বাধা পেরিয়ে এগিয়ে যাওয়ার পালা

অনুপ্রেরণা, ভালো লাগা আর গানে হাতেখড়ির গল্পটা সবার প্রায় একই রকম। কিন্তু গানের পথে হাঁটতে গিয়ে একেকজন হোঁচট খেয়েছেন, খাচ্ছেন একেকভাবে। কেউ সামাজিক বাধায় পড়ছেন সমালোচনার মুখে, কারও পরিবার থেকে এসেছে বাধা, কেউ আবার বিরূপ মন্তব্য শুনছেন শারীরিক গড়ন নিয়ে। পপ তারকা খোঁজার রিয়েলিটি শো ‘সানসিল্ক ডিভাস’–এর শীর্ষ ৯ প্রতিযোগীর সঙ্গে কথা বলতে বসে তাঁদের বলা না–বলা গল্পগুলো উঠে এল।

নয়জন তরুণ পপশিল্পীর সঙ্গে দিন কয়েক আগ আমরা আলাপ করতে বসেছিলাম ক্রেইনজ লিমিটেডের ধানমন্ডির কার্যালয়ে। সেখানে একে একে এসে উপস্থিত হন ‘সানসিল্ক ডিভাস’ প্রতিযোগিতার শীর্ষ ৯ প্রতিযোগী।

বৈঠকখানায় পরিচয় পর্ব শেষ হতেই গল্পের ঝাঁপি খুলে বসেন মেয়েরা। বেশির ভাগের গল্পের শুরুটা প্রায় এক রকম। গড়পড়তায় বলতে গেলে এমন—‘সংস্কৃতিমনা পরিবারে বেড়ে ওঠা। গানের হাতেখড়ি পরিবার থেকেই। মা–বাবার অনুপ্রেরণাতেই আজ এ পর্যন্ত আসতে পেরেছি। সানসিল্ক ডিভাসের আগে স্কুল–কলেজ আর স্থানীয় অনুষ্ঠানে গান করেছি, অনেক প্রতিযোগিতায় অংশ নিয়ে চ্যাম্পিয়নও হয়েছি। কিন্তু সানসিল্ক ডিভাস মঞ্চই বদলে দিয়েছে জীবন।’

কিন্তু পপ ডিভারা নিজেদের উজাড় করে কথা বলতে যখন শুরু করেন, তখন বোঝা যায় এই মেয়েদের সংগীতসফর আদতে এত সহজ নয়। শুরুটা করি সামিরাকে দিয়ে। তাঁর বেশভূষা সবার চেয়ে আলাদা। রক্ষণশীল পরিবারের মেয়ে। কিন্তু হেভি মেটাল গান তাঁর পছন্দ। দুটিই কি বিপরীতমুখী? সামিরার কথায়, ‘আমার পোশাক আমার নিজের পছন্দ। আর গান আমার প্যাশন। দুটিই আমার পছন্দ। এ দুটি নিয়ে এগিয়ে চলাকেই আমি আমার স্বাধীনতা মনে করি। অনেকে মনে করে, গানবাজনা মানে বিপথগামী হয়ে যাওয়া। কিন্তু আমি বলব, এর চেয়ে পবিত্র কিছু নেই। তাই যে যাই বলুক, আমি জানি আমি কোনো ভুল পথে চলছি না।’

আমরা একে একে নয়জনের সঙ্গেই কথা বলি। শেষ দিকে গিয়ে সুনন্দা তাঁর গল্প শোনান। তাঁর প্রতিবন্ধকতার গল্পটা সবার চেয়ে আলাদা। পারিবারিক, সামাজিক বা ব্যক্তিগত নয়। সুনন্দা এক মানসিক প্রতিবন্ধকতা টপকিয়ে সানসিল্ক ডিভাসে পৌঁছেছেন। সুনন্দার গানের আদর্শ ছিলেন তাঁর বড় বোন। অনাঙ্ক্ষিত এক ঘটনায় প্রাণ হারান তিনি। এরপর থেকে সন্তান হারানো মা–বাবার মনে দানা বাঁধে আতঙ্ক। সুনন্দা একটা ভীতির মধ্যে বড় হতে থাকেন। তবে গান তাঁকে মুক্তির স্বাদ দিয়েছে তাঁর মা–বাবাকে জুগিয়েছে সাহস।

সানসিল্ক ডিভাসের শীর্ষ ৯ প্রতিযোগী— সামনের সারিতে বসা আনিকা, মৌ, শীতল, অতশী, শেহজিন এবং পেছনে সুনন্দা, অন্তরা, সুস্মিতা ও সামিরা । ছবি: খালেদ সরকার
সানসিল্ক ডিভাসের শীর্ষ ৯ প্রতিযোগী— সামনের সারিতে বসা আনিকা, মৌ, শীতল, অতশী, শেহজিন এবং পেছনে সুনন্দা, অন্তরা, সুস্মিতা ও সামিরা । ছবি: খালেদ সরকার

সুস্মিতা বলেন, ‘জানেন, আমি কোন প্রশ্নটা বেশি শুনি? “এত মোটা কেন মেয়েটা?” এটাই একটা প্রতিবন্ধকতা।’ হ্যাঁ, সুস্মিতার সঙ্গে ডিভাদের কয়েকজন তাল মেলান। তাঁরা বলতে চান, ‘বডি শেমিং’ (শারীরিক গড়ন নিয়ে উপহাস) ব্যাপারটার শিকার তাঁদের পদে পদেই হতে হয়। গানের চেয়ে বেশি তাঁদের পোশাক, সাজ, উপস্থাপনা নিয়ে হয় আলোচনা।

