সাইবার অপরাধ ঠেকাতে জেনিফারের যুদ্ধ

নিরাপদ সাইবার জগৎ দেখতে চান জেনিফার আলম। ছবি: প্রথম আলো
নিরাপদ সাইবার জগৎ দেখতে চান জেনিফার আলম। ছবি: প্রথম আলো

এইচএসসি পরীক্ষার্থী এক মেয়ে। এক ছেলেবন্ধুর সঙ্গে কিছু ছবি আদান–প্রদান করেছিল ফেসবুকে। সে ছবিগুলো বিকৃত হয়ে একসময় ছড়িয়ে পড়ে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে। মেয়েটি ও ছেলেটি দুজনই শিকার হয় সাইবার অপরাধের। সামাজিকভাবে হেয় হওয়ার আশঙ্কায় কুঁকড়ে যায় মেয়েটি।

ঘটনা বোঝার পরপরই সেই মেয়ে তা জানায় ক্রাইম রিসার্চ অ্যান্ড অ্যানালাইসিস ফাউন্ডেশন—ক্র্যাফের কাছে। কীভাবে ছবিগুলো ছড়াল তার কারিগরি তদন্ত চালায় ক্র্যাফ। দেখা গেল ছেলেটির ফেসবুক অ্যাকাউন্ট বেদখল (হ্যাকড) হয়েছিল। আর তা করেছিল তার বন্ধুরা। তারাই ছড়িয়ে দিয়েছিল ছবিগুলো।

এ ঘটনা শোনালেন ক্র্যাফের প্রেসিডেন্ট জেনিফার আলম। এও যোগ করলেন, ‘সচেতন থাকলে সাইবার অপরাধ থেকে অনেকটাই বাঁচা যায়।’ এই সচেতনতা তৈরির কাজই করছেন জেনিফার আলম ও তাঁর দলবল। সচেতনতা তৈরিতে সাইবার অপরাধের শিকার ব্যক্তি (ভিকটিম) এবং আইন প্রয়োগকারী সংস্থার মধ্যে সেতুবন্ধ হিসেবেও কাজ করেন তাঁরা।

ভিকটিম ও পুলিশের মধ্যে সেতুবন্ধ কেন দরকার? জেনিফারের জবাব, ‘সাইবার অপরাধের শিকার ছেলে–মেয়ে উভয়ই হন। তবে আক্রান্ত ব্যক্তিদের ৬০ শতাংশই মেয়ে। যখন সাইবার বুলিং বা এমন অপরাধের শিকার হন কোনো মেয়ে, তখন তাঁরা সহজে থানায় যেতে চান না। একধরনের “পুলিশভীতি” কাজ করে। আমাদের কাছে এলে আমরা তাঁকে পরামর্শ দিই, তাঁর মধ্যে মানসিক জোর তৈরি করার চেষ্টা করি। এরপর আইন প্রয়োগকারী সংস্থার কাছে তাঁরা সহজে যেতে পারে। অনেক সাইবার অপরাধ রয়েছে, যেগুলো দমন করতে, অপরাধীকে ধরতে আইন প্রয়োগকারী সংস্থার প্রয়োজন পড়েই।’

পৃথিবীর মানুষ এখন সহজেই একজন আরেকজনের সঙ্গে সংযুক্ত। ইন্টারনেটের যুগে মুহূর্তে হয়ে যায় যোগাযোগ। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে দ্রুত ছড়িয়ে পরে ভালোমন্দ অনেক কিছুই। এসবরেইর সুযোগ নেয় অপরাধীরা। বাংলাদেশেও যেহেতু ইন্টারনেটের প্রসার দ্রুত হচ্ছে, ফেসবুকের মতো সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম বিপুলভাবে জনপ্রিয়, তাই এই সাইবার জগতে নিরাপদ থাকাটা জরুরি। এ জন্য সচেতনতার বিকল্প দেখেন না জেনিফার আলম। ২০১৬ সালের ১৪ ফেব্রুয়ারি এক বন্ধুকে নিয়ে শুরু করে দেন ক্র্যাফের কাজ। নিজেদের ওয়েবসাইট (www.crafbd.com), ফেসবুক পেজ আর টেলিফোনের হটলাইন (০১৭২৮৮৪৪৯৯৯)—এই তিন মাধ্যমে যে কেউ তাদের সহযোগিতা নিতে পারেন।

