নারী বা পুরুষ নয় - মানুষ : লেডি গাগা

লেডি গাগা
লেডি গাগা
উদ্ভট সাজপোশাকের কারণে প্রায়ই সমালোচিত হন ছয়বার গ্র্যামিজয়ী মার্কিন সংগীতশিল্পী লেডি গাগা, প্রশংসিত হন তাঁর গানের কারণে। গাগাকে আন্তর্জাতিক সংগীতাঙ্গনের অন্যতম প্রভাবশালী শিল্পী হিসেবে বিবেচনা করা হয়। গান দিয়ে গিনেস বুক অব ওয়ার্ল্ড রেকর্ডস থেকে শুরু করে বিলবোর্ড, টাইম ও ফোর্বস সাময়িকীর ক্ষমতাবানদের তালিকাতেও উঠেছে তাঁর নাম। এবার তিনি এল সাময়িকীর ‘উইম্যান ইন হলিউড’ সম্মাননা গ্রহণ করলেন। ১৬ অক্টোবর তাঁর হাতে এ সম্মাননা তুলে দেন জেনিফার লোপেজ। মঞ্চে লেডি গাগা এক আবেগঘন বক্তৃতা দেন। তাতে উঠে আসে তাঁর জীবনসংগ্রামের কথা।

কোনো দিন স্বপ্নেও ভাবিনি যে আমার জীবনটা কখনো এই পর্যায়ে এসে পৌঁছাবে, কোনো দিন শুধুই নারী হওয়ার জন্য আমাকে বিশেষভাবে সম্মান জানানো হবে। এটা আমার কল্পনার বাইরে ছিল। জীবনে এমন একটা দিনের কথা ভাবতেও পারিনি। সত্যিই আমি অনেক সৌভাগ্যবান এমন একটি ইন্ডাস্ট্রির অংশ হতে পেরে।

আজ এই অনুষ্ঠানে আসার জন্য তৈরি হওয়ার সময় একের পর এক পোশাক বদলাচ্ছিলাম। কখনো আঁটসাঁট গাউন পরছিলাম, কখনো পরে দেখছিলাম উঁচু কোন হিল জুতায় আমাকে কেমন মানায়। হিরের গয়না থেকে শুরু করে হাজার হাজার পাথর-পুঁতি বসানো ভারী পোশাক, পৃথিবীর সবচেয়ে সুন্দরের থেকেও সুন্দর সিল্কের জামা—একের পর এক পরে দেখছিলাম। কিন্তু সত্যি বলতে, সেই সবে নিজেকে দেখে খুব অসুস্থ লাগছিল। তখন নিজেকে প্রশ্ন করলাম—হলিউডে একজন নারীর আসল মানে কী? আমরা শুধু বিনোদন দেওয়ার কোনো ভোগ্যবস্তু নই। আমরা সাধারণ একটা ছবি নই, যা দেখলে কারও মুখে হাসি ফুটবে বা কারও উত্তেজনা বাড়বে। আমরা আজীবন চলতে থাকা কোনো সুন্দরী প্রতিযোগিতার অংশও নই, যারা সব সময় সৌন্দর্য নিয়ে একজন আরেকজনের বিরুদ্ধে লড়াই করতেই থাকবে। আমরা হলিউডের নারীরা একেকটা স্বতন্ত্র কণ্ঠ। আমাদের চিন্তাধারা গভীর, আমাদের পরিকল্পনা সুদূরপ্রসারী, বিশ্বাস দৃঢ়। আমাদের সেই সময়ও কথা বলার আর প্রতিবাদ করার শক্তি রাখি, যখন আমাদের দাবিয়ে রাখার চেষ্টা করা হয়।