আনিকা আফরিন, সুনন্দা, শীতল, মৌ—সবাই বললেন সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে তাঁদের নিয়ে হওয়া সমালোচনা আর বাজে মন্তব্য চালাচালির কথা। এখনো আমাদের দেশের শ্রোতারা যে পপ গানের বিশ্বমানের উপস্থাপনা গ্রহণ করতে পারেন না, সেটা বলতেই প্রাণোচ্ছ্বল মেয়েদের কপালে ভাঁজ পড়ে গেল। তবে আশার কথা হলো, এই মেয়েরা থেমে নেই। শীতল জানালেন, তাঁর পরিবার তাঁর পাশে আছে, আর কি চাই? আর মৌ বললেন, ‘এসবকে আমরা আমলেই নিই না।’

পোশাক দিয়েও তরুণ এই পপশিল্পীদের মেধাকে মূল্যায়ন করেন অনেক শ্রোতা। সমালোচনা করে তাঁদের গানের ঘরানা ও গায়কির ঢং নিয়ে। অতশী বললেন তাঁর নিজের একটি অভিজ্ঞতা। তিনি পড়ছেন তড়িৎ ও ইলেকট্রনিক প্রকৌশল বিষয়ে। কিন্তু শেষ পর্যন্ত পেশা হিসেবে গানকেই বেছে নিতে চান। এই ইচ্ছা জানানোর পর তাঁকে শুনতে হয়—‘জীবন চলবে কীভাবে?’ ‘তাহলে আর পড়ছ কেন?’ নিয়মিত কভার সং করেন তিনি। এ নিয়েও নানাজনের নানা কথা শুনতে হয়। গানের ক্ষেত্রে অনেক সময় সতীর্থ ছেলেদের চেয়ে তাঁরা যে বাধার সম্মুখীন বেশি হচ্ছেন, সেটাও আমাদের জানান অতশী। বলেন, ‘আমরা দিনরাত গান নিয়ে পড়ে থাকতে পারি না। গানের জন্য দূরদূরান্তে চলে যেতে পারি না। মা–বাবা আমাদের নিয়ে, আমাদের নিরাপত্তা নিয়ে দুশ্চিন্তা করেন।’ অন্তরাও একমত এ ব্যাপারে। তিনি চেন্নাইয়ে এ আর রাহমানের কেএম মিউজিক কনজারভেটরি থেকে ওয়েস্টার্ন ক্লাসিক্যালের ওপর একটি ডিপ্লোমা কোর্স করেছেন। তাঁকেও সেখানে যেতে অনেক কাঠখড় পোড়াতে হয়েছে। একই রকম কষ্ট করতে হয়েছে সুস্মিতাকে লক্ষ্মীপুর থেকে ঢাকায় এসে পড়তে আর গান গাইতে আসার জন্য। শীতল তো এখনও মুন্সিগঞ্জ থেকে ঢাকায় আসা–যাওয়া করে নিজের গান ও পড়াশোনা চালিয়ে যাচ্ছেন।

তবে তাঁদের পরিশ্রম যে একটু একটু করে সার্থক হচ্ছে, এটা তাঁরা সানসিল্ক ডিভাস প্রতিযোগিতার শেষে এসে টের পাচ্ছেন। তাঁদের নিয়ে শুধু সমালোচনা নয়, আলোচনাও হচ্ছে, পাচ্ছেন নানাজনের প্রশংসা। বড় শিল্পীরা সানসিল্ক ডিভাস মঞ্চে তাঁদের সাহস জোগাচ্ছেন—নিয়মিত বিচারক চিরকুট ব্যান্ডের সুমি, নেমেসিসের জোহাদ, হৃদয় খান, আলিফ আলাউদ্দিন, অতিথি বিচারক অর্থহীন ব্যান্ডের সুমন, এলিটা করিম—তাঁরা সবাই মুগ্ধ ডিভাদের গান, পরিবেশনা ও ব্যক্তিত্বে।

সানসিল্ক ডিভাস অনুষ্ঠানটি নিয়মিত প্রচার করছে দীপ্ত টিভি। তা ছাড়া প্রতিটি পর্ব আছে ‘সানসিল্ক হেয়ার এক্সপার্ট বিডি’ নামের ইউটিউব চ্যানেলে। অনুষ্ঠানটির সার্বিক সহযোগিতায় আছে ক্রেইনজ লিমিটেড। তিন হাজার তরুণ শিল্পীর মধ্য থেকে বাছাই হতে হতে এখন আছে নয়জন। তাঁদের মধ্য থেকে চলতি মাসের শেষ দিকে চারজন পপশিল্পীকে বিজয়ী ঘোষণা করা হবে, যাঁদের নিয়ে পপব্যান্ড গঠন করা হবে। তবে যাঁরা শীর্ষ ৪–এ থাকতে পারবেন না, তাঁদের যাত্রা কিন্তু এখানেই শেষ হচ্ছে না। কারণ, এই একটি মঞ্চ তাঁদের যে ভিত গড়ে দিয়েছে, তা দিয়েই এখন আত্মবিশ্বাসী তাঁরা। প্রতিদিন সাফল্যের গল্প যোগ হচ্ছে তাঁদের ডায়েরিতে। এই যেমন মৌ প্রস্তাব পেয়েছেন জিঙ্গেল গাওয়ার, সুনন্দা এ প্রতিযোগিতারই এক বিচারকের গান কভার করতে যাচ্ছেন, অতশী আরেকটি বড় গানের প্রতিযোগিতায় যোগ দেওয়ার নিমন্ত্রণ পেয়েছেন। আর শীর্ষ ৯–এর বাইরে থাকা আরেক শিল্পী অজন্তা কাজ করছেন তাঁর নতুন গানে। তাই এখন বাধা পেরিয়ে শুধু এগিয়ে যাওয়ার পালা।