ইসাবেলের বাংলাদেশ

ইসাবেল আঁতুনেস। ছবি: খালেদ সরকার
ইসাবেল আঁতুনেস। ছবি: খালেদ সরকার

ইসাবেল আঁতুনেসের সঙ্গে কথা বলা শুরু করলে প্রথমে তাঁকে পাগল মনে হবে। বাংলাদেশে এসে এ দেশ নিয়ে তথ্যচিত্র বানাচ্ছেন তিনি। সত্যিকার বাংলাদেশ বলতে তিনি ইতিবাচক বাংলাদেশকেই বোঝেন।

বলা নেই, কওয়া নেই ২০১১ সালের জানুয়ারিতে বাক্স-পেটরায় যৎকিঞ্চিৎ জামাকাপড় ভরে বেলজিয়াম থেকে বাংলাদেশে চলে এসেছিলেন তিনি, এক মাসের জন্য। এরপর থেকেই বাংলাদেশপ্রীতি। যাওয়া আর আসা। মধ্যে একটি জলজ্যান্ত তথ্যচিত্রও বানিয়ে ফেলেছেন ২০১৫ সালে। হ্যাপি রেইন তার নাম। সেই ছবি বেশ কিছু পুরস্কারও পেয়েছে। তাই এ দেশ নিয়ে আরও কিছু কাজ করার ইচ্ছা হয়েছে ইসাবেলের।

‘কেন বাংলাদেশে বারবার ফিরে আসেন, ইসাবেল?’ এ প্রশ্ন করতেই হয়।

‘এ দেশের মানুষের সরল মনের কারণে, এ দেশের মানুষের মনে গান আছে বলে। আর হ্যাঁ, এ দেশের রং আমাকে মুগ্ধ করে।’

বাংলাদেশের রং? বাংলাদেশের মন? একটু থমকে দাঁড়াতে হয়। এ দেশটাকে তো আমরা এভাবে দেখি না কখনো!

ইসাবেলের কথায় পরিষ্কার হয়, তিনি একজন নিবিড় পর্যবেক্ষক। ‘একজন রিকশাচালক থেকে শুরু করে উচ্চপদস্থ কর্মকর্তা—সবাই এ দেশে গান গেয়ে থাকেন। গান জানেন। একের পর এক গান শুনিয়ে দিতে পারবে এরা।’

‘গানের টানেই কি এ দেশে আসা?’

প্রশ্ন শুনে ইসাবেলের হাসি আর থামে না। ‘আমি বাংলাদেশ নিয়ে কিছুই জানতাম না। শুধু ওই পশ্চিমা মিডিয়ায় তোমাদের নিয়ে যেসব অপপ্রচার হয়, সেগুলোই শুনেছি। এ দেশে আসব, তা ভাবিনি আগে। উন্নয়ন নিয়ে কাজ করি। ইন্দোনেশিয়া, আফ্রিকার দুটি দেশে কাজ করেছি। এরপর অল্প সময়ের জন্য পাকিস্তানে গিয়েছিলাম কাজে। সেখানেই কয়েকজন বললেন, উন্নয়ন কাকে বলে তা যদি দেখতে চাও, চলে যাও বাংলাদেশে। দারুণ দারুণ সব কাজ হচ্ছে সেখানে। যাঁরা বললেন, তাঁদের সবাই বাংলাদেশ ঘুরে গেছেন, ফিরে গেছেন ইতিবাচক অভিজ্ঞতা নিয়ে। তাঁদেরই একজন, মৎস্য ও পানিবিশেষজ্ঞ মোহাম্মদ আলম বলেছিলেন, এনজিও, মৎস্য চাষ ও ক্ষুদ্রঋণ প্রকল্পে কী কাণ্ডটাই না ঘটাচ্ছে বাংলাদেশ, গিয়ে দেখে আসতে পারো।’

স্বল্প সময় পাকিস্তানে থাকার পর বেলজিয়ামে গেলেন ইসাবেল। এরপর এক রাতের সিদ্ধান্তেই সেখান থেকে রওনা দিলেন বাংলাদেশে উদ্দেশে। সে সময় তিনি বাংলাদেশের কোনো মানুষকে চেনেন না, বাংলা ভাষার সঙ্গে একেবারেই পরিচয় নেই।

