কখনো টাকার জন্য কাজ করিনি : স্টিভ জবস

স্টিভ জবস
স্টিভ জবস

বিশ্বখ্যাত প্রতিষ্ঠান অ্যাপলের অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা স্টিভ জবস। ২০১১ সালে তিনি মৃত্যুবরণ করেন। কিন্তু অ্যাপলকে তিনি এমন একটা জায়গায় পৌঁছে দিয়ে গেছেন, এখনো এটি বিশ্বের সবচেয়ে প্রভাবশালী প্রতিষ্ঠানগুলোর মধ্যে অন্যতম। স্টিভ অসাধারণ বক্তা ছিলেন। ১৯৯৫ সালে ‘কম্পিউটার ওয়ার্ল্ড ইনফরমেশন টেকনোলজি অ্যাওয়ার্ডস প্রোগ্রাম’ কর্তৃপক্ষ তাঁর একটি সাক্ষাৎকার নিয়েছিল। আজ স্টিভ জবসের জন্মদিন উপলক্ষে সেই সাক্ষাৎকারে বলা তাঁর কিছু কথা ছাপা হলো।

ব্যবসায় দীর্ঘদিনের অভিজ্ঞতা থেকে আমি একটা জিনিস আবিষ্কার করেছি। আমি সব সময় বলি—আমরা যা করছি, কেন করছি? অধিকাংশ সময় যে উত্তরটা পাই তা হলো, ‘ওহ্, এখানে তো এভাবেই চলে।’ কেউ জানে না, তারা যা করছে, কেন করছে? ব্যবসা সম্পর্কে কেউ গভীরভাবে ভাবে না।

একটা উদাহরণ দিয়ে বলি। আমরা যখন গ্যারেজে বসে অ্যাপল কম্পিউটার তৈরি করতাম, তখন জানতাম এটা তৈরি করতে কত খরচ হবে। অ্যাপল–২ তৈরির সময় যখন কারখানায় কাজ শুরু হলো, তখনো খরচের ব্যাপারে আমাদের হিসাবরক্ষকদের একটা ধারণা ছিল। তাঁরা শুরুতে একটা প্রাথমিক খরচ ধরতেন। কিন্তু শেষে গিয়ে গরমিল দিয়ে হিসাবটা মিলিয়ে দিতেন। আমি সব সময় জিজ্ঞেস করতাম, ‘আপনারা এই কাজটা কেন করেন?’ তাঁদের জবাব ছিল, ‘এভাবেই করতে হয়।’

