কেমন চাই ভবিষ্যতের বাংলাদেশ?

তরুণেরা লিখেছেন বিভিন্ন খাতে ভবিষ্যতের বাংলাদেশ নিয়ে তাঁদের ভাবনা। পড়ুন মূল রচনায়।

ক্রীড়া

বিশ্ববাসী যেন বাংলাদেশের পতাকাটা চেনে
মেহেদী হাসান মিরাজ

মেহেদী হাসান মিরাজ
মেহেদী হাসান মিরাজ

আমি চাই সারা বিশ্বের মানুষ যেন বাংলাদেশের পতাকাটা চেনে। সেটা ক্রিকেট, ফুটবল, ভলিবল, যে খেলা দিয়েই হোক না কেন। যেকোনো খেলায় ভালো করতে হলেই প্রচুর অনুশীলন করতে হয়। গ্রামেগঞ্জে, মফস্বলে কিংবা শহরে ছেলেমেয়েরা যেন সেই সুযোগটা পায়। যেসব এলাকায় মাঠ আছে, সুযোগ-সুবিধা আছে, তারা সৌভাগ্যবান। কিন্তু যেখানে খেলার উপযোগী মাঠ নেই, সেই মাঠগুলো সংস্কার করা খুব গুরুত্বপূর্ণ। সবাই যদি একটু সহযোগিতা করে, তাহলে কিন্তু গ্রামাঞ্চলেও বিভিন্ন ধরনের খেলা আয়োজন করা যেতে পারে।

প্রত্যেক অভিভাবকের উচিত, লেখাপড়ার পাশাপাশি ছেলেমেয়েকে কোনো না কোনো খেলাধুলার সঙ্গে যুক্ত করা। সেটা হতে পারে ক্রিকেট, ফুটবল বা অন্য যেকোনো কিছু। অভিভাবকেরা ভাবেন, খেলাধুলা করলে ভবিষ্যৎ নষ্ট হবে। এটা খুবই ভুল ধারণা। ভবিষ্যতের জন্যই খেলাধুলাটা দরকার। খেলায় সে ক্যারিয়ার করুক বা না করুক, প্রতিদিন এক ঘণ্টা খেলাধুলা করা উচিত। তাহলে সে সুস্থ থাকবে। ভবিষ্যৎ বাংলাদেশের মানুষের মধ্যে যেন এই চেতনা থাকে।

অলরাউন্ডার, বাংলাদেশ জাতীয় ক্রিকেট দল

অর্থনীতি

ধনী আর দরিদ্রের ব্যবধান কমুক

তাহিরা তাজরীন

তাহিরা তাজরীন
তাহিরা তাজরীন

দেশের অর্থনীতি নিয়ে লিখতে বসে ছেলেবেলায় পড়া একটা গল্পের কথা মনে পড়ল। গল্পে পৃথিবীতে বহুদিন বাদে ফিরে আসা এক ভূত আফসোস করে বলছিল, ‘ধনী আরও ধনী হচ্ছে, গরিব হচ্ছে আরও গরিব।’

গবেষণা বলছে, ২০৩০ সালের মধ্যে বাংলাদেশ বিশ্বের ২৬তম শীর্ষ অর্থনীতির দেশ হবে। প্রাত্যহিক জীবনে তার প্রতিফলন হিসেবে আমাদের সবচেয়ে বড় চাওয়া—ধনী আর দরিদ্রের মধ্যে ব্যবধান কমানো। আয়বৈষম্য যত বাড়বে, ততই দুর্বল হয়ে পড়বে আমাদের অর্থনীতি। নীতিনির্ধারকেরা যেন এই বিষয়গুলো মাথায় রেখে জনবান্ধব অর্থ ‘নীতি’ প্রণয়নের দিকে নজর দেন।

আমরা আশা করব, দেশ কিংবা দেশের বাইরে থেকে বাংলাদেশিদের অক্লান্ত পরিশ্রম এই দেশকে বৈশ্বিক অর্থনীতির মূলধারার একটি দেশে পরিণত করবে। সবচেয়ে বড় কথা, বাংলাদেশের সব মানুষ, বিশেষ করে প্রান্তিক পর্যায়ের মানুষ যেন দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নের সুফল অনুভব করতে পারে। সেটা স্বল্পমেয়াদি, দীর্ঘমেয়াদি—উভয় ক্ষেত্রেই।