বিচিত্র পরিবারটি

ফ্রান্সের কান শহরে জন্ম ইসাবেলের। আমরা অনেক বহুজাতিক কোম্পানির কথা শুনেছি। ইসাবেল হলেন বহুজাতিক পরিবারের সদস্য। তাঁর বাবা হাফ স্প্যানিশ, হাফ পর্তুগিজ। মায়ের দিকটায়ও একই গল্প। হাফ ফরাসি, হাফ চেক। ফ্রান্সের নাগরিক তিনি। বাবা ১৩ বছর বয়সে মরক্কো থেকে অভিবাসন নিয়ে চলে এসেছিলেন। এরপর পরিবারটি চলে যায় অস্ট্রেলিয়ায়। ফলে ইসাবেল ফ্রান্স আর অস্ট্রেলিয়া—দুই দেশেরই নাগরিক। বহুজাতিক উত্তরাধিকার থাকাতেই ইসাবেলের অন্য দেশের প্রতি এই আকর্ষণ কি না, কে জানে। ওকে যে একটু আগেই ‘পাগল’ তকমা দেওয়া হয়েছিল, তা একটু পরিবর্তিত হবে। ইসাবেল পাগল, তবে সে পাগলামো মানুষের জীবনের ইতিবাচক দিকটি খুঁজে নেওয়ার পাগলামো।

প্যারিসের সরবন বিশ্ববিদ্যালয় থেকে সাংস্কৃতিক ভূগোল ও উন্নয়ন বিষয়ে পিএইচডিধারী ইসাবেল আঁতুনেস আফ্রিকা ও এশিয়া প্যাসিফিক অঞ্চলে উন্নয়ন বিষয়ে বিশেষজ্ঞ হিসেবে কাজ করেছেন।

আগের গল্প আরেকটু

নেমে তো পড়লেন হজরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে। এবার কী করবেন? মোহাম্মদ আলমের কাছ থেকে নম্বর নিয়ে সেলিম ইসাকে ফোন করলেন ইসাবেল। তিন–চারজনের ফোন নম্বর নিয়ে এসেছিলেন তিনি। সেলিম ইসা, বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ওয়াহাব ছিলেন তাঁদের মধ্যে।

ইসাবেল গল্পের খোঁজে ঘুরে বেড়ালেন ময়মনসিংহ, বগুড়া, যশোর। স্থিত হলেন দাউদকান্দিতে। একটি এনজিওতে খোঁজ নিয়ে জানলেন বন্যার পানি ধরে রেখে হাজার একর জমিতে কীভাবে মাছ চাষ করা হচ্ছে। তথ্যচিত্রের জন্য এই গল্পকেই নির্বাচন করলেন ইসাবেল।

ইসাবেল একটু অতীতে ফিরে গিয়ে বললেন, ‘আমি উন্নয়নের একটা সূত্র খুঁজে পেয়েছি। সম্পদ ও অর্থনীতি যদি মানুষের সেবায় নিয়োজিত থাকে, তবে তাকে বলে উন্নয়ন। মানুষ যদি সম্পদ আর অর্থনীতির সেবায় নিয়োজিত হয়, তাহলে সেটা উন্নয়ন নয়।’

মাত্র দুটি বাক্যে অনেক কথাই বলে দিলেন ইসাবেল।

 হ্যাপি রেইন ও অতঃপর

কুমিল্লার দাউদকান্দির কৃষকদের মৎস্য উৎপাদনের মধ্যেই একটা গল্প লুকিয়ে ছিল। পুরো এলাকার মানুষের সম্মিলিত পরিশ্রমে গড়ে উঠল যে জলাধার, তা আসলে কেবল বন্যার পানি আটকে রাখার কারণেই সৃষ্টি হয়েছে। পানি নেমে গেলে সেখানে শুরু হবে ফসলের চাষ। সবাই সবার সর্বস্ব দিয়ে দিয়েছেন, কারণ মাছ চাষে আয় হয়। কিন্তু এখানেও ঘটে বিপত্তি। বেশি বেশি মাছ উৎপাদন হলে দাম যে পড়ে যাবে, সে কথা তো জানা ছিল না মৎস্যজীবীদের। জীবনের অভিজ্ঞতাতেই তাঁরা পুঁথিগত বিদ্যার বাইরে থেকেই জীবনকে বুঝতে শেখেন।

‘এই দেশটা ঘুরতে ঘুরতে আমি উপলব্ধি করেছি, বাংলাদেশ নিয়ে বাইরে যা বলা হয়, তা খুবই বাহ্যিক একটা ব্যাপার। এখানকার শক্তি, এখানকার মানবতা, এখানকার কাব্যিক জীবন—এগুলো এড়িয়ে যায় পশ্চিমা মিডিয়া। আর এখন বলতে পারি, আপনাদের মিডিয়াও। আমি লক্ষ করেছি, বাংলাদেশ নিয়ে যে স্থিরচিত্রের প্রদর্শনী হয়, তাতেও দারিদ্র্য বিক্রি করা হয়। বাংলাদেশের মূল সুর হলো এর সুখী মানুষ, সুখী জীবন; সেটাকে অগ্রাহ্য করে ইচ্ছাকৃতভাবে শুধু দারিদ্র্যটাই দেখানো হয়।

