মণিপুরি তাঁতে সোনিয়ার স্বপ্ন

সোনিয়া মান্নান  । ছবি : সংগৃহীত
সোনিয়া মান্নান । ছবি : সংগৃহীত

মা-খালা, বোন পছন্দ করেন মণিপুরি তাঁতের শাড়ি। সেই সব শাড়ির ছবি তুলে ‘আপলোড’ করতেন ফেসবুকে। তাতেই শাড়ি সরবরাহের ‘অর্ডার’ আসতে থাকে। অনেকটা শখের বশে শাড়ি সংগ্রহ করে বিক্রি করা শুরু করেন। ক্রেতাদের চাহিদা অনুযায়ী জোগান দিতে গিয়ে মণিপুরি পাড়ায় ঘুরে ভালো মান ও সুন্দর নকশার পণ্যগুলো খুঁজে বের করা, ক্রেতার হাতে পৌঁছানো ও তাঁদের ভালো লাগার আনন্দ— এটা একটা মধুর নেশার মতো হয়ে গেল।

একজন সোনিয়া মান্নান এভাবেই জড়িয়ে গেলেন মণিপুরি তাঁত কাপড়ের জগতে। মণিপুরি পাড়ায় ঘুরে ঘুরে তাঁতের কাপড়, ওড়না, বিছানার চাদর ও শাল সংগ্রহ করেন। ছবি তোলেন। ফেসবুক পেজে ছবি দেন। তা দেখেই আগ্রহী ক্রেতারা পছন্দের কাপড় বাছাই করেন। তিনিও সেটা যাঁর যাঁর ঠিকানায় কুরিয়ারের মাধ্যমে পৌঁছে দেন। বিকাশ বা ব্যাংকের মাধ্যমে ক্রেতাদের পাঠানো টাকাটাও পেয়ে যান।

সোনিয়া মান্নান বলেন, ‘ছবি তুলে দিতাম। অর্ডার আসত। এই তো শুরু।’ বাবা-মাসহ পরিবারের অন্য সদস্যদের সঙ্গে থাকেন মৌলভীবাজার শহরের বনশ্রী এলাকায় সোনিয়া মান্নান। দুই ভাই দুই বোনের মধ্যে তিনি বড়। ২০১৪ থেকে মোটামুটি অনলাইনে তাঁর ব্যবসা-বাণিজ্য বাড়তে থাকে। এখন একটা পরিচিতি, সুনাম, বিশ্বস্ততার ভিত তৈরি হয়েছে। তাঁর প্রতিষ্ঠানের নাম ‘মণিপুরি হ্যান্ডিক্রাফট’। তাঁর ক্রেতা সারা দেশেই। যুক্তরাজ্য, যুক্তরাষ্ট্র, অস্ট্রেলিয়াসহ বিভিন্ন দেশের ক্রেতারাও তাঁর কাছ থেকে অনলাইনে কাপড় কিনছেন।

তাঁতের এসব শাড়িতে  জড়িয়ে আছে সোনিয়ার স্বপ্ন
তাঁতের এসব শাড়িতে জড়িয়ে আছে সোনিয়ার স্বপ্ন

সোনিয়া মান্নান জানান, বারবার বেচাবিক্রির কারণে তাঁর একটা পরিচিত ক্রেতামহল তৈরি হয়েছে। পরিচিত ক্রেতাদের সঙ্গে তাঁর ভালো যোগাযোগ। শুরুতে কিছুটা বোঝাপড়ার সংকট ছিল। কীভাবে পণ্যের পরিচিতি তুলে ধরবেন, প্রচার করবেন সে বিষয়ে তেমন ধারণা ছিল না। আস্তে আস্তে সেই পদ্ধতিটিও আয়ত্তে এসেছে। তিনি তাঁতিদের কাছ থেকে সরাসরি কাপড় কেনেন। নিয়মিত কেনাকাটা করতে গিয়ে তাঁতিদের সঙ্গেও তাঁর যোগাযোগটা সাবলীল।

তাঁতিদের বাড়ি বাড়ি ঘুরে কাপড় সংগ্রহ করতে হয় তাঁকে। তাতে বাণিজ্যটাও হয়, ঘোরাও হয়। সোনিয়া মান্নান জানালেন, তাঁর দেখাদেখি আরও অনেকে এখন অনলাইনে ব্যবসা করছেন। যাঁদের মণিপুরি তাঁতের কাপড়ের শো-রুম ছিল, তাঁরা অনলাইনে ব্যবসার পথটা জেনে গেছেন। তাঁর জানা মতে, মৌলভীবাজারের শ্রীমঙ্গল ও সিলেটে অন্তত এ রকম ২০-২৫টা অনলাইন দোকান আছে।