ছয় মাস এই সমস্যার পেছনে লেগে থাকার পর বুঝতে পারলাম, তাঁদের এই কর্মকাণ্ডের পেছনে কারণ হলো, কোথায় কত খরচ হতে পারে, সে সম্পর্কে তাঁদের যথেষ্ট নিয়ন্ত্রণ নেই। অতএব তাঁরা অনুমানের ওপর নির্ভর করেন। আর শেষে গরমিল দিয়ে অনুমানের সঙ্গে চূড়ান্ত হিসাবটা মিলিয়ে দেন। কত খরচ হবে, সেটা তুমি জানবে না কেন? কারণ, তোমার তথ্যব্যবস্থা যথেষ্ট ভালো নয়। অথচ বিষয়টা এভাবে কেউ দেখত না। ম্যাকিনটোশের জন্য এই স্বয়ংক্রিয় ফ্যাক্টরি তৈরি করার পর আমরা ব্যবসার এমন অনেক সেকেলে ধারণা থেকে বেরিয়ে এসেছিলাম। কোথায় কত খরচ, তা আমরা স্পষ্টভাবে জানতাম।
ব্যবসায় এমন অনেক নিয়ম আছে, যেগুলো বহুদিন ধরে চলে আসছে। কাজটা এভাবে করা হয়, কারণ গতকালও এভাবেই হয়েছিল, তারও আগে থেকে এভাবেই চলে আসছে। আমি বলতে চাইছি, আপনি যদি প্রচুর প্রশ্ন করেন এবং ভাবেন, পরিশ্রম করেন, খুব দ্রুতই ব্যবসা শিখতে পারবেন। এটা পৃথিবীর সবচেয়ে কঠিন কাজ নয়। রকেট সায়েন্সও নয়।
২৩ বছর বয়সে আমি মিলিয়ন (১০ লাখ) ডলারের মালিক হয়েছি। বয়স যখন ২৪, তখন সম্পদের পরিমাণ ১০ মিলিয়নের (১ কোটি) বেশি ছিল। ২৫ বছর বয়সে পৌঁছাতে পৌঁছাতে সংখ্যাটা ১০০ মিলিয়ন (১০ কোটি) ছাড়িয়ে গেছে। কিন্তু এই সংখ্যাগুলো কখনোই আমার কাছে গুরুত্বপূর্ণ ছিল না। কারণ, আমি কাজটা টাকার জন্য করিনি। আমার কাছে মনে হয় টাকা একটা চমৎকার জিনিস। কারণ, এটা আপনাকে অনেক কিছু করার সক্ষমতা দেয়। টাকা থাকলে আপনি সহসা লাভের আশা ছাড়াই নানা আইডিয়ার পেছনে বিনিয়োগ করতে পারবেন।
সেই সময়ে টাকা আমার কাছে গুরুত্বপূর্ণ ছিল না। আমার কাছে গুরুত্বপূর্ণ ছিল প্রতিষ্ঠান, প্রতিষ্ঠানের মানুষ, আমাদের তৈরি পণ্য আর আমাদের পণ্য মানুষকে কী করার সক্ষমতা দেবে—সেটি। অতএব টাকা নিয়ে আমি খুব একটা ভাবিনি। আমি কখনো শেয়ার বিক্রি করিনি। শুধু বিশ্বাস করেছিলাম, দীর্ঘ মেয়াদে প্রতিষ্ঠানটি ভালো করবে...
স্কুলে পা রাখার আগে মা আমাকে পড়তে শিখিয়েছিলেন। অতএব স্কুলে ভর্তির পর দুটো কাজের প্রতি আমার আগ্রহ জন্মাল—বই পড়া আর স্কুলের বাইরে গিয়ে প্রজাপতির পেছনে ছোটা। পাঁচ বছর বয়সী একটা শিশু যা যা করতে পছন্দ করে আরকি...
স্কুল কর্তৃপক্ষের সঙ্গে সম্পর্কটা একেবারেই ভালো ছিল না। তারা আমার সব কৌতূহল কেড়ে নেওয়ার খুব কাছাকাছি পৌঁছে গিয়েছিল। ক্লাস থ্রিতে ওঠার পর রিক ফ্যারেনটিনো নামের একটা খুব ভালো বন্ধু হলো। দুষ্টুমি ছিল আমাদের একমাত্র বিনোদন। শিক্ষকের ডেস্কের নিচে বিস্ফোরক রেখে দেওয়ার মতো দুষ্টুমিও করেছি। ব্যাপারটা এতই গুরুতর পর্যায়ে পৌঁছে গিয়েছিল যে বেশ কয়েকবার আমাদের দুজনকে স্কুল থেকে বের করে দেওয়া হয়েছে।
ক্লাস ফোরে উঠে দেখা হলো আমার জীবনের অন্যতম অনুপ্রেরণার সঙ্গে। আমি আর রিক এক ক্লাসে ছিলাম। অধ্যক্ষ বললেন, ‘ওদের দুজনকে একসঙ্গে রাখা যাবে না।’ তখন আমাদের এক শিক্ষক, মিসেস হিল বললেন, ‘আমি ওদের দুজনের মধ্য থেকে একজনকে নেব।’ ঈশ্বরের কৃপায় তিনি আমাকে বেছে নিয়েছিলেন।
দুই সপ্তাহ আমাকে চোখে চোখে রাখার পর কাছে এসে বললেন, ‘স্টিভ, আমি তোমার সঙ্গে একটা চুক্তি করব। এই যে গণিতের বইটা দেখছ, তুমি যদি এটা বাসায় নিয়ে কারও সাহায্য ছাড়াই সব অঙ্ক শেষ করতে পারো, এবং তোমার অঙ্কগুলোর মধ্যে যদি শতকরা ৮০ ভাগ ঠিক হয়, আমি তোমাকে ৫ ডলার দেব।’ তাঁর দিকে তাকিয়ে বললাম, ‘আপনার মাথা খারাপ হয়েছে! আপনি জানেন, এ রকম কাজ আমি কখনো করিনি।’ কিন্তু আমি সত্যিই কাজটা শেষ করেছিলাম।
মূলত, শেখার জন্য তিনি আমাকে ঘুষ দিয়েছিলেন। কখনো চকলেট, কখনো টাকা। তিনি আমার ভেতর শেখার আগ্রহ জাগিয়ে তুলেছিলেন,
ছোটবেলায় সায়েন্টিফিক আমেরিকানে একটা নিবন্ধ পড়েছিলাম। সেখানে পৃথিবীর বিভিন্ন প্রাণীর গতিদক্ষতা সম্পর্কে বলা হয়েছে। ভালুক, শিম্পাঞ্জি, রেকুন, পাখি, মাছ। প্রতি কিলোমিটার যাওয়ার জন্য তারা কত কিলো ক্যালরি খরচ করে। মানুষের হিসাবটাও সেখানে ছিল। তালিকায় মানুষের ওপরে ছিল শকুন। হিসাব বলছিল, শকুন সবচেয়ে বেশি কর্মক্ষম। কিন্তু একজন মানুষ যখন সাইকেল চালায়, তখন সে কর্মক্ষমতার দিক দিয়ে শকুনকে পেছনে ফেলে দেয়।
এই নিবন্ধ আমার ওপর বিশেষ প্রভাব ফেলল। মানুষ আবিষ্কারের ক্ষমতা নিয়ে জন্মায়। আমরা এমন সব যন্ত্র তৈরি করতে পারি, যেটা রাতারাতি আমাদের সহজাত দক্ষতাকে বৃদ্ধি করতে পারে। একবার আমরা এ–সংক্রান্ত একটা বিজ্ঞাপন প্রচার করেছিলাম, ব্যক্তিগত কম্পিউটার হলো মনের বাইসাইকেল। আমি আমার সমস্তটা দিয়ে এই কথা বিশ্বাস করি।
পৃথিবীর ইতিহাসে মানুষ যা যা তৈরি করছে, সেই তালিকায় কম্পিউটার নিশ্চয়ই সবচেয়ে ওপরে বা তার কাছাকাছি কোনো জায়গায় স্থান পাবে। এটা আমাদের সবচেয়ে অসাধারণ আবিষ্কার। আমার নিজেকে সৌভাগ্যবান মনে হয়। কারণ, আমি সঠিক সময়ে সিলিকন ভ্যালির সঠিক জায়গাটায় ছিলাম। (সংক্ষেপিত)

ইংরেজি থেকে অনুবাদ: মো. সাইফুল্লাহ