ঘরে তাঁদের কথা হয় ইশারায়

রাজধানীর গেন্ডারিয়ার বাসার তিন সদস্য শাহ বাবুল আহমেদ, নাজমা বেগম ও তাঁদের মেয়ে বদরুন নাহার তমা। বিছানায় বসে নিজেদের মধ্যে অনেক গল্প করছেন। কিন্তু টুকটাক আওয়াজ ছাড়া আর কোনো শব্দ শোনা যাচ্ছে না। কেননা, তাঁরা ইশারা ভাষায় কথা বলছেন।

শাহ বাবুল আহমেদ আর তাঁর স্ত্রী নাজমা বেগম কানে শোনেন না এবং কথা বলতে পারেন না। তবে তাঁদের মেয়ে এবং ছেলে শাহ তানভীর আহমেদ কথা বলতে পারেন। মা-বাবার সঙ্গে এই দুই ভাইবোনের সব যোগাযোগ হয় ইশারা ভাষায়। দূরে থাকলে কথা হয় মুঠোফোনের ভিডিও কলে।

বাসার কল বেলটি একটু অন্য রকম করে বানানো। কল বেল বাজার সঙ্গে সঙ্গে রান্নাঘর এবং নাজমা বেগমের বেডরুমে একটি লাইট একবার নিভে আরেকবার জ্বলতে থাকে। তা-ই দেখে বুঝে নেন, দরজায় কেউ এসেছেন।

পরিবারটি নিজেদের মতো করে যোগাযোগের সব কৌশল রপ্ত করে ফেলেছে। ফলে, তেমন কোনো সমস্যা হচ্ছে না। বাবুল আহমেদ ও তাঁর স্ত্রী বাইরে গেলে ছেলে বা মেয়ে সঙ্গে থাকলে কোনো সমস্যা নেই। কিন্তু যখন তাঁরা একা কোথাও যাচ্ছেন, তখনই নানা প্রতিবন্ধকতার সম্মুখীন হচ্ছেন। কেননা, সমাজের অন্যরা এ ভাষা বুঝতে পারে না। এই দম্পতিও তাঁদের কথা অন্যদের বুঝিয়ে বলতে পারেন না।

শুধু এই দম্পতি নন, বেসরকারি সংগঠনের হিসাবে দেশের প্রায় ৩০ লাখ শ্রবণ ও বাক্‌প্রতিবন্ধী ব্যক্তি ও পরিবারের সদস্যদের সমস্যা এটি। এখন পর্যন্ত সরকারের কাছে সুনির্দিষ্টভাবে এই জনগোষ্ঠীর কোনো হিসাব নেই।

শাহ বাবুল আহমেদ ও নাজমা বেগমের মেয়ে বদরুন নাহারকে ইশারা ভাষা শিখতে খুব একটা বেগ পেতে হয়নি। বাবা-মায়ের সঙ্গে যোগাযোগের জন্য নিজের তাগিদেই ছোটবেলায় ভাষাটি রপ্ত করেন। বর্তমানে বেসরকারি টেলিভিশন দেশটিভিতে ইশারা ভাষায় দোভাষীর দায়িত্ব পালন করছেন তিনি। এনজিও পরিচালিত বিভিন্ন অনুষ্ঠানেও দোভাষীর দায়িত্ব পালনের ডাক পড়ে। মেয়ের সাহায্যেই কথা হলো বাবুল আহমেদ ও তাঁর স্ত্রীর সঙ্গে। ৭ ফেব্রুয়ারি সমাজকল্যাণ মন্ত্রণালয়ের অধীনে দেশে পালিত হবে বাংলা ইশারা ভাষা দিবস। এ দিবসকে সামনে রেখেই কথা হয় পরিবারটির সঙ্গে।

শাহ বাবুল আহমেদ আর তাঁর স্ত্রী নাজমা বেগম কানে শোনেন না, কথা বলতে পারেন না। ছবি: সাবরিনা ইয়াসমীন
শাহ বাবুল আহমেদ আর তাঁর স্ত্রী নাজমা বেগম কানে শোনেন না, কথা বলতে পারেন না। ছবি: সাবরিনা ইয়াসমীন