সাবেক শিক্ষার্থী, অর্থনীতি বিভাগ, এশিয়ান ইউনিভার্সিটি ফর উইমেন

সংস্কৃতি

প্রতিটা সৃষ্টি যেন দেশের সঠিক প্রতিনিধিত্ব করে

প্রীতম হাসান

প্রীতম হাসান
প্রীতম হাসান

দেশের সংস্কৃতি অঙ্গন নিয়ে তেমন কোনো আকাশছোঁয়া প্রত্যাশা নেই। কারণ আমরা খুব ভালো গতিতেই এগোচ্ছি। আমরা চাইলেই যেকোনো লক্ষ্যে পৌঁছানোর ক্ষমতা রাখি। তবে আমাদের ভবিষ্যতে এই ধারায় চলতে হলে আরও ‘প্রফেশনাল’ হতে হবে। যে যেই কাজটা করছি, সেটাকে মন থেকে সততার সঙ্গে করতে হবে। আমি চাই সংস্কৃতি অঙ্গনের প্রত্যেকে একটা স্পষ্ট লক্ষ্য নিয়ে কাজ করুক। শুধু টাকা পাওয়া যাবে বলে না, ভবিষ্যতে চাই সবাই যেন মন থেকে কাজ করুক, মাটিতে পা থাকুক।

সংস্কৃতি অঙ্গন আমি সব ধরনের স্বার্থের হিসাব-নিকাশের ঊর্ধ্বে দেখতে চাই। প্রতিটা সৃষ্টি যেন দেশের সঠিক প্রতিনিধিত্ব করে, সেটা যেই প্ল্যাটফর্মেই হোক না কেন। তাহলে অস্কার বলুন, বা গ্রামি—আমরা ধীরে ধীরে সবখানেই ছাপ ফেলতে পারব। আগে নিজেদের লক্ষ্যটা ঠিক করতে হবে। তাই আপাতত চাই নিকট ভবিষ্যতে দেশের সংস্কৃতি অঙ্গন ও এর মানুষেরা একটা লক্ষ্য ধরে, একটা দায়বদ্ধতা নিয়ে এগিয়ে যাক।

সংগীতশিল্পী

নাগরিক

মানুষ ও আইনের প্রতি শ্রদ্ধাশীল নাগরিকের স্বপ্ন

তাবাস্​সুম ইসলাম

তাবাস্​সুম ইসলাম
তাবাস্​সুম ইসলাম

সিঙ্গাপুরের রাস্তায় প্রথমবার পা রেখে খুব অবাক হয়েছিলাম। লাল বাতি দেখেই গাড়িগুলো সব জেব্রা ক্রসিং ছেড়ে দিয়ে দূরে দাঁড়িয়ে গেল যে! এটাই তো নিয়ম। কিন্তু ধানমন্ডি-মহাখালীর রাস্তায় যাতায়াতে অভ্যস্ত আমি কোনো দিন কোনো গাড়িকে জেব্রা ক্রসিং ছেড়ে দাঁড়াতে দেখেছি বলে মনে করতে পারলাম না। আমরা ছুটে চলায় অভ্যস্ত, এক অদৃশ্য শক্তির সঙ্গে এগিয়ে থাকার যুদ্ধে ব্যস্ত প্রতিদিন। আমরা ওভারব্রিজ ফেলে রাস্তায় নেমে যাই, আমাদের বাইকগুলো ট্রাফিক পুলিশ সামনে এসে না দাঁড়ানো পর্যন্ত সিগন্যালেও আজকাল থামতে চায় না, ডাস্টবিন না খুঁজে রাস্তায় হাতের টিস্যুটা ফেলে দেওয়া আমাদের প্রতিদিনের অভ্যাস।

