সনদ লিখে ৪৪ বছর

খোরশেদ আলম ভূইয়া। ছবি: খালেদ সরকার
খোরশেদ আলম ভূইয়া। ছবি: খালেদ সরকার

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রশাসনিক ভবনের ৩০৯ নম্বর কক্ষটি সনদ বিভাগের। তৃতীয় তলার এই কক্ষ এখন সরগরম। সেখানে চলছে সনদ লেখার কাজ। আগামী ৬ অক্টোবর বিশ্ববিদ্যালয়ের ৫১তম সমাবর্তন, সনদ লেখকদের যেন দম ফেলার ফুরসত নেই।

যাঁর খোঁজে সেখানে যাওয়া, তাঁকে পাওয়া গেল পাশের কক্ষেই। শুভ্র শ্মশ্রুশোভিত খোরশেদ আলম ভূইয়ার মুখজুড়ে স্মিতহাসি। চোখে সোনালি ফ্রেমের চশমা। বৃদ্ধাঙ্গুলি-তর্জনী-মধ্যমা—ডান হাতের তিন আঙুলের ফাঁকে পরম আদরে স্থান দখল করে আছে ফাউন্টেন পেন। তবে স্থির নয় সে ঝরনা কলম। গভীর একাগ্রতায় লিখছেন তিনি। ঝরনা কলমের মুখ বেয়ে মুক্তোর দানার মতো ঝরে পড়ছে এক একটি অক্ষর। সেই সব অক্ষর পাশাপাশি বসে শৈল্পিক সৌন্দর্য নিয়ে হয়ে উঠছে এক একটি শব্দ—শিক্ষার্থীর নাম, পিতার নাম, পঠিত বিষয়ের নাম কিংবা অর্জিত ফলাফল। এটিই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সনদপত্র। সনদ লেখার কাজটি খোরশেদ আলম ভূইয়া ৪৪ বছর ধরে করছেন।

বর্তমানে বিশ্ববিদ্যালয়ের সহকারী পরীক্ষা নিয়ন্ত্রক খোরশেদ আলম ভূইয়া পেশাজীবন শুরু করেন ১৯৭৪ সালে। কথায় কথায় বললেন, ‘আমার পদের নাম ছিল নিম্নমান সহকারী (সনদ লেখক)। স্বাধীন বাংলাদেশে এই পদে প্রথম নিয়োগ ছিল সেটাই। তাই বলা যায়, স্বাধীন দেশে আমিই প্রথম সনদ লেখক হিসেবে বিশ্ববিদ্যালয়ে যোগ দিয়েছি।’

আমরা কান পাতি ১৯৭৪ সালের খোরশেদ আলমের জীবনের গল্পে। সদ্য মাধ্যমিক পাস করে উচ্চমাধ্যমিকে পড়ছেন লক্ষ্মীপুরের রামগঞ্জ কলেজে। লজিং থাকেন এক বাড়িতে। ভয়াবহ বন্যা হলো সে বছর। ফিরে এলেন নিজ গ্রাম দল্টায়। ঘরে প্রচণ্ড অভাব-অনটন। এক বেলা খেলে আরেক বেলার জোগাড় নেই। বড় ভাই চাকরি করতেন বাংলাদেশ রেলওয়েতে। মায়ের হাত ধরে ঢাকার কমলাপুরে বড় ভাইয়ের বাসায় এসে ওঠেন। ধুলোবালির মায়াময় গ্রাম ছেড়ে সিমেন্ট-সুরকির বিরস শহর। ভীষণ মন খারাপ নিয়ে ঘুরে বেড়ান কাজের খোঁজে। বড় ভাইয়ের ছোট্ট বাসা। ঘুমানোর জায়গা হয় না তাতে। তেজগাঁওয়ে ফুফাতো ভাইয়ের দোকান। রাতটুকু কাটান সেখানেই। এভাবেই দিন চলছিল। একদিন বড় ভাইয়ের অফিসে রাখা পত্রিকায় চোখ আটকে যায় একটি চাকরির বিজ্ঞপ্তিতে। ‘ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে নিম্নমান সহকারী (সনদ লেখক) আবশ্যক’। শিক্ষাগত যোগ্যতা—মাধ্যমিক পাস, সুন্দর হস্তাক্ষরের অধিকারী হতে হবে। আর দ্বিতীয়বার ভাবেননি। স্বহস্তে লিখে ফেললেন দরখাস্ত।