প্রথম ভ্রমণের শেষদিকে সাবেক পররাষ্ট্র সচিব ফারুক সোবহানের সঙ্গে দেখা হয় ইসাবেলের। তিনি ড. রিফাত রশীদের সঙ্গে ইসাবেলের পরিচয় করিয়ে দেন। রিফাত রশীদ ছিলেন ফ্রেঞ্চ বাংলাদেশ চেম্বার অব কমার্সের পরিচালক। তিনিও সোরবোর্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের পিএইচডি। রিফাতের আতিথেয়তায় মুগ্ধ হলেন ইসাবেল। এখন পর্যন্ত যতবার বাংলাদেশে এসেছেন, ইসাবেলের দেখভালের দায়িত্ব নিয়েছেন রিফাত। হ্যাপি রেইন ছবিটি করতে লেগেছে চার বছর। রিফাতের সহযোগিতা না থাকলে সেটা করা হতো দুরূহ।

 হাইটিউনস বাংলাদেশ ডিএনএ

মানুষের স্বপ্ন আর ইতিবাচক মানসিকতার জয়গান করার জন্যই ইসাবেল তৈরি করছেন তাঁর পরের ছবি হাইটিউনস বাংলাদেশ ডিএনএ। গত বছরেই শুরু করেছেন শুটিং। এই ছবির মূল চরিত্র তিনজন। স্থপতি রফিক আজম, সংগীতশিল্পী ঐশী আর একনিষ্ঠ লালনভক্ত ইলিয়াস। তাঁরা তিন জায়গার মানুষ, তবে মিল একটি জায়গায়—তাঁরা আধুনিক এবং সাহসী মানুষ।

রফিক আজম পরিবেশবান্ধব সুন্দর পার্ক তৈরি করার প্রকল্পে যুক্ত হয়েছেন। মেডিকেল-পড়ুয়া ঐশী ভালোবাসেন লোকসংগীত। ইলিয়াস মানুষের মধ্যে মানবতা–সন্ধানী। ছবিটি হবে ক্রাউড ফান্ডিংয়ের মাধ্যমে।

ঢাকায় শিশুদের সঙ্গে ইসাবেল আঁতুনেস
ঢাকায় শিশুদের সঙ্গে ইসাবেল আঁতুনেস

‘আমাদের নতুন ধারণার জন্য বিশ্বের হাজারো মানুষের প্রতীকী অনুদান খুঁজছি আমরা, যাঁরা বিশ্বাস করেন ভালো গল্পগুলোই আমাদের মধ্যে সেতুবন্ধ তৈরি করে। আমরা ওয়েবসাইট করেছি। ১০ টাকা থেকে ১ হাজার টাকা দিয়ে যে কেউ আমাদের ছবিকে সাহায্য করতে পারে। ক্রাউড ফান্ডের আরেক গুরুত্বপূর্ণ দিক হলো, এটি টিভি চ্যানেল ও চলচ্চিত্রকে প্রভাবিত করবে। বোঝানো যাবে, মানবতার অনুপ্রেরণামূলক গল্পনির্ভর চলচ্চিত্রেরও সত্যিকারের চাহিদা আছে।’ বললেন ইসাবেল।

নতুন জীবনের শুরু

ইসাবেল এখন তাঁর ছবি নিয়ে ব্যস্ত। ছবিতে থাকবে চারটা গল্প। তিনজন মানুষ আর পুরান ঢাকার রসুলবাগ কমিউনিটি নিয়ে গল্পগুলো। এরই মধ্যে কিছুটা শুটিং হয়েছে। রসুলবাগ পার্কের সৌন্দর্যবর্ধন হবে, হবে ওসমানী পার্কের। ছবির শেষ দৃশ্যটা হবে এমন—ওসমানী উদ্যানের পুকুরপাড়ে একতারা হাতে গাইছে ইলিয়াস। পরিবার নিয়ে সেখানে আসে ঐশী। ঐশীও গাইতে থাকে গান। পরিবেশ–প্রকৃতি এবং মানুষের গানে শান্তি নেমে আসে। আর সেভাবেই ছবির শেষ এবং নতুন জীবনের শুরু।