নারীদের প্রশিক্ষণ দেন কুমিল্লার রোকেয়া

নিজের প্রশিক্ষণ কেন্দ্রে রোকেয়া বেগম। ছবি: অধুনা
নিজের প্রশিক্ষণ কেন্দ্রে রোকেয়া বেগম। ছবি: অধুনা

তখন কুমিল্লা শহরের মফিজাবাদ, নোনাবাদ, গোবিন্দপুর, সুজানগর ও হাড্ডিখোলা বস্তির বাসিন্দাদের অভাব–অনটন ছিল নিত্যসঙ্গী। সেখানে ছিল না কোনো ধরনের জ্ঞানের আলো। নারীরা ঘরে বসে থাকতেন। সময়টা ছিল ১৯৯৫ সাল।

এসব দেখে মনে হচ্ছিল তাঁদের জন্য কিছু একটা করা দরকার। এরপর এক লাখ টাকা পুঁজি নিয়ে সেখানে বিনা মূল্যে টয়লেট করা হলো। নারীদের সেলাইকাজের প্রশিক্ষণ দেওয়া হলো। ব্লক–বাটিকের কাজও শেখানো হলো। একই সঙ্গে শিশু ও বয়স্ক শিক্ষার কাজও শুরু হলো। কাজগুলো শুরু করলেন রোকেয়া বেগম।

রোকেয়া বলতে থাকেন, ‘শুরুতে নয়জন সদস্য নিয়ে ওই কাজে হাত দিই। বস্তির দুই হাজার বাসিন্দা এতে যুক্ত হয়ে উপকার পেতে থাকেন। দুই বছর কর্মীরা বেতনভাতা নেননি। আমার স্বামী মুক্তিযোদ্ধা আবুল কালাম আজাদ এ কাজে উৎসাহ দেন। তিনি বিভিন্ন দাতা সংস্থায় কাজ করেছিলেন। তাঁর অভিজ্ঞতা কাজে লাগাই।’

১৯৯৭ সালের ২১ জুন কুমিল্লা নগরের হাউজিং এস্টেট এলাকায় বাবার বাড়িতে শণ দিয়ে ছাওয়া একটি ঘরে রোকেয়া প্রতিষ্ঠা করেন এইড কুমিল্লা। যার পুরো নাম অ্যাসোসিয়েশন ফর ইন্টিগ্রেট ডেভেলপমেন্ট। বর্তমানে এই প্রতিষ্ঠান কুমিল্লার অন্যতম বৃহৎ সংস্থা। এখানে ১৬৭ জন কর্মকর্তা ও কর্মচারী আছেন। ১১টি শাখায় চলে এর কার্যক্রম। গৃহিণী থেকে সফল উদ্যোক্তা রোকেয়া বেগম। যে উদ্যোগে উন্নয়নও হচ্ছে অনেকের। রোকেয়া বেগম এই সংস্থার নির্বাহী পরিচালক।

‘কুমিল্লায় যখন এই কাজ শুরু করি, তখন বিভিন্ন স্থানে তিরস্কার পেয়েছি। কোথাও কোথাও উক্ত্যক্তের শিকার হতে হয়েছে। তখন পরিবারের সদস্যদের সহযোগিতা ও স্বামীর অনুপ্রেরণায় এগিয়ে গেছি। পুরো প্রতিষ্ঠান দাঁড় করাতে বড় শক্তি ছিল আমার আত্মবিশ্বাস। এই প্রতিষ্ঠানের কারণে কমনওয়েলথ থেকে বৃত্তিও পেয়েছি। দেশ–বিদেশ ঘুরেছি।’ বললেন রোকেয়া বেগম।

