মেজর জেনারেল সুসানে গীতি

মেজর জেনারেল সুসানে গীতি। ছবি: সাজিদ হোসেন
মেজর জেনারেল সুসানে গীতি। ছবি: সাজিদ হোসেন
বাংলাদেশ সেনাবাহিনী, তথা সশস্ত্র বাহিনীর ইতিহাসে প্রথম নারী মেজর জেনারেল সুসানে গীতি। প্রথম আলোকে দেওয়া সাক্ষাৎকারে উঠে এসেছে তাঁর কর্মজীবনের অভিজ্ঞতা, চ্যালেঞ্জ মোকাবিলার কথা।

কাঠের দরজায় লাল বোর্ডে বসানো দুটো সোনালি রঙের স্টার বা তারা জ্বলজ্বল করছে। আর ছিমছাম ঘরের মধ্যে যিনি বসে কাজ করছেন, তাঁর ইউনিফর্মেও একটির জায়গায় সম্প্রতি যোগ হয়েছে নতুন একটি তারা। তিনি হলেন বাংলাদেশ সেনাবাহিনী, তথা সশস্ত্র বাহিনীর ইতিহাসে প্রথম নারী মেজর জেনারেল পদে পদোন্নতিপ্রাপ্ত সুসানে গীতি।

সাধারণত সেনাবাহিনীর এ ধরনের উচ্চ পদে যিনি বসেন, তিনি গম্ভীর হবেন বলেই ধরে নেওয়া হয়। তবে নামের পাশে এমবিবিএস, এমসিপিএস, এফসিপিএস, এমএমএড ডিগ্রি যোগ হওয়া সুসানে গীতি এই ক্ষেত্রে ব্যতিক্রম। মুখে হাসি লেগেই আছে। মাঝে মাঝে সহকর্মীদের সঙ্গে হাসির মাত্রাটা বেশ খানিকটা বাড়েও। সহকর্মীরাও একবাক্যে তাঁদের নতুন ‘স্যার’ যে অন্যদের তুলনায় ব্যতিক্রম এবং মানুষ হিসেবে অমায়িক, তা জানিয়ে দিলেন।

বর্তমানে সুসানে গীতি রাজধানীর আর্মড ফোর্সেস ইনস্টিটিউট অব প্যাথলজির বিভাগীয় প্রধান হিসেবে কর্মরত। ১৮ অক্টোবর প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়ের অধীনে আন্তবাহিনী জনসংযোগ পরিদপ্তরের (আইএসপিআর) সহায়তায় ইনস্টিটিউটের কার্যালয়ে বসেই প্রথম আলোর পক্ষ থেকে কথা হয় সুসানে গীতির সঙ্গে।

গত ৩০ সেপ্টেম্বর সেনাবাহিনীর প্রধান জেনারেল আজিজ আহমেদ এবং কোয়ার্টারমাস্টার জেনারেল লেফটেন্যান্ট জেনারেল মো. সামছুল হক সেনাসদর দপ্তরে সুসানে গীতিকে মেজর জেনারেল পদবির র‌্যাঙ্ক ব্যাজ পরিয়ে দেন।

ব্যাজ পরানোর সেই দিনের অনুভূতি জানতে চাইলে সুসানে গীতি বলেন, সে দিনের অনুভূতি ভাষায় প্রকাশ করা কঠিন। সবার মনেই কর্মক্ষেত্রে উঁচু পদে যাওয়ার ইচ্ছা থাকে। আর এ ধরনের পদে সবাই আসতেও পারেন না। সব মিলিয়ে নিজেকে অনেক ভাগ্যবান মনে হয়েছে।

