তাঁরা একটি মাইলফলক ছুঁয়েছিলেন

‘আকাশবীণা’র ককপিটে দুই বৈমানিক। ছবি: কারিব আহমেদ
‘আকাশবীণা’র ককপিটে দুই বৈমানিক। ছবি: কারিব আহমেদ

গত বছরের ডিসেম্বরে ফেসবুকে একটি ছবি ভাইরাল হয়। দুজন নারী বিমানচালক একসঙ্গে বিমানের ককপিটে হাস্যোজ্জ্বল মুখে বসে আছেন। ছবিটি মন ভালো করা ও অনুপ্রেরণার। এই দুজন নারী বিমানচালক হলেন বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইনসের বোয়িং ৭৮৭ ড্রিমলাইনার ‘আকাশবীণা’র ককপিটে পাইলটের দায়িত্ব পালনকারী ক্যাপ্টেন আলিয়া মান্নান ও তাঁর পাশে বসা ফার্স্ট অফিসার মুনজারিন রাইয়ান। যে কারণে তাঁরা বিশেষ, সেটি হলো প্রথমবারের মতো কোনো নারী পাইলটের নেতৃত্বে আকাশে উড়েছে বোয়িং ৭৮৭ ড্রিমলাইনার ।

তাঁদের বিজি-০৩৯ ফ্লাইটটি গত ২৪ ডিসেম্বর রাতে ঢাকা থেকে সৌদি আরবের রিয়াদে পৌঁছায়। আলিয়া মান্নান বলেন, ‘জানেন, ওই দিন গ্রাউন্ডে যিনি ইঞ্জিনিয়ার ছিলেন, তিনিও নারী। যখন শুনলাম, খুব ভালো লেগেছে।’

৫ মার্চ ক্যাপ্টেন আলিয়া মান্নানের সঙ্গে কথা হচ্ছিল, সেদিন বিকেলেও ছিল তাঁর ফ্লাইট। আগের দিন মানে ৪ মার্চ তিনি এসেছেন বিমান চালিয়ে। প্রায় ২৭ বছর ধরে জীবনের সবচেয়ে বেশি সময় কেটেছে তাঁর আকাশপথেই। ১৯৯২ সালে শুরু হয় ক্যারিয়ার। উচ্চমাধ্যমিকের পর যুক্তরাষ্ট্রে চলে যান স্নাতকের জন্য। কিন্তু মন টিকল না আলিয়া মান্নানের। তিন-চার মাস পরই চলে এলেন। ঢাকায় ফিরে দেখেন ছোট ভাই ফ্লাইং একাডেমিতে ভর্তি হয়েছেন। বাবার কাছে আবদার করলেন তিনিও ফ্লাইং শিখবেন। মা অবশ্য ঘোর আপত্তি জানিয়েছিলেন। ওদিকে ভাই ফ্লাইং একাডেমির প্রশিক্ষণ ছেড়ে দিয়ে বিদেশে চলে গেলেন পড়তে। আর আলিয়া মান্নান পেশা হিসেবে বেছে নিলেন বিমান চালনাকেই।

আলিয়া মান্নান মনে করেন, দীর্ঘ ক্যারিয়ারে সফলতা পেতে হলে কাজের প্রতি সিরিয়াস হতে হবে। কাজটাকে শ্রদ্ধা করতে হবে। আর পেশাদারি মনোভাব থাকতে হবে। জীবনে চড়াই-উতরাই সবই থাকবে, কিন্তু কাজের জায়গায় তাঁর পেশাদারি মনোভাব না থাকলে এগোনো যাবে না। তিনি বোয়িং ৭৭৭-এরও প্রথম নারী বিমানচালক ছিলেন।

এত বছর পরও আলিয়া মান্নান মনে করেন, মেয়েদের জন্য এই কাজ এখনো খুব চ্যালেঞ্জিং। অন্য সব সাধারণ মানুষের মতো জীবন হয় না। কোনো মেয়ে সফলভাবে এখানে ক্যারিয়ার গড়তে পারবে না, যদি না তার পরিবার পাশে থাকে। আলিয়া মান্নান বলেন, ‘এমনও হয়েছে আমি দুপুরে ফ্লাইটে যাব, আমার বাবা-মা এসে সকালে আমার ছেলেকে তাঁদের বাসায় নিয়ে গেছেন। এখন তো আমার ছেলে লন্ডনে পড়ছে। কিন্তু জীবনের ১৭-১৮ বছর কেটেছে এভাবে মা-বাবার সমর্থনে।’

আকাশবীণার উদ্বোধন করেছিলেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। এই বিষয়টি আলিয়া মান্নান ও ফার্স্ট অফিসার মুনজারিন রাইয়ানকে খুব অনুপ্রাণিত করেছিল। মুনজারিন রাইয়ান বলেন, ‘মাননীয় প্রধানমন্ত্রী খুব ভালো মানুষ। সবার সঙ্গে অনেক আন্তরিক ব্যবহার করেছিলেন, খোঁজখবর নিয়েছিলেন। মেয়েদের খুব পছন্দ করেন, তাদের এগিয়ে দিতে চান।’

২০১১ সালে ক্যাডেট পাইলট হিসেবে যোগ দেন বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইনসে। মুনজারিনের বাবা ছিলেন বিমান প্রশিক্ষক। তাঁর অগ্রজ আলিয়া মান্নানের মতো তিনিও বাবার অনুপ্রেরণায় এই পেশা বেছে নিয়েছেন। মুনজারিনের ভাইও বিমান কর্মকর্তা।

রোদ-বৃষ্টি-ঝড় কোনো কিছুতে চিন্তিত হন না মুনজারিন। বললেন, ‘বাংলাদেশের আবহাওয়ায় কখন কী হবে, বোঝা যায় না। দক্ষতা থাকলে কোনো অসুবিধায় পড়তে হয় না। আর কোথাও কোনো বিমান দুর্ঘটনার খবর শুনলে খারাপ তো লাগেই, তবে সেখান থেকে শিক্ষা নেওয়ার চেষ্টা করি আমি।’

বিমান চালনার পাশাপাশি নর্থ সাউথ বিশ্ববিদ্যালয়ে বিবিএ পড়ছেন তিনি। মুনজারিনও একবাক্যে স্বীকার করেন, পরিবারের সমর্থন ছাড়া কোনো কিছু করা কঠিন। ‘গত দুই বছরে আমি তো মাত্র একটা ঈদ ঢাকায় পরিবারের সঙ্গে করেছি। অনেক সময় খারাপ লাগে, আমার স্বামী তখন আমাকে মোটিভেশন দেন। তিনি কাজ করছেন গ্রামীণফোনে।’

আলিয়া মান্নান শুরুতে বলেছিলেন, অগ্রজেরা ভালো কিছু করলে সেটা অনুজদের অনুপ্রেরণা দেয়। তাই হয়তো আলিয়া মান্নানের কাছ থেকে, পাশে বসে অনুপ্রেরণা নিয়ে এগিয়ে চলবেন মুনজারিন রাইয়ান।