'বীর পালোয়ান' বিল্লাল

৩৪তম জাতীয় পুরুষ কুস্তি প্রতিযোগিতার প্রথম পর্বে লড়ছেন কুস্তিগির বিল্লাল হোসেন (লাল জার্সি)। ছবি: তানভীর আহম্মেদ
৩৪তম জাতীয় পুরুষ কুস্তি প্রতিযোগিতার প্রথম পর্বে লড়ছেন কুস্তিগির বিল্লাল হোসেন (লাল জার্সি)। ছবি: তানভীর আহম্মেদ

‘খেলার ছলে ষষ্ঠীচরণ, হাতি লোফেন যখন তখন/ দেহের ওজন উনিশটি মন, শক্ত যেন লোহার গঠন’।

সুকুমার রায়ের ‘পালোয়ান’ ছড়াটি কখনো পড়া হয়নি বিল্লাল হোসেনের। কিন্তু ষষ্ঠীচরণের মতোই এলাকায় পালোয়ান খ্যাতি পেয়ে গেছেন বিল্লাল। বন্ধুরা প্রায়ই কুস্তি লড়ার প্রস্তাব দেয়। লোকে দেখলেই দূর থেকে বলে, ‘ওই যে পালোয়ান আসছে!’

ঘরোয়া কুস্তিতে ১৫ বছর ধরে নিজের ওজন শ্রেণিতে শ্রেষ্ঠত্ব ধরে রেখেছেন বিল্লাল। বয়স ছুঁয়েছে ৪০। এই বয়সে খেলা ছেড়ে অবসরে যাওয়ার কথা বিল্লালের। কিন্তু বয়সকে বুড়ো আঙুল দেখিয়ে দিব্যি কুস্তি লড়ে চলেছেন। এই তো ১০ জানুয়ারি রাজধানীর পল্টনে শেখ কামাল রোলার স্কেটিং কমপ্লেক্সে শেষ হওয়া ৩৪তম জাতীয় পুরুষ কুস্তিতে ৯৭ কেজিতে জিতেছেন সোনা। অবাক করা ব্যাপার, এ পর্যন্ত ১১ বার অংশ নিয়েছেন জাতীয় চ্যাম্পিয়নশিপে। প্রতিটি আসরেই হয়েছেন চ্যাম্পিয়ন। জাতীয় কুস্তিতে কখনোই যে তাঁকে হারাতে পারেনি কেউ!

অথচ কুস্তি নামে যে একটা খেলা আছে, সেটা ছোটবেলায় শুধু একবার শুনেছিলেন। স্কুল-কলেজে ফুটবল খেলতেন। সপ্তম শ্রেণিতে পড়ার সময় মুন্সিগঞ্জের শ্রীনগরে নিজের বাড়ির পাশে মাটির ওপর কুস্তি খেলতে দেখেছিলেন। কিন্তু নিজে কুস্তিগির হবেন, দেশ–বিদেশে খেলতে যাবেন, সেটা কখনোই ভাবেননি। জাতীয় দলের অন্যতম বড় ভরসাও এই বিল্লাল। খেলতে খেলতে ২০১২ সালে পাকিস্তানে কায়েদে আজম আন্তর্জাতিক কুস্তিতে জিতেছেন রুপা। ২০১৫ গুয়াংজু এশিয়ান কুস্তি চ্যাম্পিয়নশিপে উন্মুক্ত বিভাগে ব্রোঞ্জ। ব্রোঞ্জ জিতেছেন কলম্বো, ঢাকা ও গুয়াহাটি দক্ষিণ এশিয়ান গেমস।

 জুডো থেকে কুস্তি

একেবারে ঘটনাচক্রে কুস্তিগির হওয়া বিল্লালের। সেই গল্পটা বলছিলেন বর্ডার গার্ড বাংলাদেশের (বিজিবি) এই কুস্তিগির, ‘১৯৯৭ সালে তৎকালীন বিডিআরে যোগ দিই। কিন্তু কুস্তি খেলব কখনো সেটা ভাবিনি। আমি শুরুতে জুডো খেলতাম। একদিন কুস্তির অনুশীলন দেখার সময় ইউনিটের সিনিয়র জালাল ভাইকে বলি, আমি খেলব। এরপর মেজর মইন স্যার অনুমতি দিলেন। কুস্তির হাতেখড়ি হলো তখন থেকে।’

কিন্তু চাইলেই তো জাতীয় পর্যায়ে খেলা যাবে না। সেরা কুস্তিগির হতে তাই টানা অনুশীলন করেছেন পাঁচ বছর। জাতীয় প্রতিযোগিতার নিয়ম অনুসারে প্রতিটি সংস্থা থেকে একটি ওজন শ্রেণিতে একজন খেলার সুযোগ পান। কিন্তু ওই নির্দিষ্ট সংস্থায় সেই ওজন শ্রেণিতে অনুশীলন করেন একাধিক কুস্তিগির। প্রতিবছর জাতীয় চ্যাম্পিয়নশিপের আগে বাছাইয়ে তাই সবাইকে পেছনে ফেলে প্রথম হয়ে আসছেন বিল্লাল। আর বিজিবির বাছাইয়ে প্রথম হওয়া বিল্লাল দলকেও এনে দেন সোনার পদক।

