সবুজের সম্রাট শাহজাহান

>শুধু ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রাঙ্গণেই প্রায় পাঁচ হাজার গাছ লাগিয়েছেন শাহজাহান আলী। অনেক গাছের চারা সংগ্রহের সঙ্গে জড়িয়ে আছে মজার স্মৃতি; বিখ্যাত মানুষের হাতের ছোঁয়া। বৃক্ষপ্রেমী শাহজাহান আলী শোনালেন আরও অনেক কথা।
নিজের লাগানো গাছের সঙ্গে শাহজাহান অালী । ছবি: খালেদ সরকার
নিজের লাগানো গাছের সঙ্গে শাহজাহান অালী । ছবি: খালেদ সরকার

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শারীরিক শিক্ষাকেন্দ্রের ভেতরেই সুইমিংপুল এলাকা। প্রবেশমুখে মাথা তুলে ওপরে তাকাতেই চোখে পড়ে ভবনের গায়ে বড় বড় অক্ষরে লেখা, ‘জীবনের জন্য সাঁতার’। সাঁতারের প্রয়োজনীয়তা–সংক্রান্ত জীবনঘনিষ্ঠ বক্তব্য মনের ভেতরে নিয়ে পুল প্রাঙ্গণে দাঁড়াই। মুহূর্তেই সেখানে একটা নির্মল অনুভূতি ছড়িয়ে পড়ে যেন। দুই পাশের পাঁচিল ঘেঁষে নিয়মিত দূরত্বে ফুলের গাছ। উত্তর পাশ পুরোটা জুড়ে নানা রকম বৃক্ষের সমারোহ। চড়ুই পাখি, ঘুঘু এবং নাম না জানা কতগুলো পাখি খেয়ালি ওড়াউড়ি করছে এপাশ থেকে ওপাশ। সিমেন্ট–সুরকির এই বিরস নগরীর বুকে যে দৃশ্য রীতিমতো বিরল। প্রায় পাঁচ হাজার গাছ লাগিয়ে বিশ্ববিদ্যালয়কে করেন পাখপাখালির নিরাপদ আশ্রয়স্থল। তিনি যেন সবুজের সম্রাট।

এ বিরল দৃশ্যটিই পরম যত্নে গড়ে তুলেছেন শাহজাহান আলী। তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় শারীরিক শিক্ষাকেন্দ্রের উপপরিচালক; দায়িত্ব পালন করছেন সুইমিংপুলের সার্বিক দেখভালের।

 বৃক্ষ তোমার নাম কী

 ১৫ অক্টোবর শাহজাহান আলীর আপন প্রাঙ্গণে হাজির হয়েছিলাম দুপুরে। নিজ হাতে গড়ে তোলা টুকরো অরণ্য ঘুরে ঘুরে দেখালেন। উত্তর-পশ্চিম কোণে পাঁচিলের বাইরে ফুটপাতের পাশে সগৌরবে দাঁড়িয়ে আছে একটি নিমগাছ। এটিই ‘মাদার ট্রি’। গাছটি নিজ হাতে লাগিয়েছিলেন ২০০৪ সালে। এ গাছের নিচের পুরো অংশ অত্যন্ত পরিষ্কার করে রাখা হয়েছে। বীজগুলো যখন পড়ে থাকে ছড়িয়ে–ছিটিয়ে, সযত্নে জড়ো করে ছিটিয়ে দেন পাঁচিল ঘেঁষে। অসংখ্য নিমচারায় ভরে যায় সে বীজতলা। সেখান থেকে নিয়ে বিভিন্ন জায়গায় রোপণ করেন। প্যাকেটজাত করে বিতরণ করেন বিনা মূল্যে।

ধীরে ধীরে সামনে এগোতে পরিচিত গাছেদের ফাঁকে ফাঁকে অপরিচিত বিভিন্ন গাছ। কোনোটা পরিণত, আবার কোনোটা চারা অবস্থা থেকে মাত্রই ছোট ডাল মেলে বেড়ে উঠছে। শরীরভর্তি সবুজ-কোমল-কচি পাতা। গোলাপজাম, কোকোগাছ, ভিয়েতনামের নারকেল, লবঙ্গ, দারুচিনি, তেজপাতা, মিষ্টি তেঁতুল, আরও কত–কী!