প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ২০০৯ সালের ১ ফেব্রুয়ারি অমর একুশে গ্রন্থমেলার উদ্বোধনী বক্তব্যে মৌখিকভাবে এ ভাষার স্বীকৃতি দেন। সমাজকল্যাণ মন্ত্রণালয় ২০০৯ সালের ২৭ জানুয়ারি প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়সহ সরকারের বিভিন্ন কর্তৃপক্ষের কাছে পাঠানো এক চিঠিতে উল্লেখ করে, সরকার শ্রবণ ও বাক্‌প্রতিবন্ধী জনগোষ্ঠীর ‘ভাষাগত পরিচয়কে সমুন্নত করার লক্ষ্যে’ ইশারা ভাষাকে স্বীকৃতি দেওয়া এবং সে বছরের ১ ফেব্রুয়ারি থেকে তা চালু করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। একই দিনে বাংলাদেশ টেলিভিশন (বিটিভি) ও বেসরকারি স্যাটেলাইট চ্যানেলগুলোকে এ ভাষা ব্যবহারের নির্দেশ দিয়ে চিঠি পাঠায় মন্ত্রণালয়। আন্তমন্ত্রণালয় সভার সিদ্ধান্ত অনুযায়ী ২০১২ সাল থেকে দেশে দিবসটি পালিত হচ্ছে।

শাহ বাবুল আহমেদ দ্বিতীয় শ্রেণিতে পড়া পর্যন্ত কথা বলতে পারতেন। তারপর টাইফয়েড জ্বরে কথা বলা ও কানে শোনা বন্ধ হয়ে যায়। নাজমা বেগম জন্মের পর কখনোই কথা বলতে পারেননি। বাবুল আহমেদ ঢাকা বিভাগ এবং নাজমা বেগম ময়মনসিংহ বিভাগের অ্যাথলেট ছিলেন। খেলার সূত্রেই তাঁদের পরিচয়। তারপর পারিবারিক সিদ্ধান্তেই বিয়ে হয় তাঁদের। কথা বলার ফাঁকে বাবুল আহমেদ গর্বের সঙ্গে জানিয়ে দিলেন, ১৯৭৫ সালে জাপানে অনুষ্ঠিত অলিম্পিক গেমসে অ্যাথলেট হিসেবে তিনি দেশের জন্য স্বর্ণপদক এনেছেন। কালচে হয়ে যাওয়া সেই সময়ের মেডেলটি দেখালেন তিনি। তবে ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেন, দেশে ফেরার পর রাষ্ট্রীয়ভাবে তাঁর এ অর্জনের জন্য কোনো শুভেচ্ছা জানানো হয়নি। শুধু বিভিন্ন সংগঠনের পক্ষ থেকে সংবর্ধনা দেওয়া হয়। আরেকটি ক্ষোভের কারণ, তাঁর এ অর্জনের কথা তরুণ শ্রবণ ও বাক্‌প্রতিবন্ধী ব্যক্তিরা জানে না বা জানানোর কোনো ব্যবস্থাও করা হয়নি।

মা-বাবার সঙ্গে ইশারা ভাষায় কথা বলছেন মেয়ে বদরুন নাহার তমা। ছবি: সাবরিনা ইয়াসমীন
মা-বাবার সঙ্গে ইশারা ভাষায় কথা বলছেন মেয়ে বদরুন নাহার তমা। ছবি: সাবরিনা ইয়াসমীন

নাজমা বেগম স্বর্ণপদক পাননি, তবে তাঁর জয়ের খবর বিভিন্ন জাতীয় দৈনিকে ছাপা হয়েছে। বিভিন্ন সংগঠনের পক্ষ থেকে ক্রেস্ট পেয়েছেন। যত্ন করে রাখা সেসব স্মৃতি বের করে দেখান এ দম্পতি। একসময় স্বামী-স্ত্রীর পাওয়া মেডেল, ক্রেস্ট, পত্রিকার কাটিংয়ে বিছানার অর্ধেক ভরে যায়। আর তাঁদের মুখে অনেক না পাওয়া ক্ষোভের মধ্যেও এক টুকরো প্রশান্তির হাসি খেলে যায়।

