ফুটবলের পাঠশালায় কোচ মিরোনা

মিরোনা খাতুন, ছবি: সুমন ইউসুফ
মিরোনা খাতুন, ছবি: সুমন ইউসুফ

ছোটবেলায় ছিলেন ভীষণ ডানপিটে। ভরদুপুরে বাড়ির সবাই যখন ঘুমিয়ে থাকত, চুপিচুপি বাবার সাইকেল নিয়ে বেরিয়ে পড়তেন মহল্লার অলিগলি ঘুরতে। তখন বাগেরহাটে মেয়েদের কোনো ফুটবল দল ছিল না, তাই বিকেলবেলায় ছেলেদের সঙ্গে নেমে পড়তেন অনুশীলনে। ট্র্যাকসুট, জার্সি পরে অনুশীলনে গেলে অনেকে হাসাহাসি করতেন। পাড়ার বখাটেরা ডেকে বলত, ‘তুই কি মেয়ে না? ছেলেদের সঙ্গে ছেলেদের মতো খেলিস?’ সমালোচনা থোড়াই কেয়ার করতেন মিরোনা খাতুন। পরিবার থেকে পুরো সহযোগিতাই পেয়েছেন। পরিবারের সবার সহযোগিতার জন্যই ইতিহাসে নাম লেখাতে পেরেছেন মিরোনা। বাংলাদেশের পেশাদার ফুটবলে পুরুষ দলের প্রথম নারী কোচ বাগেরহাটের এই মেয়ে।

কোচের প্রস্তাবটা হঠাৎ করেই এসেছিল মিরোনার কাছে। ভারতের একটি রাজ্য দলের কোচ হওয়ার প্রস্তাব প্রথমে পেয়েছিলেন। কিন্তু বিপিএড (শারীরিক শিক্ষায় স্নাতক) পরীক্ষার জন্য সেই সুযোগটা পেয়েও হাতছাড়া করেন মিরোনা। এরপর বাংলাদেশ চ্যাম্পিয়নশিপ লিগের ক্লাব ঢাকা সিটি এফসির কোচের দায়িত্ব পান। এই ক্লাবটি এবারের মৌসুমে চ্যাম্পিয়নশিপ লিগে নবাগত। দলটি গড়তে সহযোগিতা করেছে বাংলাদেশ নৌবাহিনী। মিরোনা বর্তমানে নৌবাহিনীর অ্যাথলেট। জাতীয় দলের ফুটবল ছেড়ে দেওয়ার পর পেশাদার কোচের এএফসি ‘বি’ লাইসেন্স কোর্সটা গত বছর সেরে ফেলেন মিরোনা। দলের প্রধান কোচ আবু নোমান এএফসির ‘সি’ লাইসেন্সধারী। কিন্তু চ্যাম্পিয়নশিপ লিগের নতুন নিয়মে প্রধান কোচের অবশ্যই ‘বি’ লাইসেন্স থাকতে হবে। তাই কাগজে–কলমে প্রধান কোচ মিরোনা।

গত ২৪ ডিসেম্বর ক্লাবটির সঙ্গে কোচের চুক্তি করেন মিরোনা। নিয়মিত মাঠে গিয়ে অনুশীলন করান ফুটবলারদের। ইতিহাসের অংশ হতে পেরে ভীষণ রোমাঞ্চিত মিরোনা, ‘আমি জানতাম এর আগে কোনো মেয়ে পুরুষ দলের কোচিং করায়নি। তাই আমিও প্রস্তাবটা পেয়েই লুফে নিয়েছি। আমার ভীষণ ভালো লাগছে।’

মেয়ে হয়েও পুরুষ ফুটবলারদের অনুশীলন করানোর চ্যালেঞ্জটা উপভোগ করেন মিরোনা, ‘আসলে যখন কোচ হিসেবে কোনো ফুটবলারের সামনে দাঁড়াই তখন সে ছেলে না মেয়ে সেটা মাথায় রাখি না। এখানে ওদের শেখানোটাই বড় বিষয়। কীভাবে ওদের মানিয়ে নিতে পারছি, সেটা নির্ভর করে আমার দক্ষতার ওপর। ওদের সঙ্গে কাজ করার ক্ষেত্রে কোনো বাধা পাইনি। আমি কোচের কাজটা দারুণ উপভোগ করছি।’