এই বয়সেও কুস্তি খেলতে পেরে ভীষণ খুশি বিল্লাল, ‘নিজেকে দেশের সেরা কুস্তিগির ভাবতে খুব ভালো লাগে। এই বয়সে যে এখনো চ্যাম্পিয়ন পদক ধরে রেখেছি, সেটা ভেবে গর্ববোধ করি।’

পাড়া–মহল্লার আখড়ায় আর আন্তর্জাতিক কুস্তিতে বিস্তর ফারাক। কোনো প্যাঁচ দিয়ে নয়, বিভিন্ন কৌশলের ওপর পয়েন্ট পান কুস্তিগিররা। টানা কুস্তি জিততে থাকায় ফেডারেশনের পৃষ্ঠপোষক প্রতিষ্ঠান ওয়ালটন ২০১৬ সালে বিল্লালকে দিয়েছিল বীর পালোয়ান খেতাব।

 তবু পালোয়ান

কবিতার ষষ্ঠীচরণের মতো সকালবেলার ‘জলপানি’ হিসেবে তিন ধামা পেস্তা মেওয়া পান না। দুপুরেও কাতার দিয়ে ডেকচি ভরে খাবার আসে না বিল্লালের জন্য। অথচ কুস্তিগিরদের খাওয়াটাই আসল। খাবারদাবার নিয়ে নিজের দুঃখের কথা বলছিলেন বিল্লাল, ‘আমাদের জন্য সরকারের খাবারের বাজেট খুব কম। যেটা দেওয়ার কথা সেই তুলনায় খুব কম পাই।’ দুধ, মধু, ঘি, আখরোট, পেস্তা বাদাম দিয়ে একধরনের পুষ্টিকর হালুয়া দেওয়া হয় কুস্তিগিরদের। কিন্তু সেটাও অনিয়মিত। কুস্তি খেলে ভবিষ্যৎ নেই। তাই হতাশায়, অভিমানে ক্যারিয়ারটা আর লম্বা করতে চান না, ‘যখন খেলা সামনে আসে তখন সবাই পদকের জন্য পাগল হয়ে যায়। কিন্তু পর্যাপ্ত ট্রেনিংই দেওয়া হয় না আমাদের। নেই কোনো সুযোগ–সুবিধা। তাই আর বেশি দিন খেলতে চাই না।’

বিল্লাল হোসেন
বিল্লাল হোসেন

কুস্তিগির হয়েও পরিবারের কাছে নিজের পরিচয়টা লুকোতে চাইতেন বিল্লাল, ‘শুরুর দিকে আমার স্ত্রী জানত না যে আমি খেলি। সবাই জানে আমি চাকরি করি। কিন্তু প্রথম যেবার চীনে একটা আন্তর্জাতিক প্রতিযোগিতায় খেলতে যাই, তখন সবাই বুঝতে পারে। এখন সবাই আমাকে উৎসাহ জোগায়।’
এসএ গেমসের বাইরে কখনো পদক জেতা হয়নি। কিন্তু স্বপ্ন দেখেন অলিম্পিকে পদক জেতার, ‘বিজয় মঞ্চে দেশের পতাকা ওড়াতে চাই। অলিম্পিকে খেলে পদক আনতে চাই।’

ভারত, পাকিস্তান, শ্রীলঙ্কার তুলনায় দিন দিন কুস্তি পিছিয়ে পড়ছে। এ জন্য হতাশ হয়ে পড়েন মাঝেমধ্যেই। এক ছেলে ও এক মেয়ে বিল্লালের। কিন্তু কাউকে খেলার জগতে আনতে চান না। এ পর্যন্ত যতগুলো পদক জিতেছেন, সেগুলো নাকি বাড়িতে নিয়েই যান না, ‘আমার কাছে মাত্র ২টা মেডেল আছে! এই খেলায় ভবিষ্যৎ নেই, তাই বাকিগুলো ফেলে দিই বা কাউকে দিয়ে দিই। এবারও চ্যাম্পিয়ন হওয়ার পর মেডেলটা এক জুনিয়রকে উপহার দিয়েছি। বলেছি, তুই আমার মতো কুস্তি খেলবি ভবিষ্যতে।’

গভীর রাতে আকাশের দিকে চেয়ে মাঝেমধ্যেই বিল্লাল ভাবেন, ‘বিদেশের বিজয় মঞ্চে বাজছে জাতীয় সংগীত। গলায় সোনার পদক। অন্তত এসএ গেমসেও যদি সোনা জিতে অবসরে যেতে পারি, তাতেও পালোয়ান নামের সার্থকতা হতো।’