সুইমিংপুল থেকে বেরিয়ে কেন্দ্রীয় খেলার মাঠের কিনারা ঘেঁষে সামনে যেতে পরপর দু–তিনটি মাটির ঢিবি। শাহজাহান আলী জানালেন, গাছ লাগানোর জন্য এই মাটি তিনি সংগ্রহ করেছেন। বিশ্ববিদ্যালয়ের মোকাররম ভবনে কল স্থাপনের সময় উদ্বৃত্ত মাটি এখানে এনে রেখে দিয়েছেন। ইট, সুরকি, কাঁকরের জন্য গাছ লাগানো যায় না বলে এই বিকল্প ব্যবস্থা। শুধু তাই নয়, ঢাকা মেডিকেলের উল্টো পাশ দিয়ে খেলার মাঠের প্রাচীর ঘেঁষে তিন পাশ দিয়ে মাটি ফেলে কিছুটা উঁচু করেছেন। ২০১৫ সালে মেট্রোরেলের রাস্তার নির্মাণকাজ শুরু হলে সেখান থেকে উদ্বৃত্ত মাটি এনে এখানে ফেলেছিলেন। দীর্ঘ এই উঁচু জায়গার দুই পাশ দিয়ে লাগিয়েছেন বিভিন্ন গাছ। মাঝখান দিয়ে সরু রাস্তা। প্রাতর্ভ্রমণ কিংবা বৈকালিক ব্যায়ামের জন্য জায়গাটিকে উপযুক্ত করে তুলতে চান তিনি। ক্রিকেট অনুশীলন অংশের পাশে লাগিয়েছেন অনেকগুলো নিমগাছ। নাম দিয়েছেন নিমচত্বর। শিক্ষার্থীরা অনুশীলন করে ক্লান্ত শরীরে বসবে নিম গাছের ছায়ায়। বেশ কয়েকটি শিমুলগাছের চারা লাগিয়েছেন। একদিন শিমুল ফুলে ভরে উঠবে গাছ। মনে করিয়ে দেবে একুশে ফেব্রুয়ারির কথা। কামরাঙা, লটকন, সফেদা, আম, কাঁঠাল, এমন অসংখ্য ফলবান বৃক্ষ নিজ হাতে লাগিয়েছেন। শুধু মানুষই নয়, পাখিরাও খাবে সেই ফল।

কোন গাছের চারা কোথায় পেয়েছেন, কার কাছ থেকে পেয়েছেন—বলে যান আগ্রহভরে। এই যেমন বিদেশি খেজুরের চারাটি দিয়েছেন মাসুদ রানা সিরিজের লেখক কাজী আনোয়ার হোসেন। সুন্দরবন থেকে সুন্দরী গাছের চারা এনেছিলেন চারটি। তিনটি মরে গেছে। বাঁচাতে পেরেছেন একটি। ঐতিহ্যবাহী এ গাছটির ঝলমলে কচি পাতা দেখিয়ে শাহজাহান আলীও যেন নির্মল আনন্দে ঝলমল করে ওঠেন শিশুদের মতো। এ রকম প্রতিটি গাছের সঙ্গেই যেন লেগে আছে তাঁর একান্ত স্মৃতিময় গল্প।

 সংখ্যা যখন সংখ্যা শুধু

বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে কী পরিমাণ গাছ লাগিয়েছেন এখন পর্যন্ত? প্রশ্ন শুনে সদা হাস্যোজ্জ্বল মানুষটির হাসি ছড়িয়ে পড়ে সারা মুখজুড়ে। বললেন, ‘এত হিসাব তো আসলে করে রাখা যায় না। কত কত চারা রোপণ করেছি। সব তো বাঁচেও না। তবে ক্যাম্পাসে যে পরিমাণ গাছ লাগিয়েছি, তাতে হাজার পাঁচেকের কম হবে না।’