সুসানে গীতি ইতিহাসে এইবারই প্রথম নাম লেখালেন তা নয়, ১৯৯৬ সালে প্রথম নারী হিসেবে হেমাটোলজিতে এফসিপিএস ডিগ্রিও অর্জন করেন তিনি। আলাপচারিতায় পেশাগত জীবনের বাইরেও পারিবারিক বিষয়েও কথা বলেন সুসানে গীতি। জানালেন, তাঁর স্বামী ব্রিগেডিয়ার জেনারেল আসাদুল্লাহ মো. হোসেন সাদ (অবসরপ্রাপ্ত) একজন সফল সামরিক বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক ছিলেন। দুজনের পেশা এক হওয়ায় পেশাগত ক্ষেত্রে কোনো দ্বন্দ্ব দেখা দেয়নি, একইভাবে পারিবারিক কাজেও স্বামী ও সন্তানদের কাছ থেকে সার্বিক সহায়তা পেয়েছেন। কর্মজীবনে স্বামী ও স্ত্রীর প্রায়ই একই জায়গায় পোস্টিং হয়েছে। তবে মাঝে মাঝে একা একাও থাকতে হয়েছে। চট্টগ্রামে পোস্টিং থাকার সময় ছেলেমেয়েরা ঢাকায় ছিল। তখন তারাই সংসারের হাল ধরেছিল বলে উল্লেখ করলেন সুসানে গীতি।

একই তালে সংসার ও কর্মক্ষেত্র সামলানোর কৌশল জানতে চাইলে হাসতে হাসতে সুসানে গীতি বলেন, ‘অফিস টাইমের পর পুরোপুরি আমি সংসার জীবনে ঢুকে যাই। রান্নাসহ সব কাজই করতে হয়। ক্লাস সেভেন পর্যন্ত ছেলেমেয়েদের জন্য আলাদা শিক্ষক না রেখে নিজেই পড়িয়েছি। এমনও গেছে, টেবিলের একদিকে আমি আর অন্য পাশে দুই ছেলেমেয়ে অর্থাৎ তিনজন মিলেই পড়তাম।’ বর্তমানে বড় দুই ছেলে ও মেয়ে চিকিৎসক, তাঁদের একজন মেডিসিন এবং আরেকজন শিশুরোগ বিষয়ে পোস্ট গ্র্যাজুয়েশন করছেন। ছোট মেয়ে উচ্চমাধ্যমিকে পড়ছে।

নারীরা উঁচু পদে গেলে স্বাভাবিকভাবে প্রশ্ন আসে, এ পদে আসার জন্য নারী হিসেবে কোনো ধরনের চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করতে হয়েছে কি না। তবে এ প্রশ্নের উত্তরে জানালেন, সেনাবাহিনীতে নারী বা পুরুষ বলে আলাদা কিছু নেই। কে কোন পদে আছেন, তা–ই বিবেচ্য বিষয়।

সহকর্মীদের সঙ্গে মেজর জেনারেল সুসানে গীতি
সহকর্মীদের সঙ্গে মেজর জেনারেল সুসানে গীতি

তবে অন্যদের তুলনায় সুসানে গীতিকে এ পর্যায়ে আসার জন্য অন্য ধরনের সংগ্রাম করতে হয়েছে। বললেন, ‘বাবা পুলিশ সার্ভিসে ছিলেন। স্বাধীনতাযুদ্ধে বাবা খলিলুর রহমানকে হারিয়েছি। পাকিস্তানি সেনারা বাবাকে তুলে নিয়ে যায়। বাবা শহীদ, মা বেগম লতিফা খলিলকে আট সন্তানকে সামলাতে হয়েছে। এ ক্ষেত্রে নানি ফিরোজা বেগম সহায়তার হাত বাড়িয়ে দেন।’

বর্তমানে মা, নানি বেঁচে নেই। আট ভাইবোনের মধ্যে সুসানে গীতি সপ্তম। পাঁচ ভাই ও তিন বোনের মধ্যে তিন ভাইবোন চিকিৎসক, এক ভাই প্রকৌশলী, এক বোন অধ্যাপক, এক বোন মৎস্য কর্মকর্তা এবং দুই ভাই আমেরিকায় বসবাস করছেন।

বাবার পুলিশের চাকরির সুবাদে আগে বিভিন্ন জেলায় থাকার সুযোগ মিললেও বাবা শহীদ হওয়ার পর রাজশাহী ছাড়ার আর সুযোগ ছিল না। কথা বলার সময় সুসানে গীতি রাজশাহীর পিএন গার্লস স্কুল, রাজশাহী গভ. কলেজ, রাজশাহী মেডিকেল কলেজসহ চলে গেলেন রাজশাহীর সাহেব বাজার, সোনাদীঘিসহ বিভিন্ন জায়গায়। তবে সকালবেলা পেশাগত কাজের তাড়া থাকায় স্মৃতিকে খুব একটা প্রশ্রয় দিলেন না।