তাই আজ আমি যখন আমার স্বপ্নের বাংলাদেশের নাগরিক কেমন হবে ভাবি, আমি এমন কিছু মানুষের কথা ভাবি যাঁরা জানেন কখন ছুটতে হবে এবং কোথায় থামতে হবে। শুধু রাস্তায় নয়, সোশ্যাল মিডিয়ায়, কাজের ক্ষেত্রে, প্রতিদিনের জীবনে—প্রতিটি ক্ষেত্রে তারা নিজের সীমাটুকু জেনে সামনে এগোবেন। অতি উৎসাহে অনধিকার চর্চা করে, সহনশীলতার অভাবে ভিন্ন মতের মানুষকে আঘাত করে তাঁরা খবরের শিরোনাম হবেন না। একই সঙ্গে দেশের আইন ও দেশের সব মানুষের প্রতি শ্রদ্ধাশীল যারা, তারাই আমার স্বপ্নের বাংলাদেশের নাগরিক।

শিক্ষার্থী, বিবিএ, ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়

শিক্ষা

একুশ শতকের দক্ষতা চাই

আয়মান সাদিক

আয়মান সাদিক
আয়মান সাদিক

আমাদের শিক্ষাব্যবস্থা এখনো অনেক বেশি প্রতিযোগিতা নির্ভর। কে কতটুকু পড়ে, কে কতখানি মুখস্থ করতে পারে, সেটাই মুখ্য। কিন্তু এখনকার সময়ে আমি একটা আস্ত বই মুখস্থ করে ফেললেও কোনো লাভ নেই, এর মধ্যে কোনো বীরত্বও নেই। বরং ওই বইয়ের তথ্যটা যখন আমার দরকার হবে, আমি কত দ্রুত সেটা খুঁজে বের করতে পারলাম, সেটাই গুরুত্বপূর্ণ।

২০২১ সালের মধ্যে এখনকার শতকরা ৩০ ভাগ চাকরি হারিয়ে যাবে। সেই জায়গা দখল করে নেবে এমন সব নতুন নতুন কর্মক্ষেত্র, যা সম্পর্কে আমরা এখনো জানিই না। সমস্যা সমাধান, তুরীয় চিন্তা (ক্রিটিক্যাল থিঙ্কিং), দলের সঙ্গে কাজ করা ও পরস্পর সহযোগিতার মানসিকতা, সৃজনশীলতা ও কল্পনা—এই চারটিকে বলা হয় একুশ শতকের দক্ষতা। এই দক্ষতা যদি আমরা অর্জন করতে পারি, তাহলে আমরা এগিয়ে থাকতে পারব। এসব দক্ষতা স্কুলে আমাদের শেখাবে না। তো কী হয়েছে? পৃথিবীর সবচেয়ে বড় পাঠশালা আমার হাতের কাছে আছে—সেট হলো ইন্টারনেট। ইন্টারনেট কীভাবে ব্যবহার করতে হয়, সেটা যেন আমি জানি।

প্রতিষ্ঠাতা ও প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা, টেন মিনিট স্কুল

স্বাস্থ্য

প্রতিটি হাসপাতাল হবে স্বয়ংসম্পূর্ণ

প্রাপ্তি অম্লান

প্রাপ্তি অম্লান
প্রাপ্তি অম্লান

বাংলাদেশের বর্তমান প্রেক্ষাপট দেখে মনে হয়, সবচেয়ে জরুরি হলো চিকিৎসক ও রোগীর সম্পর্কের উন্নয়ন করা, যা আমাদের ফরেনসিক মেডিসিন বিষয়ের অন্তর্ভুক্ত একটি পাঠ্য। ভবিষ্যৎ বাংলাদেশের উন্নত চিকিৎসাব্যবস্থায় এই পুঁথিগত বিষয়টাই কাজে লাগানো সবচেয়ে বেশি দরকার। ভবিষ্যতের চিকিৎসাব্যবস্থা উন্নত হবে কি না, সেটা অনেকখানি নির্ভর করে হাসপাতালের আসনসংখ্যার ওপর। দেশের প্রতিটা হাসপাতাল চিকিৎসাসেবা দেওয়ার ব্যাপারে যেন স্বয়ংসম্পূর্ণ হয়, সব ধরনের না হোক, প্রধান অস্ত্রোপচারের সুবিধা যেন থাকে। তাহলে বিভাগীয় হাসপাতালেই দেশের সব রোগীর সেবা দেওয়ার চাপ থাকবে না।