বাংলাদেশ সরকার জাতিসংঘ প্রতিবন্ধী ব্যক্তিবর্গের অধিকার সনদ অনুসমর্থন করেছে। ২০১৩ সালে ‘প্রতিবন্ধী ব্যক্তির অধিকার ও সুরক্ষা আইন ২০১৩’ সংসদে পাস হয়। আইনে শ্রবণ ও বাক্‌প্রতিবন্ধী ব্যক্তির নিজ ইচ্ছা অনুযায়ী, যথাসম্ভব, বাংলা ইশারা ভাষাকে প্রথম ভাষা হিসেবে গ্রহণ করতে পারবে এবং একে অধিকার হিসেবেই আখ্যা দেওয়া হয়েছে। আইনটিতে ‘বাংলা ইশারা ভাষা’র অর্থ শ্রবণ ও বাক্‌প্রতিবন্ধী ব্যক্তির জন্য প্রণীত বাংলা ইশারা ভাষা, যা তাদের নিজস্ব সংস্কৃতি থেকে উৎসারিত এবং অন্যান্য ভাষার মতোই গতিশীল ও পরিবর্তনশীল বলে উল্লেখ করা হয়েছে। রাষ্ট্রীয় পর্যায়ে ১৯৯৪ সালে সমাজকল্যাণ মন্ত্রণালয় ও জাতীয় বধির সংস্থা যৌথভাবে বাংলা ইশারা ভাষার অভিধান প্রকাশ করে। তবে পরিবারটির সদস্যরা জানালেন, সনদ এবং আইনের তাগিদের পরেও ভাষাটির অগ্রগতি তেমন একটা হয়নি।

শাহ বাবুল আহমেদ অষ্টম শ্রেণি ও নাজমা বেগম পঞ্চম শ্রেণি পর্যন্ত পড়াশোনা করার সুযোগ পান। শাহ বাবুল আহমেদের বড় বোনও কথা বলতে পারতেন না। বিয়ে পরে তাঁর সংসার করা হয়নি। এ বোনটি মারা গেছেন সমাজের নানা বঞ্চনা সহ্য করে। এই দম্পতির প্রথম সন্তান বদরুন নাহার। সন্তান জন্মের পর থেকেই অজানা ভয় কাজ করছিল এ দম্পতির মনে। জন্মের পর মেয়ে বেশির ভাগ সময় নানির কাছে থাকে। তারপর একসময় মেয়ে কথা বলা শেখে। কিন্তু মেয়ের কথা সবাই বুঝতে পারে, শুধু বাবা-মা বুঝতে পারেন না। সে এক অন্য রকম কষ্ট। তারপর মেয়ে যখন ইশারা ভাষা শিখে ফেলে, তখন এই বাবা-মায়ের খুশির অন্ত ছিল না। ছেলের বেলাতেও অজানা ভয় কাজ করে। তবে ছেলেও কথা বলতে পারেন দেখে আশ্বস্ত হন এ দম্পতি।

পরিবারটি নিজেদের মতো করে যোগাযোগের সব কৌশল রপ্ত করে ফেলেছে। ছবি: সাবরিনা ইয়াসমীন
পরিবারটি নিজেদের মতো করে যোগাযোগের সব কৌশল রপ্ত করে ফেলেছে। ছবি: সাবরিনা ইয়াসমীন

বাবুল আহমেদ গুলিস্তানের বধির ক্রীড়া ফেডারেশনের প্রতিষ্ঠাতা। বাংলাদেশ জাতীয় বধির সংস্থার ভাইস প্রেসিডেন্ট পদ থেকে অবসরে যান তিনি। বর্তমানে তিনি এবং তাঁর স্ত্রী এ সংস্থার আজীবন সদস্য। এ ছাড়া তাঁরা বিভিন্ন সংগঠনের সঙ্গে জড়িত আছেন। নাজমা বেগম সংসারের চাপে খেলা ছেড়ে দেন অনেক আগে।