নামটি বেশ ব্যতিক্রম, এ প্রশ্ন করার আগে নিজেই হাসতে হাসতে জানালেন নাম নিয়ে বিড়ম্বনার কথা। নানা নামটি রেখেছিলেন। ফারসি শব্দ ‘সাউসান-ই গীতি’র বাংলা অর্থ দাঁড়ায় ‘পৃথিবীর ফুল’। কালের বিবর্তনে নামেও খানিকটা পরিবর্তন এসে তা হয়ে গেছে সুসানে গীতি। এ নামের জন্য প্রথমেই সবাই ধর্ম সম্পর্কে জানতে চান। স্কুল-কলেজে হিন্দুধর্মাবলম্বীরা পূজার সময় চাঁদা নিতে আসতেন। বড়দিনে খ্রিষ্টান শিক্ষার্থীরা শুভেচ্ছা জানাতেন।

মেজর জেনারেল সুসানে গীতি ১৯৮৫ সালে রাজশাহী মেডিকেল কলেজ থেকে এমবিবিএস পাস করেন। ১৯৮৬ সালে তিনি বাংলাদেশ সেনাবাহিনীতে নারী চিকিৎসক হিসেবে ক্যাপ্টেন পদবিতে যোগ দেন। জাতিসংঘ শান্তিরক্ষী মিশন এবং বিভিন্ন সামরিক হাসপাতালে প্যাথলজি বিশেষজ্ঞের দায়িত্ব পালন করেছেন তিনি। ২০০৭ সালে লাইবেরিয়া মিশনে যাওয়ার অভিজ্ঞতা নিয়ে বলেন, সেখানকার মানুষ চিকিৎসকদের বেশ পছন্দ করত। গ্রামে ফ্রি ফ্রাইডে ক্লিনিক, মশারির নিচে ঘুমানোর পরামর্শ দেওয়া, রক্তের গ্রুপ করা, কম্পিউটার কোর্স করানোসহ বিভিন্ন কাজ দেশটির সাধারণ মানুষ খুব পছন্দ করেছিল।

অন্য যে নারীরা সেনাবাহিনীর উচ্চ পদে আসতে চান, তাঁদের জন্য সুসানে গীতির পরামর্শ—চাকরির প্রতি যত্নবান হতে হবে। সেনাবাহিনীর নিয়মকানুন মেনে চলতে হবে।

নারী সেনাপ্রধান হয়েছেন সে দৃশ্য দেখা সম্ভব কি না? সুসানে গীতি বলেন, নারীর ক্ষমতায়ন হচ্ছে। সেনাবাহিনীর নারীরা বেশ ভালো করছেন। তাই নারীদের সেনাপ্রধান হতে তো কোনো সমস্যা নেই। আর একজন শিক্ষিত মা–ই পারেন শিক্ষিত জাতি উপহার দিতে।

নারীরা শিক্ষিত হচ্ছেন, অন্যদিকে পারিবারিক নির্যাতনের হারও বাড়ছে এ প্রসঙ্গে সুসানে গীতি বলেন, সংসারে স্বামী ও স্ত্রী দুজনেই যদি দুজনকে সম্মান না করেন, বুঝতে না পারেন, তাহলে নির্যাতনের মাত্রা বাড়বেই।

দেশের চিকিৎসাব্যবস্থা সম্পর্কে তিনি বলেন, চিকিৎসকেরা দিনরাত পরিশ্রম করছেন, তারপরও গণমাধ্যম শুধু চিকিৎসকদেরই সমালোচনা করে। তবে এটা সত্য যে শহরে চিকিৎসাব্যবস্থা যতটা উন্নত, তৃণমূলে এখন পর্যন্ত অনেক কিছুর ঘাটতি আছে।

সাক্ষাৎকার নেওয়ার পর ছবি তোলা ও ভিডিওর জন্য হেঁটে ইনস্টিটিউটের বিভিন্ন জায়গায় যেতে অনুরোধ করা হলো তাঁকে। হাঁটতে হাঁটতেই সুসানে গীতি বললেন, ‘আমি আস্তে হাঁটতে পারি না, আমি তো আর্মি স্টাইলে হাঁটি।’