প্রায় ১০টার মতো জামা বদলের পর প্রচণ্ড খারাপ লাগা নিয়ে যখন আমি ভাবছিলাম যে এসবের পরও দিন শেষে লালগালিচায় আমি কী পরলাম, কীভাবে সাজলাম এগুলোই হবে আলোচনার বিষয়, ঠিক সেই সময়ে আমার চোখে পড়ল আলমারির একপাশে পড়ে থাকা মার্ক জ্যাকবের নকশা করা একটা স্যুটের দিকে। এই পোশাকটা ছেলেদের স্যুটের মতো, তবে ঢিলেঢালা, মেয়েদের জন্য নকশা করা। আমি সেটাই পরলাম কতগুলো উৎসুক চোখের বিস্মিত দৃষ্টি দেখার জন্য। এরপর ‘রিডার্টেতে তোমাকে দারুণ লাগত!’, একজন বললেন। ‘কেলভিন ক্লেইনের রাফ সিমনসে কিন্তু বেশ মানাতো তোমাকে’, এটা বললেন আরেকজন। ‘আচ্ছা ব্র্যান্ডন ম্যাক্সওয়েল বা ডিওরের ব্যাপারে ভেবে দেখেছিলে?’—লালগালিচায় এভাবে একের পর এক প্রশ্ন আমার দিকে তেড়ে আসছিল। তখন আমি কেঁদে ফেললাম। এসব তো নিতান্তই পোশাক! হ্যাঁ, গাউন পরিনি, আমি পরে এসেছি ছেলেদের মতো ঢোলা স্যুট-প্যান্ট। কিন্তু এই স্যুটে আমাকে আজ আমি খুঁজে পেয়েছি। এই ঢিলেঢালা স্যুটে আমি বুঝতে পেরেছি ঠিক ভেতর থেকে আমি কী, কেমন। আর তখনই আমি বুঝতে পেরেছি, আমার ঠিক এই সময়ে কী বলা উচিত, কী প্রকাশ করা উচিত।
আমি আজ আমার সব ক্ষমতা ফেরত চাই। এই বিনোদন জগতেরই প্রভাবশালী একজনের দ্বারা আমি যৌন নির্যাতনের শিকার হয়েছিলাম। এখনো একজন নারী হিসেবে সেই নির্যাতনকারীর নাম বলার মতো সাহস আমার হয়নি। আমি আজও এ কারণে প্রচণ্ড যন্ত্রণায় ভুগি, কোনো শক্তি পাই না, সাহস পাই না। কিন্তু আজ আমি ঠিক করেছি, আর না, আমি আমার হারানো সেই শক্তি ফেরত চাই। তাই আজ আমি ছেলেদের জন্য তৈরি এই উদ্ভট স্যুট-প্যান্ট পরেছি। আমি সবাইকে বোঝাতে চাই যে আমার শক্তি এই পোশাকের চেয়েও অনেক ঊর্ধ্বে।
১৯ বছর বয়সে যৌন নির্যাতনের শিকার হওয়ার পর আমি একেবারে বদল যাই। আমার ভেতরের একটা অংশ মরে যায় সেদিনই। এর কথা আমি কাউকে বলতে পারিনি। আমি সেই বদলে যাওয়াকে সব সময়ই এড়িয়ে গেছি। নিজেকে লজ্জায় কুঁকড়ে রেখেছি। ভেবেছি, দোষটা বুঝি আমারই ছিল। এমনকি আজও অনেক সময় সবার সামনে দাঁড়াতে আমার লজ্জা লাগে। মনে হয়, আমার সঙ্গে যা ঘটেছে, সবই আমার দোষে। এমনও অনেক দিন যায়, যখন নিজেকে অপরাধী ছাড়া আমি আর কিছুই ভাবতে পারি না। এই অনুভূতিগুলো আমি হলিউডের প্রভাবশালী কিছু পুরুষের কাছে অনেকবারই প্রকাশ করেছি, কিন্তু কেউ আমাকে কখনো সাহায্য করেনি। কীভাবে ন্যায়বিচার পেতে পারি আমি, সেই পথ কেউ কখনো আমাকে দেখায়নি। এমনকি আমার বিপর্যস্ত মানসিক অবস্থায়ও কেউ আমাকে চিকিৎসার পরামর্শ দেয়নি। তারা ভয়ে লুকিয়েছিল। ভেবেছিল, আমাকে ন্যায়ের পথ দেখালে হয়তো তাদেরও অনেক গুমর ফাঁস হয়ে যাবে। তারা লুকিয়েছিল, তাই আমিও নিজেকে একটা সময় লুকিয়ে রাখতে শুরু করি।