জানা গেছে, দুই বছর কাজ করার পর তাঁদের কার্যক্রম দেখে ১৯৯৭ সালে জামার্নি বস্তি উন্নয়নে, অস্ট্রেলিয়া গ্রামের নারীর ক্ষমতায়নে ও ইংল্যান্ড ধান চাষ প্রশিক্ষণের ওপর কাজ করতে সহযোগিতা করে। এরপর আর পেছনে তাকাতে হয়নি। ইউরোপীয় ইউনিয়ন নরসিংদী উপজেলার পলাশ উপজেলায় সেলাই প্রশিক্ষণ, কুড়িগ্রামে কাজ দেয়। ফেনীতে ডানিডা কাজ দেয়। ব্রিটিশ সরকার কুড়িগ্রামের চরাঞ্চলে চরবাসীর পুনর্বাসনের জন্য বিনা মূল্যে গরু বিতরণ করে এইড কুমিল্লাকে দিয়ে। ২০০২-২০০৪ সালে জমিতে কীটনাশক ব্যবহার না করে ফসল ফলানো ও উৎপাদিত ফসল ইঁদুরের হাত থেকে রক্ষা করা নিয়ে গবেষণা করে এ প্রতিষ্ঠান। ২০০৮ সালে পার্বত্য চট্টগ্রামে বাঁশ, ফসল ও গৃহস্থালি জিনিস ইঁদুর ধ্বংস করে ফেলে। তখন ইউএনডিপির আমন্ত্রণে বিশেষায়িত সংস্থা হিসেবে এইড কুমিল্লা আট মাস কাজ করে।

এইড কুমিল্লা ২০০০ সাল থেকে কুমিল্লা জেলায় অ্যাসিড–সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে জনমত গঠন, অ্যাসিডে আক্রান্ত নারীদের পুনর্বাসন, ঘর তুলে দেওয়াসহ নানা ধরনের কাজ করে। অ্যাসিড সারভাইভারস ফাউন্ডেশন এ ক্ষেত্রে তাদের সহযোগিতা করে। এ ছাড়া ২০১৬ সালে কুমিল্লা জেলার ১৫ জন বীরাঙ্গনা নারীকে ছয় লাখ টাকা দেয়।

এইড কুমিল্লা রোকেয়া বেগম শেফালী প্রথমে তাঁর বাবার বাড়িতে শুরু করেন। এরপর হাউজিং এস্টেট এলাকায় ভাড়া বাসা নেন। ২০০৪ সালে জাপান দূতাবাস দেখতে পেল, প্রতিষ্ঠানটি গ্রামের বিভিন্ন এলাকায় গাছের নিচে নারীদের প্রশিক্ষণ দিচ্ছে। তখন তারা তিনতলা একটি ভবন করে দেয়। কুমিল্লা শহরতলির রঘুপুর এলাকায় এর অবস্থান।

জানতে চাইলে কুমিল্লা ভিক্টোরিয়া সরকারি কলেজের সাবেক অধ্যক্ষ আমীর আলী চৌধুরী বলেন, রোকেয়া সংগ্রামী নারী। অনেক কষ্ট করে এগিয়ে যাচ্ছেন। সামাজিক নানা কর্মযজ্ঞে তাঁর ভূমিকা রয়েছে। এ ক্ষেত্রে তাঁর স্বামী পেছন থেকে সহযোগিতা করেছেন। দুজনের সম্মিলিত প্রচেষ্টায় কিছু হয়, সেই দৃষ্টান্ত তাঁরাই।

রোকেয়া বেগম শেফালীর এমন সাফল্যের পেছনে রয়েছেন তাঁর স্বামী মুক্তিযোদ্ধা আবুল কালাম আজাদ। তিনি নেপথ্যে থেকে প্রকল্প প্রস্তাব, বাজেট, বাস্তবায়ন কৌশল, বার্ষিক প্রতিবেদন তৈরি করে দেন। মাঠপর্যায়ে পুরো কর্মসূচি বাস্তবায়ন করেন রোকেয়া বেগম শেফালী। আবুল কালাম আজাদ বলেন, ‘ঘরে বসে না থেকে শেফালী নারীদের জন্য, দেশের জন্য কাজ করার কথা বলে। আমি তাকে উৎসাই দিই। সহযোগিতা করি।’ নারী ও শিশুদের জন্য আরও কাজ করতে চান রোকেয়া। তাঁর বিশ্বাস, নারীরা স্বাধীনভাবে ভাবতে পারবেন, নিজেদের ইচ্ছাশক্তি নিয়ে সমাজে প্রতিষ্ঠিত হতে পারবেন, স্বাবলম্বী হতে পারবেন।