প্রাথমিকভাবে ১০০ জনকে বাছাই করা হলো। নাম থাকল খোরশেদ আলমের। বলছিলেন, ‘১০০ নম্বরের লিখিত পরীক্ষা হয়। লিখিত পরীক্ষায় উত্তীর্ণদের থেকে দশজনের সাক্ষাৎকার নেওয়া হয়। চাকরির জন্য চূড়ান্তভাবে বাছাই করা হয় দুজনকে। দুজনের মধ্যে প্রথম নিয়োগপত্র পেয়েছি আমি।’

হাতের লেখা সুন্দর করার বোধটি তৈরি হয়েছিল কীভাবে? জিজ্ঞাসাটির জবাব দিতে এবার ফিরে গেলেন শৈশবে। বললেন, ‘আমি ছোটবেলায় খুব দুর্বল স্বাস্থ্যের অধিকারী ছিলাম। একেবারে ছিপছিপে গড়নের। কেবলই মনে হতো, আমাকে দিয়ে ভারী কোনো কাজ সম্ভব নয়। এমন একটা যোগ্যতা আমাকে অর্জন করতে হবে, যা ভারী কাজ থেকে বাঁচিয়ে দেবে। তবে লেখার কাজই হবে, এমন নয়। আমাদের চুন্নু স্যারের অসম্ভব সুন্দর হাতের লেখা ছিল। তাঁর লেখা দেখেই মূলত সুন্দর হাতের লেখার প্রতি ঝোঁকটা তৈরি হয়।’

তবে হাতের লেখাকে পেশা হিসেবে গ্রহণ করা যেতে পারে, সে রকম ভাবেননি কখনো। কিন্তু একটা সূক্ষ্ম ভাবনা ছিল বোধ হয়। সেই ছোটবেলায় প্রযুক্তির এত সুবিধা ছিল না। ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনে যাঁরা প্রতিদ্বন্দ্বিতা করতেন, তাঁরা অল্পস্বল্প পারিশ্রমিকের বিনিময়ে তাঁকে দিয়ে পোস্টার-ব্যানার লিখিয়ে নিতেন। পেশার ভাবনাটি সেখান থেকেও তৈরি হয়ে থাকতে পারে।

হস্তাক্ষর শিল্পের সেবা ও চর্চার এই দীর্ঘ পথযাত্রায় শুধু সনদ লেখার কাজেই নিজেকে সীমাবদ্ধ রাখেননি। শিল্পটির উৎকর্ষে নিরলস কাজ করে যাচ্ছেন। নতুন নতুন ফন্ট তৈরিসহ লেখার নান্দনিকতা বাড়ানোর বিভিন্ন কৌশল নিয়ে কাজ করছেন। দেশে বাংলা কিংবা ইংরেজি ক্যালিগ্রাফি প্রশিক্ষণ দেওয়ার মতো কোনো প্রতিষ্ঠান গড়ে ওঠেনি। নিজস্ব প্রচেষ্টায় সারা দেশে নগণ্য সংখ্যক সৌন্দর্যপ্রিয় মানুষ সুন্দর লেখার অবিরাম চর্চা করে যাচ্ছেন। সেই প্রয়োজনীয়তার কথা ভেবে বড় মেয়ে রুমানা তাসমিনকে নিয়ে ‘ফাউন্টেন পেন’ নামে হাতের লেখা ও ক্যালিগ্রাফি প্রশিক্ষণের একটি প্রতিষ্ঠান তৈরির চেষ্টা করছেন। শেষ বেলায় বললেন, দেশের সর্বোচ্চ বিদ্যাপীঠ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এখনো হাতে লেখা একাডেমিক সনদ প্রদান করে আসছে। কিন্তু শিল্পটিকে বাঁচিয়ে রাখতে তা যথেষ্ট নয়। বাংলা একাডেমিসহ সংশ্লিষ্ট সবার আন্তরিকতা জরুরি।