আমি অনেক দিন নিজেকে দাবিয়ে রেখেছিলাম। তবে একটা সময় যৌন নির্যাতনের মানসিক যন্ত্রণা ও অপরাধবোধ আমার শারীরিক ব্যথা আর অনেক রোগের কারণ হতে শুরু করে। সেই শারীরিক ব্যথা নিয়ে বাধ্য হয়ে আমাকে যেতে হয় চিকিৎসকের কাছে। সেই সময়ই প্রথম জানতে পারি, আমি পিটিএসডি (পোস্ট ট্রমাটিক স্ট্রেস ডিজঅর্ডার) আর ফিব্রোমিয়ালজিয়ায় ভুগছি। এই রোগ তোমার ভেতরের দুশ্চিন্তার ঝড়কে এতই বাড়িয়ে দেয় যে এটা তোমার শরীরের বিভিন্ন অংশে ব্যথার জন্ম দিতে শুরু করে। সেই ব্যথাকে কোনো ভাষা দিয়ে ব্যাখ্যা করা যায় না।
অবসাদ, হতাশা, অনিয়ন্ত্রিত খাদ্যাভ্যাস, মানসিক আঘাত—এসবই সেই দুঃসহ ব্যথার সূত্রপাত ঘটায়। আমি প্রচণ্ড ভাগ্যবান যে আমার সুযোগ ছিল এই ভয়ংকর রোগ শনাক্ত করার। কিন্তু বেশির ভাগ মানুষেরই সেই সুযোগ আর সাধ্য নেই। তাই আমি চাই, মানসিক সুস্বাস্থ্য নিশ্চিত করা পৃথিবীর প্রতিটি দেশের মানুষের মৌলিক চাহিদার তালিকায় উঠে আসুক।
এই সময়ে বিশ্বে প্রতি চারজনে একজন মানসিক রোগে ভুগছে। এর মধ্যে ৩০ কোটি মানুষ ভুগছে অবসাদ ও হতাশায়। ছয় কোটি মানুষ বেঁচে আছে বাইপোলার ডিজঅর্ডার নিয়ে। সিজোফ্রেনিয়ায় ভোগা মানুষের সংখ্যা এখন ২ কোটি ৩০ লাখে পৌঁছেছে। আর প্রতিবছর বিশ্বের ৮ লাখ মানুষ মারা যাচ্ছে আত্মহত্যা করে। নিম্ন ও মধ্যম আয়ের দেশে মানসিক রোগে ভোগা ৭৬ থেকে ৮০ শতাংশ মানুষই কোনো ধরনের চিকিৎসার সুযোগ পায় না। এমনকি ধনী দেশগুলোতেও ৩৫ থেকে ৫০ শতাংশ মানসিক রোগীর এই একই সমস্যা, তারা চিকিৎসার সুযোগ পায় না।
আমার স্বপ্ন, প্রতিটি দেশের প্রতিটি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে একজন করে মনোরোগ বিশেষজ্ঞ শিক্ষক বা থেরাপিস্ট থাকুক।
তাই চলুন আমরা আওয়াজ তুলি। শুধু নারী বা পুরুষ আলাদা করে নয়। মানুষ হিসেবে আমরা একে অপরের হাত ধরে এগিয়ে যাই সমতা আর সুস্থতার দিকে। এই সমতা আর সুস্থতা নারী, পুরুষসহ সব পরিচয়ের সব শ্রেণির মানুষের জন্য।

ইংরেজি থেকে অনুবাদ: আদর রহমান
সূত্র: এল সাময়িকী