানুষকে দলবদ্ধ করে, নাকি অসহিষ্ণু করে? এতে কি সময়ের সদ্ব্যবহার হয়, না সময় নষ্ট হয়? হ্যাঁ, ১৯৩২ সালে তিনি এসব কথা লিখেছেন—রেডিও প্রসঙ্গে। আর হ্যাঁ, তিনিই প্রথম নারী, যিনি সাংবাদিকতায় প্রথম পুলিৎজার জিতেছেন।

কথা হলো, আমরা যে চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হচ্ছি সেটা নতুন কিছু নয়, তার মানে এই নয় যে সমস্যাটা সহজ। আগের প্রজন্ম নতুন প্রযুক্তির কারণে সমস্যায় পড়েছে, সেই সমস্যার সমাধান করেছে। আমাদেরও তা-ই করতে হবে। আমার মনে হয় এই চ্যালেঞ্জ মোকাবিলার তিনটা পথ আছে। আমরা ভয় পেয়ে পিছু হটতে পারি। কোনো কথা না শুনে একগুঁয়ে বিশ্বাস নিয়ে আমরা এগোতে পারি। অথবা এসব আবিষ্কার মানুষ ভালো ও মন্দ—দুই কাজেই ব্যবহার করবে, এটা মেনে নিয়েই আমরা ভালোর জন্য লড়তে পারি।

আমি তোমাদের তৃতীয় পথটি বেছে নিতে বলব। চোখ খোলা রাখো আর আশাবাদী হও। সমতা, গণতন্ত্র, সত্য ও উদারতা ছড়িয়ে দেওয়ার জন্য এবং ঘৃণা, সহিংসতা, প্রতারণার বিরুদ্ধে দেয়াল তুলে দেওয়ার জন্য প্রযুক্তি তৈরি করো।

ফেসবুক পৃথিবীর মানুষের সঙ্গে মানুষের যে সংযোগ গড়ে দিয়েছে, সে জন্য আমি গর্বিত। ফেসবুক ব্যবহার করে মানুষ যেভাবে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার চেষ্টা করেছে, নারীরা যেভাবে এক হয়েছে, প্রতিবাদ করেছে, এসব ঘটনা আমাকে গর্বিত করে। ফেসবুককে ব্যবহার করে মানুষ যেভাবে ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান তৈরি করেছে, কর্মসংস্থান সৃষ্টি করেছে, এগুলোও আমার জন্য গর্বের।

কিন্তু ভালোর সঙ্গে পায়ে-পায়ে এসেছে মন্দও। এসব প্রতিরোধে আমরা যথেষ্ট ভূমিকা রাখতে পারিনি। যখন ভালো কিছু করার প্রবল বিশ্বাস থেকে মন্দটা তোমার চোখ এড়িয়ে যায়, এটা খুব বেদনাদায়ক। মানুষের বিশ্বাস ভঙ্গ করার ব্যথা মেনে নেওয়া কঠিন।

এই কঠিন সময়ে আমার মনে পড়েছে নৌ একাডেমির সাবেক তত্ত্বাবধায়ক মাইকেল মিলারের কথা, শান্ত সমুদ্র কখনো ভালো নাবিক তৈরি করতে পারে না। ঠিকই বলেছেন তিনি। জীবনের সবচেয়ে কঠিন সময়েই আমি সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয়গুলো শিখেছি। বড় হওয়ার পাশাপাশি বড় কষ্টগুলোর সঙ্গে তোমার পরিচয় হবে। তুমি যখন ভুল স্বীকার করবে, তখনই তুমি সামনের ভুলগুলো প্রতিরোধ করতে সচেষ্ট হবে। এটাই এখন আমার কাজ। জানি এটা সহজ নয়। খুব দ্রুত এর সমাধান হবে না। কিন্তু আমরা চেষ্টা চালিয়ে যাব।

বড় চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি আমরা সবাই। আমাদের জীবনে প্রযুক্তির ওপর নির্ভরতা বাড়ছে। প্রযুক্তির সঙ্গে আমাদের সম্পর্ক যেমন বদলাচ্ছে, তেমনি আমাদের নিজেদেরও বদলাতে হবে। আমাদের দায়িত্বের পুরো গুরুত্বটা অনুধাবন করতে হবে। প্রযুক্তি তৈরি করাই যথেষ্ট নয়, এই প্রযুক্তি মানুষের উপকারে আসছে, সেটাও আমাদের নিশ্চিত করতে হবে। (সংক্ষেপিত)

ইংরেজি থেকে অনুবাদ: মো. সাইফুল্লাহ

সূত্র: এমআইটি নিউজ