কীভাবে সম্ভব হবে জানি না, তবু আমি স্বপ্ন দেখি, ওষুধের দাম মানুষের হাতের নাগালের মধ্যে আসবে। দুরারোগ্য অসুখের চিকিৎসাও হবে আমাদের দেশেই। চিকিৎসাসেবা পেতে আর মানুষকে দেশের বাইরে ছুটতে হবে না। আমার বিশ্বাস, এই স্বপ্নগুলো একদিন ঠিকই পূর্ণ হবে। শুধু প্রয়োজন চিকিৎসক ও দেশের মানুষের একে অপরের প্রতি বিশ্বাস, ভালোবাসা আর দোয়া।

শিক্ষার্থী, পঞ্চম বর্ষ, ঢাকা মেডিকেল কলেজ

গবেষণা

নিজেদের প্রয়োজনে নিজেদের গবেষণা

তুরাস হক

তুরাস হক
তুরাস হক

আমরা যেসব গবেষণার বিষয় বেছে নিই, যেসব তথ্য ব্যবহার করি, বেশির ভাগই বিদেশ থেকে পাওয়া। আমি চাই ভবিষ্যতে বাংলাদেশের তরুণেরা যেন নিজেদের উন্নয়নের জন্য আরও বেশি গবেষণায় মনোযোগী হন। যেমন আমাদের দেশে অনেকগুলো নদী আছে। এই নদীগুলো আমরা কীভাবে দেশের উন্নয়নে কাজে লাগাতে পারি? এটাও একটা গবেষণার বিষয় হতে পারে।

শিক্ষকদের সঙ্গে গবেষণা সহকারী হিসেবে কাজ করে যদি আয় করার সুযোগ থাকত, তাহলে হয়তো অনেক ছেলেমেয়ে টিউশনির পেছনে সময় না দিয়ে গবেষণাতেই আগ্রহী হতেন। আমাদের তেমন কোনো উন্নত গবেষণাগার নেই। যদি গবেষণাগার তৈরি করতে না-ও পারি, বাইরের দেশের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর সঙ্গে আমাদের একটা সমন্বয় করা যেতে পারে। যেন আমরা একযোগে কাজ করতে পারি।

বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক ছাত্র। বর্তমানে পিএইচডি শিক্ষার্থী, ইউনিভার্সিটি অব ম্যারিল্যান্ড, কলেজ পার্ক

গ্রামীণ সমাজ

কুসংস্কার, নারী সহিংসতা, হানাহানিমুক্ত গ্রাম

সানজিদা আলম

সানজিদা আলম
সানজিদা আলম

আমাদের গ্রামীণ অর্থনীতিতে এখন অনেক কিছু বদলেছে। ছেলেমেয়েরা স্কুলে যায়। হাতে হাতে এসেছে প্রযুক্তির ছোঁয়া। কিন্তু কুসংস্কার, নারী সহিংসতা, যৌতুক, বাল্যবিবাহ, সুশিক্ষার অভাব, অপরিকল্পিত পরিবার, মহাজন প্রথা, অস্বাস্থ্যকর জীবনধারা এখনো গ্রামবাংলাকে আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে ধরে আছে।

স্বপ্ন দেখি এমন গ্রামীণ সমাজের, যেখানে থাকবে না নারী সহিংসতা, যেখানে জনমত গড়ে উঠবে বাল্যবিবাহের বিপক্ষে। কুসংস্কার এবং সংকীর্ণতার বেড়াজাল থেকে মুক্ত হয়ে সবাই সুস্থ-স্বাভাবিক চিন্তা করবে। যথাযথ পরিকল্পনা এবং স্বাস্থ্যব্যবস্থা সম্পর্কে সচেতন হবে। প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত কৃষকেরা বিজ্ঞানসম্মত উপায়ে উৎপাদন করে অর্থনীতিকে সচল করবেন। ছবির মতো সুন্দর গ্রামের মানুষগুলোর মনমানসিকতা আরও সুন্দর হয়ে উঠবে। গ্রাম্য রাজনীতি, ধর্মীয় গোঁড়ামি কিংবা গুজবের কারণে হবে না আর কোনো হানাহানি। আর আমি মনে করি এই পরিবর্তনের প্রধান কারিগর হতে পারি আমরা তরুণেরা।

শিক্ষার্থী, মার্কেটিং বিভাগ, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়