শারীরিক শিক্ষাকেন্দ্র ছাড়াও আইন অনুষদের রাস্তার ধার, শহীদ মিনারের ধার, দোয়েল চত্বর থেকে ছাত্র–শিক্ষক কেন্দ্রের সড়কদ্বীপ,কবি জসীমউদ্‌দীন হল, মলচত্বর, মাস্টারদা সূর্য সেন হল প্রভৃতি আবাসিক হল ছাড়াও বিভিন্ন শিক্ষকদের বাসায়ও গাছ রোপণ করেছেন তিনি। এমন পাগলামোতে তাঁকে সার্বক্ষণিক সহায়তা করেন তাঁর সহকারী আহমদ আলী। কঠোর পরিশ্রমী আহমদ সম্পর্কে তিনি বলেন, ‘আমি আহমদের মতো দশজন কর্মী পেলে ক্যাম্পাসটাকে ফুলে ফুলে ভরিয়ে দিতে পারব।’

বড় ভাইয়ের স্ত্রী লুৎফুন্নেসা হকের প্রেরণায় বৃক্ষরোপণের যে শখ পেয়ে বসেছিল সেই কৈশোরে, তা ক্রমে বেড়েই চলেছে। দুই পুত্রসন্তানের জনক শাহজাহান আলীর কাছে গাছেরাও সন্তানতুল্য। তিনি বলেন, ‘একটি বীজ রোপণের কিছুদিন পর যখন মাটি ফুঁড়ে পাতা গজায়, ধীরে ধীরে বেড়ে ওঠে চারাটি। একদিন কলি ধরে তাতে। পাপড়ি মেলে ফুল হয়ে ওঠে। ফল ধরে। এই যে নিজের চোখের সামনে এতগুলো অসাধারণ বিবর্তন, ঠিক নিজের সন্তানের মতোই; এই অনুভূতির তো কোনো তুলনা হয় না।’

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাস বিভাগের চেয়ারম্যান অধ্যাপক ড. আহমেদ আবদুল্লাহ জামাল শাহজাহান আলীর কথা বলতে গিয়ে বলেন, ‘তিনিই সুইমিংপুলের প্রাণ। ওখানকার গাছ, পানি সবকিছুতে লেগে আছে তাঁর হাতের স্পর্শ। এসব তাঁর সন্তানের মতোই। সুইমিংপুল এলাকা ছাড়াও ক্যাম্পাসে তিনি কয়েক হাজার গাছ লাগিয়েছেন। একজন নিভৃতচারী বৃক্ষসেবী তিনি।’

 দাও ফিরে সে অরণ্য

ইকোনমিস্ট ইন্টেলিজেন্স ইউনিটের (ইআইইউ) জরিপে বসবাসের ‘অযোগ্য’ শহরের তালিকায় দ্বিতীয় ঢাকা। ব্যাপারটিতে শাহজাহান আলী অত্যন্ত ব্যথিত, কিন্তু অবাক নন মোটেও। নাগরিক জ্ঞানের অভাব, অপরিকল্পিত ভবন নির্মাণ, মানুষের অনুপাতে বৃক্ষের স্বল্পতা এসবের জন্য দায়ী। তিনি বলেন, ‘নিচের মাটি ক্ষতিগ্রস্ত হয়ে যাওয়ায় হালকা ঝড়–বৃষ্টি হলেই গাছ উপড়ে যায়। বৃক্ষনিধন তো রীতিমতো উৎসবের মতো। গাছ কাটার ব্যাপারে মানুষ যতটা আগ্রহী, রোপণের ব্যাপারে ঠিক ততটাই অনাগ্রহী।’

আশির দশকে এই শহরে প্রথম যখন তিনি আসেন, আক্ষেপভরে স্মৃতিচারণা করেন সে সময়ের। বুড়িগঙ্গায় টলটলে পরিষ্কার পানি ছিল। ঢাকা ছিল সবুজ শ্যামল। স্বপ্ন দেখেন, শহরের মানুষ সচেতন হবে। বাসযোগ্য হয়ে উঠবে এই শহর।