মিরোনা পড়তেন বাগেরহাটের রহিমাবাদ মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে। স্কুলটি প্রতিবছর আন্তজেলা বার্ষিক ক্রীড়ায় অংশ নিত। প্রতিযোগিতায় অ্যাথলেটিকসের বেশির ভাগ পুরস্কার জিতে নিতেন মিরোনা। পাশাপাশি ফুটবলও খেলতেন। খুলনার ক্রিকেট কোচ ইমতিয়াজ হোসেন পিলু ২০০৮ সালে ফুটবল দল গড়ার জন্য মেয়ে খুঁজছিলেন। বাগেরহাটে তখন অনেক নামডাক মিরোনার। ফুটবল কোচ আতাউর রহমানের কাছে নিয়মিত অনুশীলন করেন। বাগেরহাটের ক্রিকেট কোচ শঙ্কর দেবনাথ ইমতিয়াজের অনুরোধে এরপর মিরোনাকে পাঠান খুলনায়। ফুটবলের প্রথম বাছাইয়েই টিকে যান মিরোনা। সিটিসেল জাতীয় মহিলা চ্যাম্পিয়নশিপে খুলনার হয়ে খেলতে আসেন ২০০৮ সালে ঢাকায়। কমলাপুর বীরশ্রেষ্ঠ মোস্তফা কামাল স্টেডিয়ামে খেলে জিতে নেন সেরা খেলোয়াড়ের পুরস্কার। পরের বছর জাতীয় নারী ফুটবল দলে ডাক পান। এরপর একটানা ২০১৬ সাল পর্যন্ত জাতীয় দলে খেলেছেন মিরোনা। ফুটবলের পাশাপাশি জাতীয় অ্যাথলেটিকসের ট্র্যাক মাতিয়েছেন বিজেএমসি ও নৌবাহিনীর হয়ে। দূরপাল্লার দৌড়ে ৮০০, ১৫০০ ও ৩০০০ মিটারে জাতীয় আসরে সোনা জিতেছেন ১৩টি।

খেলাধুলার সুবাদেই নৌবাহিনীতে চাকরি পেয়েছেন। মেয়ে হয়ে বাবার হাতে টাকা তুলে দিতে পেরে ভীষণ খুশি মিরোনা। যদিও বলছিলেন, ‘যেহেতু আমার পরিবার সচ্ছল তাই কেউ আমার কাছে টাকাপয়সা তেমন চায় না। কিন্তু বাড়ি গেলে সবার জন্য কিছু না কিছু কেনাকাটা করে নিয়ে যাই।’

বর্তমান জাতীয় দলে খেলা মারিয়া মান্দাদের সঙ্গে সর্বশেষ সাফে খেলেছিলেন দুই বছর আগে। বাংলাদেশের মেয়েরা এখন বয়সভিত্তিক ফুটবলে দারুণ সাফল্য পাচ্ছে। এসব দেখে মিরোনা ভীষণ খুশি। অনেক মেয়ে এখন ফুটবল কোচিংয়ে আগ্রহ দেখাচ্ছেন। মিরোনা তাঁদের স্বাগত জানাতে প্রস্তুত, ‘আমি সবাইকে কোচিংয়ে স্বাগত জানাই। তাঁদের বলি, আপনারা আসুন। কারণ একসময় আপনারা খেলেছেন। এখন ফুটবলার তৈরির কারিগর হতে পারবেন।’

মিরোনার উচ্চতা ৪ ফুট ৮ ইঞ্চি। এ নিয়ে শুরুতে বেশ বিড়ম্বনায় ভুগতেন, ‘আসলে প্রথম দেখায় শুরুতে কেউ আমার যোগ্যতা সম্পর্কে জানতে চাইত না। এমনও হয়েছে অন্য খেলোয়াড়কে কোচ বেছে নিতেন মাঠে। সে যখন ভালোভাবে কাজটি করতে পারত না, তখন আমি কোচের কাছে যোগ্যতা প্রমাণ করেছি। দলে জায়গা করে নিয়েছি।’

উচ্চতা নিয়ে অনেক কথা শুনেছেন মিরোনা। এখন নিজেই বাংলাদেশের নারী ফুটবলের ইতিহাসে উঠে গেছেন অন্য উচ্চতায়।