সর্বস্তরে ইশারা ভাষার বিস্তারে যে ধরনের অগ্রগতি হওয়ার কথা ছিল, তা হয়েছে কি না জানতে চাইলে বাবুল আহমেদ মেয়ের সহায়তা নিয়ে বললেন, দেশে ইশারা ভাষা দিবস পালিত হচ্ছে, তা একটি অগ্রগতি। তবে শ্রবণ ও বাক্‌প্রতিবন্ধী ব্যক্তিরা নির্যাতনের শিকার হলে আদালতে গিয়ে আইনি সহায়তা নিতে পারছেন না। হাসপাতালে গিয়ে চিকিৎসা পাচ্ছেন না। কর্মক্ষেত্রে যোগ্যতা থাকার পরও ভাষার প্রতিবন্ধকতার কারণে নিজের যোগ্যতা প্রমাণ করতে পারছেন না। পারিবারিক ক্ষেত্রে জমিজমা ভাগাভাগির সময় বৈষম্যের শিকার হতে হচ্ছে। সামাজিক নানা প্রতিবন্ধকতা তো আছেই।

বদরুন নাহার বলেন, এখন পর্যন্ত বিটিভি ও দেশটিভিতেই শুধু ইশারা ভাষার ব্যবহার করা হচ্ছে। দেশটিভিতে সন্ধ্যা সাতটার খবর আর বিটিভিতে বেলা দুইটা এবং সন্ধ্যা ছয়টার খবরে এ ভাষার ব্যবহার করা হচ্ছে। বিটিভির বেলা দুইটার খবর অন্য বেসরকারি টেলিভিশন চ্যানেলগুলো প্রচার করে, সেই হিসাবে এসব চ্যানেলের দর্শকেরাও উপকৃত হচ্ছেন। জাতীয় ও এনজিও পরিচালিত বিভিন্ন অনুষ্ঠানে ইশারা ভাষার দোভাষী রাখা হচ্ছে। অগ্রগতি বলতে এটুকুই।

বাবুল আহমেদ ও নাজমা বেগম অ্যাথলেট ছিলেন। তাঁদের আছে অনেক অর্জন। ছবি: সাবরিনা ইয়াসমীন
বাবুল আহমেদ ও নাজমা বেগম অ্যাথলেট ছিলেন। তাঁদের আছে অনেক অর্জন। ছবি: সাবরিনা ইয়াসমীন

বদরুন নাহার জানালেন, ইশারা ভাষা নিয়ে প্রশিক্ষণের আয়োজন করছে বাংলাদেশ জাতীয় বধির সংস্থা, সোসাইটি অব দ্য ডেফ অ্যান্ড সাইন ল্যাঙ্গুয়েজ ইউজার্স (এসডিএসএল) এবং সিডিডি। দেশে খুব বেশি দোভাষী তৈরি হয়নি। দোভাষী হিসেবে প্রশিক্ষণ নিতে অনেকে আগ্রহও পাচ্ছেন না, কেননা প্রশিক্ষণ নিলেও এ ভাষাকে পেশা হিসেবে গ্রহণ করার সুযোগ নেই। বদরুন নাহারের মতে, দোভাষী তৈরির পাশাপাশি আদালত, কর্মক্ষেত্রসহ সব জায়গায় কর্মরত মানুষগুলোকে ইশারা ভাষায় দক্ষ করার জন্য প্রশিক্ষণের আওতায় আনা প্রয়োজন যাতে শ্রবণ ও বাক্‌প্রতিবন্ধী ব্যক্তিরা একা একাই বিভিন্ন জায়গায় গিয়ে বিভিন্ন সেবা গ্রহণ করতে পারেন।

বাবা-মা কথা বলতে পারেন না—এ বিষয়টি বদরুন নাহারের জীবনে কতটুকু প্রভাব ফেলেছে জানতে চাইলে বদরুন নাহার বলেন, ‘ছোটবেলায় মন খারাপ হতো। বাবা-মা স্কুলের পড়া বুঝিয়ে দিতে পারতেন না। বিয়ের সময় আমাকে দেখতে অনেক ছেলে এসেছে, সবই পছন্দ হয়েছে, শুধু বাবা-মা কথা বলতে পারেন না বলে ছেলেপক্ষ পিছিয়ে গেছে। আইটি কোম্পানিতে কর্মরত আনিসুল ইসলামের বাবা একটি বধির স্কুলের প্রিন্সিপাল হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছিলেন বলেই তাঁর পরিবার বিয়েতে আপত্তি করেনি। স্বামী নিজের ইচ্ছাতেই আমার কাছ থেকে ইশারা ভাষা শিখে নেন, যাতে শ্বশুর-শাশুড়ির সঙ্গে একা একাই কথা বলতে পারেন।’