অনলাইনে মণিপুরি তাঁত কাপড়ের ব্যবসাটা করতে গিয়ে নিজেও কিছু কাজ শিখেছেন। নিজেই এখন মণিপুরি চাদর বানাতে পারেন। শাড়ি বানানোটাও শিখতে চান। একজনের সঙ্গে কথা হয়েছে। ওই তাঁতি তাঁকে মণিপুরি শাড়ি বোনা শেখাবেন বলেছেন। সেই অপেক্ষায় আছেন।

তবে শুধু মণিপুরি তাঁতের কাপড়েই নেই তাঁর মণিপুরি হ্যান্ডিক্রাফটের দুনিয়া। হাতে তৈরি অলংকারও এখন ক্রেতাদের আগ্রহ মেটাচ্ছে। মেটাল, সুতা, কড়ি ইত্যাদি দিয়ে তৈরি করছেন বিভিন্ন ধরনের অলংকার। অনলাইনে এসবের ছবি দিচ্ছেন। ক্রেতারা সেই অলংকারও লুফে নিচ্ছেন। এখানে দুজনের কর্মসংস্থানও হয়েছে। দুজন কর্মী অলংকার তৈরির কাজ করছেন। এতে তাঁদেরও (কর্মীদের) আয়ের একটা উপায় হয়েছে।

তিনি বলেন, ‘ঘুরতে যাই। ডিজাইন পছন্দ হলো তো নিয়ে আসি। শখ থেকে শুরু। এখন দায়বদ্ধতা চলে আসছে। আমার ওপর অনেকে নির্ভর করেন। তাই মান, ডিজাইন এগুলোকে গুরুত্ব দিতে হচ্ছে।’ তিনি জানান, শুধু খুচরা বিক্রিই না। শপারু, আজকের ডিল ও দর্পণ নামে অনলাইন দোকানগুলো তাঁর কাছ থেকে মণিপুরি তাঁতের পণ্য কিনছে। তিনিও বিশ্বস্ততার সঙ্গে সরবরাহ করেন। এ ক্ষেত্রে তাঁর ছোট বোন জেসমিন মান্নান অ্যানি সহযোগিতা করে। মা মেরি মান্নানকেও ফেসবুক চালানো শিখিয়ে নিয়েছেন। তিনি কোনো কারণে অনুপস্থিত থাকলে মা অর্ডার গ্রহণ ও সরবরাহ চালিয়ে নিতে পারেন। বাবা সহযোগিতা করেন। ঘরে বসে চালানো এই ব্যবসায় মাসে তাঁর ১০ থেকে ১৫ হাজার টাকা আয় হচ্ছে।

সোনিয়া মান্নান কিন্তু আরেক জগতের মেয়ে। স্নাতকোত্তর পর্যন্ত পড়ালেখা করেছেন উদ্ভিদ বিজ্ঞানে। কোথায় গাছগাছড়া নিয়ে থাকবেন তা না, সুযোগ এল দেশের বাইরে যাওয়ার। ২০০৫ সালে চলে গেলেন থাইল্যান্ড। থাইল্যান্ডে ‘তেলাপিয়া ফিশ কালচার’ নিয়ে ৩ মাসের ডিপ্লোমা করলেন। ৮ মাস ফিলিপাইনে তেলাপিয়ার ওপর গবেষণা করলেন। তেলাপিয়া মাছের ওপর দুটো ডিপ্লোমা তাঁর। এরপর দেশে এসে একটি আমেরিকান জয়েন্টভেনচার কোম্পানিতে যোগ দিলেন। এখানে সিএও (চিফ অ্যাকাউন্ট অফিসার) পদে উন্নীত হলেন। কিন্তু প্রায় ১০ বছর চাকরি করে ব্যক্তিগত কারণে এটি ছেড়ে দিলেন। তেলাপিয়া মাছের পরামর্শক হিসেবে বেশ কিছু মাছের খামারে কাজ করেছেন। মনেরমতো চাকরি পেলে হয়তো ঢুকে যাবেন আবারও।

কিন্তু এই অনলাইন ব্যবসাটা ছাড়ার কোনো ইচ্ছে তাঁর নেই। এটা অন্য কাজের ফাঁকে করতে কোনো সমস্যা হয় না। তেমন বাড়তি সময় লাগে না। তবে তাঁর মতে, অনলাইন ব্যবসায় একটা নীতিমালা থাকা দরকার। অনেকে এ ব্যবসায় আসছেন। নীতিমালা না থাকায় অনেকে বিভিন্নভাবে প্রতারিত হচ্ছেন।

‘এটা এখন আমার কাছে আনন্দের জায়গা। কাজটা পছন্দের। এটা করতে পেরে খুশি হয়েছি। ভালো লাগে। এখন নিজে তাঁতের কাজটা শিখতে চাইছি। আমার স্বপ্ন নিজের একটা ব্র্যান্ড তৈরি করা। মৌলভীবাজারে একটা কারখানা করব।’ এখন এই স্বপ্ন পূরণেই কাজ করে যাচ্ছেন সোনিয়া মান্নান।