ক্র্যাফে যাঁরা কাজ করেন বা যুক্ত আছেন, তাঁরা সবাই স্বেচ্ছাসেবী। জেনিফার বললেন, এখন আমাদের সঙ্গে কাজ করেন প্রায় দেড় শজন। কারিগরি দলে আছে ২৭ জন। সাইবার অপরাধ নিয়ে কাজ করতে গেলে প্রযুক্তি জানা মানুষের প্রয়োজন। কারিগরি দল ছাড়াও আমাদের সঙ্গে মনোরোগ চিকিৎসক, মনোবিদ, আইনজীবীরা রয়েছেন। যে ভিকটিমের যে ধরনের সহায়তা প্রয়োজন তা দেওয়া হয়।

ক্র্যাফ থেকে এ পর্যন্ত সাইবার অপরাধের শিকার ৬ হাজার মানুষকে সহায়তা দেওয়া হয়েছে। আর সবই বিনা মূল্যে। ‘ব্যক্তি পর্যায়ে আমরা সেবাটা দিই বিনা মূল্যে। তবে প্রাতিষ্ঠানিক বা করপোরেট পর্যায়ে ফি নেওয়া হয়।’ সবাই স্বেচ্ছাসেবক, আবার ফাউন্ডেশন প্রযুক্তিনির্ভর কাজ করে। খরচাপাতি আসে কীভাবে? ‘শুরুতে আমরা বন্ধুরা মিলে তহবিল গঠন করেছিলাম। পরে আমরা ক্র্যাফ নামে একটি তথ্যপ্রযুক্তি পরামর্শক প্রতিষ্ঠান তৈরি করি। সেটা বাণিজ্যিক। সেখানকার আয় ফাউন্ডেশনের কাজে ব্যয় হয়।’

এদিকে জেনিফার আলম নিজে প্রশিক্ষক হিসেবে কাজ করেন জাতীয় জরুরি সেবা ৯৯৯–এ। নিজে একজন উদ্যোক্তাও। উদ্যোগের খাত পোশাক ও আবাসন। বাবা মাহবুবুল আলম একজন প্রকৌশলী, তবে এখন ব্যবসা করেন। মা নিলুফা আক্তার গৃহিণী। তিন ভাই ও এক বোনের সবার বড় জেনিফারের জন্ম ১৯৮৯ সালে। নর্থ সাউথ ইউনিভার্সিটি থেকে ব্যবসায় প্রশাসনে (বিপণন) স্নাতক ডিগ্রি নিয়েছেন।

বিপণনের সঙ্গে সাইবার অপরাধ নিয়ে কারিগরি কাজের সম্পর্ক তো মিলছে না! ‘আমি তো উদ্যোক্তাও।’ হেসে বলেন জেনিফার। আসলে কম্পিউটার প্রযুক্তির প্রতি ছোটবেলা থেকেই আগ্রহ জেনিফার আলমের। পাশাপাশি মানুষের জন্য কাজ করার একটা স্পৃহাও আছে তাঁর মধ্যে। পথশিশুদের নিয়ে ব্যক্তিগতভাবে কাজ করেন অনেক আগে থেকেই। আত্মহত্যা প্রতিরোধেও নানা রকম উদ্যোগ নিয়ে থাকেন। নিজে মনে করেন, সচেতনতা তৈরি হলে ৬০ শতাংশ সাইবার অপরাধ কমানো যাবে। এ কাজটাই চালিয়ে যেতে চান জেনিফার আলম।